২০ এপ্রিল ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৯:৫৮

‘চার পাপে’ নৌকা ডুববে!

বিবিধ প্রসঙ্গ

|| মাসুদ মজুমদার ||
 
ভালো কাজ খারাপ পদ্ধতিতে হয় না। এটা নীতিশাস্ত্রের কথা। কিন্তু অনেক সময় প্রত্যাশা করা হয় না এমন মানুষ কিংবা আদর্শিকভাবে ভিন্ন মেরুর লোকের মাধ্যমেও অপ্রত্যাশিতভাবে কিছু ভালো কাজ হয়ে যেতে পারে। ভালো মন্দ বিচারের ঊর্ধ্বে অনেক শাসকই কিছু দৃষ্টান্তমূলক ভালো কাজ করে ফেলেন। কখনো তা করেন জনগণকে শান্ত রাখার জন্য। কখনো বা গণসম্মতির সাথে নিজের চিন্তা ও বিশ্বাসের মিল খুঁজে পান বলেই ইতিবাচক পদক্ষেপ নেন। তা ছাড়া ভোটের রাজনীতিতে ইমেজ রিপেয়ারিংয়ের জন্য অনিচ্ছা সত্ত্বেও শাসকদের কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হয়। যেমন স্বপক্ষীয় বুদ্ধিজীবীদের নাখোশ হওয়া সত্ত্বেও স্কুল পাঠ্যবইয়ের সিলেবাস বিতর্কে প্রধানমন্ত্রী কিছু বিষয় পুনর্বহাল করে সাধুবাদ পেয়েছেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে সৌদি আরব থেকে মক্কা-মদিনা সংশ্লিষ্ট আলেম আনাটাও স্বাভাবিক নয়। কারণ দরবারের সাথে সংশ্লিষ্টরা কেউ সৌদি আলেমদের পছন্দ করার কথা নয়; বিশেষত ‘আকিদাগত’ কারণে। কওমি মাদরাসার সনদ নিয়েও প্রধানমন্ত্রীর পদক্ষেপ আলেম ওলামার ক্ষোভ কিছুটা হলেও প্রশমিত করবে। কওমি মাদরাসার সনদবিতর্কের সবটুকু সুরাহা হয়নি। তবে দাওরায়ে হাদিসের স্নাতকোত্তর মান নির্ধারণ ইতিবাচকভাবে নেয়া সম্ভব। কওমি আলেমরা এখনো এক মঞ্চে উঠতে পারেননি। অবশ্য অনৈক্যের মাঝেও তাদের একটা ঐক্য আছে। সনদ ইস্যুতে তাদের চাহিদা কী তা-ও স্পষ্ট করেননি। সেই ক্ষেত্রে হেফাজতের শীর্ষ নেতা এবং সরকারের অনুগত অংশের মেলবন্ধনে যা হলো তাতো মন্দের ভালো। এটা সত্য যে, আলেমসমাজ জাতির কাছে স্পষ্ট করতে পারেননি তারা কেমন স্বীকৃতি চান। আবার দেওবন্দ ধারার মৌলিকত্বও হারাতে চান না। একই সাথে, সরকারের নিয়ন্ত্রণের স্বরূপটি কেমন হলে তারা নিয়ন্ত্রণ বুঝবেন নাÑ সে ব্যাপারে সুস্পষ্ট ধারণা দিতে পারেননি। তাই যা হয়েছে সেটাকে অগ্রগতি ভেবে আরো সামনে এগিয়ে নেয়াই ভালো। এখন সরকারের দেয়া সুযোগ কিভাবে কাজে লাগানো হবে, সে ব্যাপারে ভেবে সিদ্ধান্ত নেয়া উত্তম। স্মরণে রাখতে হবে, যত কমিটিই হোক দরবারিরা সব কিছু ঠিকঠাক হতে দিতে চাইবেন না এবং সরকারি স্বীকৃতির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে খানিকটা নিয়ন্ত্রণের কারণে জবাবদিহির জন্যও প্রস্তুত থাকতে হবে। স্বীকৃতির ফলস্বরূপ একটি সমন্বিত মানের ভিত্তিতে আগামী দিনে সনদের বিষয়টি বাস্তবতা পাবে। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালোÑ আমাদের কওমি ধারার আলেমরা মূলত ধর্মীয় নেতা হতে আগ্রহী, রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে আগ্রহী নন। তবে এটা ঠিক, বাংলাদেশের আলেমসমাজ সবচেয়ে প্রভাবক সামাজিক শক্তি যারা নীতি নৈতিকতা ও ধর্মকর্মের চাষাবাদ করেন। জনগণের চোখে তারাই ভালো মানুষ। এদের গণভিত্তির শেকড় অনেক গভীরে। যারা তাদের উপস্থিতি সহ্য করতে চান নাÑ তারা যে কতটা গণবিচ্ছিন্ন, সেটা তারা জানেন বলেই ভয় পান।
হাইকোর্টের সামনে শাড়ি পরা গ্রিক মূর্তির ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য অভিনন্দনযোগ্য। কারণ জনগণ এই মূর্তি বা ভাস্কর্য রাখার মাঝে ভালো কিছু দেখছেন না। বরং এসবকে অপকর্ম ভাবেন এবং বিশ্বাসের সাথে এটাকে সাংঘর্ষিক হিসেবেই বুঝে নিয়েছেন; যদিও কিছু চিহ্নিত মানুষ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের ভেতর ‘অশনি সঙ্কেত’ দেখতে পাচ্ছেন। সেই সাথে প্রশ্ন ওঠে, দেশের সর্বোচ্চ আদালত ও জাতীয় ঈদগাহর সামনে ইনসাফের প্রতীক হিসেবে গ্রিক মূর্তি স্থাপনের বিষয়টি সরকারের প্রধান নির্বাহী জানেন না কেন? জাতীয় ঈদগাহ লাগোয়া স্থানে এই কাজটি যারা করলেন তারা কার অনুমতি নিয়ে করলেন? দাঁড়িপাল্লা ইনসাফের প্রতীক। হাইকোর্টের দেয়ালে এটি রয়েছে। আবার গ্রিক মূর্তির হাতে দাঁড়িপাল্লা ধরিয়ে দিয়ে সেটি স্থাপন করা মানে উচ্চ আদালতের মনোগ্রাম পাল্টে ফেলা। মিডিয়ার দলবাজ অংশটি আদালতের প্রশ্ন উঠলেই গ্রিক মূর্তির ছবিটি দেখানোর সুযোগ নেন। তাতে ধারণা জন্মে, উচ্চ আদালতের মনোগ্রাম হয়তো পাল্টে ফেলা হয়েছে। গ্রিক মূর্তি ভাস্কর্য কি নাÑ সেটি অবান্তর। ভাস্কর্য ও মূর্তির ফারাক শিল্পীদের বিষয়, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের বিষয় নয়।
গ্রিক মূর্তির ইতিহাস আর ভারতীয় মূর্তির ইতিহাস এক নয়। মূর্তিপূজক ধর্মাবলম্বীদের দেবদেবী আর গ্রিকদের দেবদেবীও এক নয়। মুসলমানরা কোনো মূর্তির প্রতি দুর্বল নয়, বরং আল্লাহর সাথে শরিক করার বিষয়টি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় নাকচ করে দিয়ে একত্ববাদের পক্ষে অঙ্গীকার ঘোষণার মাধ্যমেই বিশ্বাসী হতে হয়। খ্রিষ্টান সম্প্রদায় মূলত মূর্তিবাদী নয়। তবে ত্রিত্ববাদীরা যিশু, মেরি এবং ঈশ্বরকে মাথায় রাখেন, ঈশ্বরের মূর্তি বানান না। যিশু এবং মেরির কোলে যিশুর মূর্তি খ্রিষ্টানদের কয়েকটি সম্প্রদায়ের কাছে সম্মানের। অনেক খ্রিষ্টান ত্রিত্ববাদী নন। তারা যিশুকে বিশেষ মর্যাদা দিতে আগ্রহী, কিন্তু ঈশ্বরের মর্যাদায় উন্নীত ভাবেন না। ইহুদিরা মূর্তিবাদী নয়। বৌদ্ধরা বোধিদ্রুমে ধ্যানমগ্ন গৌতম মূর্তির ভক্ত। প্রকৃতিপূজারীরা গ্রিক মূর্তির ধারণা নেয় না। আমাদের দেশের ুদ্র নৃগোষ্ঠীর কাছেও গ্রিক মূর্তির কদর নেই। তাহলে সরকারকে কিংবা উচ্চ আদালতকে বিতর্কে জড়ানোর মধ্যে ফায়দাটা কী? কেউ কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেনÑ বিতর্ক তোলা হচ্ছে কেন? এই ‘কেন’র জবাব একটাইÑ জনগণের চিরায়ত বিশ্বাস ও মূল্যবোধকে অপ্রয়োজনে হোঁচট খেতে দেবেন কেন?
অনেকের যুক্তি দেশটা সেক্যুলার, দুর্ভাগ্য, অজ্ঞরা জানে না মূর্তি ধর্মের প্রতীক। ধর্মনিরপেক্ষ নয়, গ্রিক মূর্তিটি ধর্মবিশ্বাসের অংশ। ‘লেডি অব জাস্টিস’ নিয়ে লেখাপড়া করে দেখতে পারেন। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অনেক ভাস্কর্য আছে। কোনো মানুষ সেগুলোকে ধর্মবিশ্বাসের সাথে গুলিয়ে ফেলেননি। দু-একজন মন্তব্য করেছেনÑ এই সংস্কৃতি তাদের কাছে অচেনা।
প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, উচ্চ আদালত ও জাতীয় ঈদগাহর সামনে শাড়ি পরা গ্রিক মূর্তির ঠাঁই হলো কাদের সিদ্ধান্তে? একেশ্বরবাদীদের ললাটের ওপর মূর্তি সংস্কৃতির আমদানি হলো কিভাবে? সেই গ্রিক মূর্তিকে শাড়ি পরিয়ে বাঙালি ললনার অবয়ব দেয়ার ধারণাটি কাদের মগজ থেকে এলো? যারা ভাবছেন হেফাজতকে ‘তেলানোর’ জন্য প্রধানমন্ত্রী উদ্যোগ নিয়ে সনদের স্বীকৃতি দিলেন, গ্রিক মূর্তি সম্পর্কে তার অবস্থান ও পছন্দ-অপছন্দ জানিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। এই বক্তব্যের মাধ্যমে মৌলবাদ চাঙ্গা করার কথা যারা বলছেন, তারা এই জাতির স্বাতন্ত্র্যবোধ প্রসঙ্গে এখনো দুগ্ধপোষ্য শিশুই থেকে গেছেন। আবার তাদের খুশি করার জন্য বর্ষবরণের প্রসঙ্গ ওঠেনি তো! নববর্ষ উদযাপন কোনো ইবাদত নয়, পূজাও নয়Ñ এটাই সত্য। কিন্তু এটা পালনের রীতিতে নিজস্ব সংস্কৃতির পরিচয় আছে; সেখানে অন্য ধর্ম ও বর্ণের সংস্কৃতি আমদানির দরকার হবে কেন?
যে জাতি মূর্তি ভাঙেও না, পূজাও করে না, তাদের সাথে এই প্রহসন কেন! প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত ইচ্ছা এবং গ্রিক মূর্তির ব্যাপারে পছন্দ-অপছন্দের বিষয়টি জানান দেয়ার পর জাতি শুধু গ্রিক মূর্তির অপসারণ চায় নাÑ মূর্তিচিন্তা থেকে স্থাপন পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়ার সাথে কারা কিভাবে জড়িত, সেটাও জানতে চায়। প্রধানমন্ত্রী আলেম ওলামার সামনে প্রকারান্তরে গ্রিক মূর্তি সরানোর ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, এটা সরিয়ে নেয়া হয়তো সময়ের ব্যাপার। আবার সময় ক্ষেপণ করে ইস্যুটি এড়িয়ে যাওয়াও অসম্ভব নয়। এড়িয়ে গেলে প্রধানমন্ত্রী কিভাবে দায় বহন করবেন, সেই ভাবনা ভবিষ্যতের জন্য তোলা থাক। কিন্তু জাতি জানতে আগ্রহী, প্রধানমন্ত্রীর অজ্ঞাতসারে কারা জাতির ওপর এটি চাপালো, কেন চাপালো?
আওয়ামী লীগ গেল দুই মাস ফাউল খেলে যাচ্ছে। জঙ্গি অভিযান ও ভারত সফরের ইস্যুতে সরকার জনগণকে হতাশ করেছে। এভাবে ফাউল করতে থাকলে অর্ধেক ওভার শেষ হওয়ার আগেই সব উইকেটের পতন ঘটা অসম্ভব নয়। প্রধানমন্ত্রীর একটি বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য, নিন্দাবাদ ও সমালোচনার তীব্রতা ’৭৫-এর ট্র্যাজেডিকে ডেকে এনেছে। এখন প্রধানমন্ত্রীর চার পাশের লোকদের উৎপাত দেখার মতো। তাদের ভাষায় ‘চার পাপে’ শেখ হাসিনার নৌকা ডুববে। প্রথম পাপ স্কুল সিলেবাসে হস্তক্ষেপ, দ্বিতীয় পাপ সৌদি আলেমদের নিমন্ত্রণ, তৃতীয় পাপ কওমি মাদরাসার সনদের স্বীকৃতি এবং চতুর্থ পাপ গ্রিক মূর্তি নিয়ে দেয়া অভিমত। আসলে যারা এসব বলছেনÑ তারা কোনো সরকারের বন্ধু হলে সেই সরকারের আর কোনো শত্রুর প্রয়োজন হয় না। এরাই ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট কুড়ায় আবার পড়ন্ত বিকেলে ক্ষমতার আপদ হয়ে ওঠে।
আমাদের কাছে সত্যটা আলাদা। এবার নৌকাডুবির কারণ হবেÑ ক. সরকার গঠনে জবরদস্তি, খ. জনমত উপেক্ষা, গ. নির্বাচন ব্যবস্থায় ধস নামানো, বিরোধী দলকে অসহ্য বিবেচনা করে যুক্তিহীন দমন-পীড়ন, হামলা মামলা। ঘ. বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম অপহরণ, ঙ. বড় বড় আর্থিক কেলেঙ্কারি, চ. জঙ্গি দমনের নামে অবিশ্বাস্য ধরনের বাড়াবাড়ি, ছ. দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া, জ. সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ও অফিস-আদালতে ঢালাও দলীয়করণ, ঞ. বন্ধুত্বের নামে অতিমাত্রায় ভারত তোষণ। এসব কারণের সাথে যোগ হবে রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে প্রতিপক্ষে ঠেলে দেয়া জনগোষ্ঠীর রোষ। বামপন্থীদের ভাষায় ‘চার পাপ’ পতনের কারণ হবে নাÑ বরং কথিত চার পাপ প্রধানমন্ত্রীকে ঝড়ঝাপটা থেকে কিছুটা হলেও আশ্রয় দেবে।
masud2151@gmail.com

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/213433