১৪ এপ্রিল ২০১৭, শুক্রবার, ৯:৩৫

রাজধানীর অলিতে গলিতে মাদকের হাট

দুপুর গড়িয়ে বিকাল। ব্যস্ততম গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে কয়েক যুবক। এগুতেই একটি পলিথিন উঁচু করে ধরে এক যুবক জানতে চায় ‘মামা লাগবে?’ পলিথিনে আনুমানিক শতাধিক মরণনেশা ইয়াবা। ছোট কত আর বড় কত? যুবক বলে, ‘ছোটটা শট পড়ছে। চাহিদা বেশি। কালকে নতুন চালান আসবে। আজ বড়টা নেন। দাম কমে রাখতাছি। মাত্র ২২০ টাকা।’ বড়টা কিনতে আগ্রহ না দেখিয়ে তার নাম জিজ্ঞাসা করতেই যুবক বলে, ‘নাম দিয়ে কি করবেন। এখানে আসলেই পাবেন।’ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই যুবকের নাম সালাম। ওই এলাকায় তাকে চিনে উল্টা সালাম নামে। রাজধানীর মোহাম্মদপুরে এভাবেই প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে মাদক। শুধু মোহাম্মদপুর না, রাজধানীর বাড্ডা, ভাটারা, যাত্রাবাড়ী, কমলাপুর, গুলিস্তান, মতিঝিল, কাওরানবাজার রেলগেট, খিলগাঁও, রামপুরা এলাকায় প্রকাশ্যেই বিক্রি হচ্ছে মাদক।

মোহাম্মদপুরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি রয়েছে বিভিন্ন মোড়ে। অভিযানও হয় মাঝে-মধ্যে। গ্রেপ্তারও করা হয়। তারপরও থেমে নেই মাদকের হাট। দিনে-রাতে বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন কৌশলে। অভিযোগ উঠেছে, পুলিশের অভিযান হয় ‘জাস্ট আইওয়াশ’। অনেক সময় মাদক ব্যবসার মূল হোতাদের রক্ষা করার জন্য অভিযোগকারীকেও ফাঁসানোর ঘটনা ঘটে বলে জানান এলাকাবাসী। এখানে রয়েছে মাদকের শক্তিশালী সিন্ডিকেট। পুলিশের পাশাপাশি কখনও কখনও মাঠে নামে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। দরিদ্র মানুষকে ব্যবহার করে একটি প্রভাশালী চক্র রাজধানীর মোহাম্মদপুর ও আশপাশের এলাকায় গড়ে তুলেছে মাদকের হাট। মোহাম্মদপুরের এই এলাকায় মাদক ব্যবসায় জড়িত রয়েছে ৫ শতাধিক নারী-পুরুষ। মদ, গাঁজা, ফেন্সিডিল, ইয়াবা এমন কোনো মাদক নেই যা এখানে পাওয়া যায় না। রয়েছে ‘হোম ডেলিভারি’র ব্যবস্থা। এমনকি মাদক সেবন করার জন্য নিরাপদ স্থানও রয়েছে এই চক্রের। ৫০ টাকা দিলেই সেই নিরাপদ স্থানে মাদক সেবনের ব্যবস্থা করে দেয়া হয়। এরকম ‘নিরাপদ’ একটি স্থানের নাম মার্কেট ক্যাম্পের পাবলিট টয়লেট। সরজমিন সেখানে গিয়ে আশপাশেই পাওয়া গেছে ফেন্সিডিলের খালি বোতল, ইয়াবা সেবনের আলামত। মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প, সিসি, টাউনহল, সিআরও, স্টাফ কোয়ার্টার ক্যাম্প ঘুরে দেখা গেছে প্রকাশ্যে মাদক বিক্রির দৃশ্য। প্রতিদিনই এই হাটে কোটি টাকারও বেশি মূল্যের মাদক বিক্রি হয়। যদিও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন অর্ধকোটি টাকা মূল্যের মাদক বিক্রি হয় সেখানে। এসব এলাকা থেকে রাজধানীর বিভিন্নস্থান ও ঢাকার আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে যাচ্ছে মাদক।

পরিচয় গোপন করে খুচরা মাদক বিক্রেতা বেজি নাদিম, উল্টা সালাম, কামরানদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সদস্যকে ম্যানেজ করেই এখানে মাদক ব্যবসা পরিচালিত হয়। পরিচিত ক্রেতাদের হোম ডেলিভারি দেয়া হয়। ফোনে অর্ডার করলে পৌঁছে দেয়া হয় যথাস্থানে। এছাড়াও ক্রেতাদের দেখলেই চোখে-চোখে তাকান বিক্রেতারা। এ রকমই দুই তরুণকে দেখে চোখে চোখ রাখলেন মধ্য বয়সী এক লোক। ওই ব্যক্তিসহ তিনজন বসে গল্প করছিলেন মোহাম্মদপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সংলগ্ন জেনেভা ক্যাম্পের ফুটপাতে। চোখে চোখ রাখতেই দুই তরুণের একজন এগিয়ে যান। তারপর কাছাকাছি যেতেই জানতে চান, মামা লাগবে? তরুণ মাথা নাড়ান। বিক্রেতা যুবক ইয়াবার নাম ধরে জানতে চান, কোনটা লাগবে আর সেভেন নাকি চম্পা? তরুণ আস্তে করে কিছু একটা বলেন। তারপর একটি পলিথিনের প্যাকেট এগিয়ে দেয়া হয়। তরুণ ক্রেতা মানিব্যাগ বের করে টাকা দেন। একইভাবে মোহাম্মদপুরের গজনবী রোডের পাশেই এক গলিতে ঢুকতেই দেখা গেছে, পলিথিনে মোড়ানো ইয়াবা হাতে এক যুবক ক্রেতার হাতে তুলে দিচ্ছেন তা। সেখানে ঢুকতেই জানতে চাওয়া হয় কোথায় যাব। মাদকের এই হাটে মাদক বিক্রেতাদের নিরাপত্তার জন্য তাদের আশপাশে থাকে তাদের লোকজন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাউকে দেখলেই খবর পৌঁছে যায় মাদক বিক্রেতাদের কাছে। পাল্টে যায় পরিবেশ।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, কয়েক প্রভাবশালীর ছত্রছায়ায় ওই এলাকায় মাদক ব্যবসা পরিচালিত হয়। ওই চক্রটির সঙ্গে জড়িত রয়েছে পাঁচ শতাধিক খুচরা মাদক বিক্রেতা। বিভিন্ন সময়ে চক্রের খুচরা বিক্রেতা ও কয়েক পাইকারি বিক্রেতা গ্রেপ্তার হলেও মূল হোতারা রয়েছে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। আড়ালে থেকে মোহাম্মপুর, লালমাটিয়া, মিরপুর এলাকায় মাদকের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে ইশতিয়াক, নাদিম ওরফে পঁচিশ, পাপিয়া, পাঁচু, তানভীর, শামীম ও রানী। তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলেও অদৃশ্য আশীর্বাদে পাপিয়া, পঁচিশ, পাঁচু ছাড়া উল্লেখযোগ্যরা গ্রেপ্তার হয়নি। তাদের গ্রেপ্তার করতে গিয়ে মাদক ব্যবসায়ীদের হামলার শিকার হয়েছেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সদস্যরা। একইভাবে তেজগাঁও রেললাইন এলাকায় ডালায় সাজিয়ে প্রকাশ্যে মাদক বিক্রি করা হচ্ছে দীর্ঘদিন থেকে। এখানে প্রকাশ্যে ডেকে ডেকে বিক্রি করা হয় ইয়াবা, গাঁজা। ওই রেললাইন দিয়ে হাঁটলে কিছুক্ষণ পরপর একটি জিজ্ঞাসার মুখোমুখি হতে হয় ‘মামা লাগবে?’ সূত্রমতে, এখানে শতাধিক খুচরা ব্যবসায়ী রয়েছে। তারা মাদক বিক্রিকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন। ভয়ানক তথ্য হচ্ছে, নারী-পুরুষের পাশাপাশি শিশুরাও বিক্রি করছে মাদক। প্রায় সন্ধ্যায় রেললাইনে বসে মাদক বিক্রি করতে দেখা যায় মিনা, মাহমুদা, নীলা, জরিনা, সাথী নামে কয়েক নারীকে। পাশাপাশি আনোয়ার, সালাম নামে ১২-১৩ বছরের দুই শিশুকেও গাঁজা বিক্রি করতে দেখা গেছে। এ রকম অন্তত ৩০ শিশুকে মাদক বিক্রি করানো হচ্ছে ওই এলাকায়। সূত্রমতে, দেশের অভ্যন্তরীণ ৪৭টি রুটের যানবাহন ও ট্রেনে মাদক পরিবহন করা হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দেয়া তথ্যমতে, ঢাকায় ছয় শতাধিক মাদকের স্পট রয়েছে। কিন্তু মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কাছে ১০০ স্পটের হিসাব রয়েছে। এরমধ্যে ৩০ স্পটে প্রকাশ্যেই মাদক বিক্রি হয়। এই মাদকের হাটগুলোকে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ হিসেবে উল্লেখ রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাগজপত্রে।

রামপুরার উলন, মুক্তির গলিতে রূপা নামে এক নারী ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের এক নেতার ছেলে, মতিঝিলের রাজউক ভবনের উল্টা দিকে রাস্তায় হারুন ও রুবেল এবং তাদের লোকজন, গুলিস্তানে মহানগর নাট্যমঞ্চ সংলগ্ন এলাকায় রাসেল, খিলগাঁও আমান উল্লাহ মার্কেটের ছাদে আজিজ ও মানিক এবং তাদের লোকজন, সায়েদাবাদ বাসস্ট্যান্ড ও দয়াগঞ্জ রেললাইনে ময়না, রাজু, মুন্নী, কমলাপুর টিটিপাড়ায় তালাশ, উত্তরার আশকোনায় জ্যোতি, জাবেদ, সুজন প্রকাশ্যে মাদকের হাট নিয়ন্ত্রণ করে। এছাড়াও হাজারীবাগের গণকটুলি, বনানীর সাততলা বস্তি এলাকা, করাইলবস্তি, মহাখালী বাসস্ট্যান্ড, বাড্ডার মোল্লাপাড়ায় বাজার গলি, কবরস্থান রোডের পাঁচতলা এলাকার বড়টেক, আফতাবনগর, ভাটারা থানার খিলবাড়ীরটেক খালপাড়, নূরেরচালা, বৌবাজার, শাহজাদপুর, নতুনবাজার, ফকিরাপুল গরমপানির গলি, শান্তিবাগ ঝিল মসজিদ এলাকা, খিলগাঁও তিলপাপাড়া কালভার্ট এলাকায় অবাধে বিক্রি হচ্ছে মাদক। এসব স্পট নিয়ন্ত্রণ করছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। তাদের অনেকেই সরকারি দলের পদ-পদবি ব্যবহার করছেন। তাদের কাছে প্রশাসনও অনেকটা জিম্মি। যে কারণে এসব মাদকের হাট বন্ধ হচ্ছে না কিছুতেই। এ বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মুকুল জ্যোতি চাকমা বলেন, ঢাকায় বিভিন্নস্থানে অবাধে মাদক বিক্রি হচ্ছে। আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করছি নিয়ন্ত্রণ করতে। আমাদের জনবল কম। তারপরও প্রায়ই অভিযান চালানো হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, মাদকব্যবসায়ীরা অত্যন্ত প্রভাবশালী। গত বছরের নভেম্বরে জেনেভা ক্যাম্পে অভিযান চালাতে গিয়ে আমাদের লোকজন হামলার শিকার হয়েছে। নানা প্রতিকূলতা থাকলেও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সক্রিয় বলে জানান তিনি।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=61516