রাজধানীর কড়াইল বস্তিতে খোলা আকাশের নিচে একটি পরিবার। ছবি : কালের কণ্ঠ
২০ এপ্রিল ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১০:০৫

বারবার আগুন কারণ অজ্ঞাত

খোলা আকাশের নিচে দিন কাটছে ৪৪১২ পরিবারের

 

গত এক দশকে ১৫ বারের বেশি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে কড়াইল বস্তিতে। তবে বারবার কেন আগুন লাগছে তা জানে না কেউ। এমনকি ফায়ার সার্ভিসের কাছেও এ ব্যাপারে নেই স্পষ্ট কোনো তথ্য।
সর্বশেষ গত ১৫ মার্চ রাতে ভয়াবহ আগুনে পুড়েছে কড়াইল বস্তির চার হাজার ৪১২টি ঘর। এর পর থেকে ২০ হাজারের মতো বাসিন্দা খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছে।
বরাবরের মতো এবারও জানা যায়নি আগুনের কারণ। রহস্য খুঁজে বের করতে ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক (উন্নয়ন) আব্দুল মান্নানকে প্রধান করে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়। বাকি সদস্যরা হলেন উপসহকারী পরিচালক আব্দুল জলিল ও ফায়ার সার্ভিসের তেজগাঁও স্টেশনের সিনিয়র অফিসার ফয়সালুর রহমান।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওই কমিটি এখন আর তদন্ত করছে না। নতুন আরেকটি কমিটি হয়েছে। তার প্রধান করা হয়েছে ঢাকা বিভাগের উপপরিচালক সমরেন্দ্রনাথ বিশ্বাসকে। গত ৪ এপ্রিল সমরেন্দ্রনাথ জানান, তাঁকে প্রধান করে কমিটি গঠনের বিষয়টি এখনো তিনি জানেন না।
ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মকর্তা জানান, জুতার কারখানা থেকে আগুন লেগেছে এমন ধারণা পাওয়া গেছে। তবে কড়াইল বস্তি উন্নয়ন কমিটির সভাপতি মাওলানা আবদুস সোবহান জানান, গ্যাসের চুলা থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। রাত দেড়টার দিকে রান্না বসিয়েছিলেন এক মহিলা। আগুন লাগার পর তাঁরা পালিয়েছেন।
কী কারণে বারবার আগুন লাগছে সে বিষয়ে বস্তিবাসী স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারেনি। তবে তাদের ধারণা, দখলবাজির জন্য কেউ আগুন দিচ্ছে না। যারা বাড়ি দখল করে, তারা চাইলে যখন তখন এমনিতেই ঘরবাড়ি দখল করে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে। বস্তিটির দীর্ঘদিনের বাসিন্দা এক বৃদ্ধ কালের কণ্ঠকে জানান, ‘একসময় মোশাররফ নামে এক ব্যক্তির অনেকগুলো ঘর ছিল। ২০১১ সালে তাঁকে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা তাঁর অনেক ঘর দখল করে নেয়। এ ক্ষেত্রে আগুন দিয়ে বাড়ি দখলের প্রয়োজন হয়নি। ’
গত ২৬ থেকে ৩০ মার্চ পর্যন্ত বস্তিটিতে গিয়ে দেখা যায়, আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ২০ হাজার মানুষ খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছে। অনেক জায়গায় খুঁটি গেড়ে ওপরে পলিথিন দিয়ে নতুন করে বাসস্থান বানানোর চেষ্টা চলছে। বৃষ্টির কারণে নারী-শিশুদের অতিকষ্টে থাকতে দেখা যায়। তাছলিমা নামের এক মহিলা বলেন, ‘গত কদিন ধইরা মাঝে মাঝেই বৃষ্টি হইতাছে। তখন পলিথিন দিয়া মাথা ঢাইকা রাখি। ’
রিকশাচালক শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘আমি দোতলা ঘরে ঘুমিয়েছিলাম। রাত আড়াইটার দিকে আগুনের কথা শুনতে পেয়ে এক কাপড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যাই। তিন-চার বছর ধরে রিকশা চালাই। টাকা জমিয়ে একটি ফ্রিজ কিনেছিলাম বাড়ি নেওয়ার জন্য। কিন্তু সব শেষ হয়ে গেল। ’
একটি বাড়ির মালিক মজিবুর রহমান জানান, অভাবের তাড়নায় ২০০০ সালের দিকে কুমিল্লা থেকে ঢাকায় আসেন তিনি। কড়াইল বস্তিতে এক আত্মীয়ের কাছে ওঠেন। সে সময় ভ্যানগাড়ি চালাতেন। একপর্যায়ে অন্যদের মতো তিনিও সরকারি কিছু জমি দখল করে একটি ঘর তোলেন। এরপর আরো কিছু টাকা জমিয়ে টিনের দোতলা ঘর বানান। তখন থেকেই তিনি কড়াইল বস্তির একজন বাড়িওয়ালা। দোতলায় পরিবার নিয়ে থাকেন আর নিচতলায় দিয়েছিলেন একটি মুদি দোকান। গত ১৫ মার্চ আগুন লেগে তাঁর বাড়ি ও দোকান ছাই হয়েছে। এর আগে ২০০৪ সালেও আগুন লেগে তাঁর বাড়িটি পুড়েছিল।
বস্তি উন্নয়ন কমিটির সভাপতি মাওলানা আবদুস সোবহান কালের কণ্ঠকে জানান, বরগুনা থেকে কাজের আশায় ২৭ বছর আগে তিনি ঢাকা আসেন। মহাখালী ওয়্যারলেস গেটে একটি দোকানে কাজ নেন। কিন্তু সেই দোকানে আগুন লাগার কারণে কাজ হারান। এরপর কড়াইল মৌজায় খালি জায়গায় একটি ঘর তুলে তিনি বসবাস শুরু করেন। তাঁর মতো আরো অনেকেই চটের বেড়া দিয়ে ঘর বানিয়ে থাকতে শুরু করেন। দিনমজুরি করে কিছু টাকা জমিয়ে তাঁরা টিনের বাড়ি বানানো শুরু করেন। আর এভাবেই কড়াইলে গড়ে ওঠে পাঁচ হাজার ৮০০ বাড়ি। এর পাশে বেলতলী বস্তিতে রয়েছে আরো ৬৩৬টি বাড়ি। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এখানে যারা আছে, তারা সবাই সরকারি জমি দখল করেছে। যুগের পর যুগ ধরে এখানে থাকছে তারা। বস্তিবাসীর অন্য কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। আমরা সরকারের কাছে আবেদন জানাই আমাদের দিকে তাকানোর জন্য। ’

 

 

http://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2017/04/20/488733