২০ এপ্রিল ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১০:১৪

কারসাজি ছাড়া নিত্যপণ্যের দাম রোজায় বাড়বে না

এ বছর এমন একটা সময়ে রোজার জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি হয়েছে, যখন আন্তর্জাতিক বাজার ছিল পড়তির দিকে। আবার রোজার কেনাবেচা যখন শুরু হবে, তখন মৌসুমের কারণে অভ্যন্তরীণ বাজারও থাকবে অনুকূলে। সব মিলিয়ে আগামী মাসের শেষ দিকে শুরু হতে যাওয়া রোজায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কেনাকাটা স্বস্তিতেই সারতে পারবে ক্রেতারা।

অবশ্য শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে, সেটি কারসাজির। রোজায় বাড়তি চাহিদাকে পুঁজি করে দাম বাড়ানোর প্রবণতা দেখা যায়। এমনকি রোজা শুরুর অনেক আগেই দাম বাড়িয়ে দেন ব্যবসায়ীরা। এবার যাতে তেমন ঘটনা না ঘটতে পারে, সে জন্য আগেভাগেই বাজারে নজরদারির পরামর্শ দিয়েছেন ভোক্তা অধিকারকর্মীরা।
চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ ও ঢাকার মৌলভীবাজারে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, রোজার পাইকারি কেনাবেচা ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। রোজার চাহিদার পণ্যের সিংহভাগ ইতিমধ্যে দেশে এসে গেছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিবেদন এবং বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, কোনো পণ্যের আমদানিতেই ঘাটতি নেই। বরং বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমদানি বেশি হয়েছে।
বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ গত রাতে এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, আগামী রমজান সামনে রেখে পণ্যের মজুত ভালো আছে। ভোজ্যতেলের আন্তর্জাতিক বাজারদর কিছুটা কমেছে। এটি নিয়ে ভোজ্যতেল কোম্পানিগুলোর সঙ্গে শিগগিরই বৈঠক হবে। তিনি বলেন, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সরাসরি হস্তক্ষেপ করা যায় না। ব্যবসায়ীরা তাঁদের ব্যবসা করবেন। তবে তাঁদের খেয়াল রাখতে হবে, যাতে ভোক্তারা না ঠকে। আর রোজার আগেই দাম বাড়ানো হতে দেওয়া হবে না। বাজার স্থিতিশীল থাকবে।
সব ধরনের পণ্যের সরবরাহ পরিস্থিতি ভালো থাকলেও আমদানির ক্ষেত্রে একটি সমস্যার কথা জানালেন চট্টগ্রামের গম ও ডালের বড় আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, এবার ডলারের দাম পড়েছে ৮১ টাকা ৪০ পয়সা, যা গত বছরের চেয়ে প্রায় ৩ টাকা বেশি।
দেশের শীর্ষস্থানীয় ভোগ্যপণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান মেঘনা গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক (বিপণন) আসিফ ইকবাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারের ভিত্তিতে আমরা আশা করতে পারি, এবার রোজায় প্রধান আমদানিপণ্যগুলোর দাম স্থিতিশীল থাকবে। পাশাপাশি সরবরাহের কোনো সংকটও হবে না। কারণ আমদানির পরিস্থিতিও ভালো।’
প্রধান খাদ্যপণ্য চালের বাজার এখন চড়া। তবে কিছুদিনের মধ্যেই নতুন বোরো মৌসুমের চাল বাজারে উঠতে শুরু করবে। সমস্যা নেই আটার বাজার নিয়েও। এনবিআরের হিসাবে, গত আট মাসে ৩৫ লাখ ৪৯ হাজার টন গম দেশে এসেছে, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৮ লাখ টন বেশি। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, গত বছরের জানুয়ারি-মার্চ সময়ে গমের গড় দাম ছিল টনপ্রতি প্রায় ১৯১ ডলার, যা গত মার্চে ১৫৪ ডলারে নেমেছে।
ভোজ্যতেলের বাজারও পড়তি। আন্তর্জাতিক বাজারে গত তিন মাসে সয়াবিন ও পামতেলের দাম বেশ খানিকটা কমেছে, যা গত বছরের শেষ দিকে বাড়ছিল। সর্বশেষ দাম কমতে থাকায় দেশের বাজারেও খোলা তেলের দাম কমেছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, আন্তর্জাতিক বাজারে গত জানুয়ারিতে প্রতি টন সয়াবিন তেলের দাম ছিল ৮৭২ ডলার। মার্চ মাসে তা ৮১৩ ডলারে নেমেছে। অন্যদিকে পামতেলের দাম ৮০৯ ডলার থেকে কমে টনপ্রতি ৭৩৬ ডলারে এসেছে। এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৮ মাসে ১৩ লাখ ৮১ হাজার টন ভোজ্যতেল আমদানি হয়েছে, যা বছরের মোট চাহিদার কাছাকাছি।
বর্তমানে ঢাকার খুচরা বাজারে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেল প্রায় ৮৪ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে, যা এক মাস আগের চেয়ে লিটারে ৩ থেকে ৪ টাকা কম। অন্যদিকে পামতেল মিলছে ৭২ থেকে ৭৬ টাকা দরে, যা এক মাস আগের চেয়ে লিটারে প্রায় ২ টাকা কম।
দেশে বছরে ১৪ লাখ টন চিনির প্রয়োজন হয়। রোজায় চাহিদা দাঁড়ায় প্রায় আড়াই লাখ টন। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে প্রায় সাড়ে ১৩ লাখ টন চিনি আমদানি হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২ লাখ ৬২ হাজার টন বেশি। ঢাকার বাজারে এখন প্রতি কেজি চিনি ৬৫-৬৬ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে, মাস দেড়েক আগেও যা ৬৮ থেকে ৭০ টাকা ছিল। দাম কমার কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে পড়তি দর।
আন্তর্জাতিক বাজারে গত কয়েক বছর মসুর ডালের যে চড়া দর ছিল, তা কমেছে। দেশের বাজারেও গত অক্টোবর থেকে ডালের দাম কমতে শুরু করে। এখন বাজারে ছোট দানার দেশি মসুর ডাল কেজিপ্রতি ১১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা এক বছর আগের তুলনায় প্রায় ৩০ টাকা কম। একইভাবে মাঝারি দানার কানাডার মসুর ডাল ২০ টাকা কমে কেজিপ্রতি ৯০ টাকা এবং বড় দানার মসুর ডাল কেজিপ্রতি ১৫ টাকা কমে ৭৫ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
ডাল আমদানিকারক আবুল বশর চৌধুরী বলেন, গত বছরের তুলনায় বুকিং মূল্য অনেক ভালো। কারণ উৎপাদন ভালো হয়েছে। এ কারণে আমদানিও বেশ ভালো হচ্ছে।
ডালের মধ্যে রোজায় সবচেয়ে বেশি বাড়ে ছোলার চাহিদা। পণ্যটি আমদানি হয় মূলত অস্ট্রেলিয়া থেকে। পাশাপাশি দেশেও কিছু উৎপাদিত হয়। আবুল বশর চৌধুরী বলেন, তিন-চার মাস আগে প্রতি টন ছোলার আমদানি মূল্য ছিল ৭০০ থেকে ৭৫০ ডলার, তা এখন হঠাৎ করে ৯৫০ ডলারে উঠেছে। গত বছরও দাম ৯০০ ডলারের বেশি ছিল। এবারও গত বছরের রোজার সময়কার কাছাকাছি দাম দিতে হবে। একটু কমও হতে পারে। কারণ আমদানি ভালো হয়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে গত অর্থবছরে ৩ লাখ ৮৪ হাজার টন ছোলা আমদানি হয়েছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ বছরের প্রথম আট মাসে আমদানি হয়েছে ২ লাখ ৮৮ হাজার টন। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, এ তথ্য ঠিক নয়। কারণ দেশে বছরে ৭০ হাজার টনের মতো ছোলার চাহিদা আছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবের মধ্যে ডাবলি, অ্যাংকরসহ অন্য কয়েকটি ডাল অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বলে ধারণা তাঁদের।
নিম্ন আয়ের মানুষের অ্যাংকর ডালের দাম নিয়েও চিন্তা নেই বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। আমদানিকারকেরা জানান, গত বছর এই ডালের ‘বুকিং’ মূল্য ছিল টনপ্রতি ৩৯০ ডলার, এবার সেটা ৩৪০-৩৫০ ডলারে নেমেছে।
চলতি অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আট মাসে ৯ লাখ ৯৫ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৫ লাখ ৬৮ হাজার টন বেশি। ভারতে দাম কম। আবার দেশে পেঁয়াজের মৌসুম চলছে। ফলে কেজিপ্রতি ৩০ টাকার কমে মিলছে পেঁয়াজ। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে প্রায় ৪৫ হাজার টন রসুন আমদানি হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৮ হাজার টন বেশি। চীনে দাম আগের মতো বেশি হলেও দেশি রসুন কেজিপ্রতি ১০০ টাকার মধ্যেই মিলছে। একইভাবে আদার আমদানি ৮ হাজার টন বেড়ে ৬৬ হাজার টন হয়েছে। দেশে কেজিপ্রতি ১০০-১২০ টাকার মধ্যেই আদা মিলছে।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান প্রথম আলোকে বলেন, রোজায় পণ্যের চাহিদা বেড়ে যায় বলে কিছু ব্যবসায়ী একে মওকা হিসেবে গণ্য করেন। তাঁরা ঈদের বাড়তি খরচ পণ্যের বাড়তি দাম নিয়ে ওঠান। তিনি বাজার স্থিতিশীল রাখতে নিবিড় তত্ত্বাবধান এবং সংকট তৈরি হলে বাজারে হস্তক্ষেপের ব্যবস্থা রাখার পরামর্শ দেন।

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1151151/