১৪ এপ্রিল ২০১৭, শুক্রবার, ৯:২১

পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা একটা ধর্মের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রকাশ

 বাংলা নববর্ষে পহেলা বৈশাখের শোভাযাত্রা হিন্দুয়ানি আচার-উপকরণে ঠাসা থাকলেও একে প্রচার করা হয়ে থাকে ‘অসাম্প্রদায়িক’ আয়োজন। একদা এটি ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’ নামে পরিচিত থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তথাকথিত প্রগতিবাদী আয়োজকদের প্রকারান্তরে ইসলাম বিদ্বেষ ও একটি বিশেষ ধর্মীয় সংস্কৃতির প্রতি দুর্বলতা একে নতুনভাবে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামকরণ করা হয়। এদিকে, ইউনেস্কোর স্বীকৃতির ধুয়া তুলে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় চেতনার পরিপন্থী এ শোভাযাত্রা সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাধ্যতামূলক করায় নিন্দা-প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে।

বোদ্ধামহল বলছেন, এ ধরনের সাম্প্রদায়িক শোভাযাত্রা বাংলাদেশে না করাই ভালো। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করে একটি বিশেষ ধর্মের আচার-প্রতীককে জবরদস্তিমূলক সবার ওপর চাপিয়ে দেয়া মোটেই মঙ্গলজনক হতে পারে না। তারা এও বলছেন, দেশের বিভিন্ন সামাজিক, প্রাকৃতিক ও ধর্মীয় ঐতিহ্যের সম্মিলিত উপস্থাপনে জাতীয় উৎসব পহেলা বৈশাখে একটি ‘বৈশাখী র্যা লী’ অবশ্যই হতে পারে। ঢাকায় কেন্দ্রীয়ভাবে এবং জেলা-উপজেলা পর্যায়েও হলে দোষের কিছু নয়।
আন্ত:মন্ত্রণালয়ের বৈঠকের পর গত ১৬ মার্চ মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর (মাউশি) থেকে একটি নির্দেশনায় বলা হয়, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের আওতাধীন সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে মঙ্গল শোভাযাত্রাসহ নববর্ষ পালন করতে হবে। মাউশি’র সহকারী পরিচালক (এইচআরএম) আশেকুল হক স্বাক্ষরিত ওই নির্দেশনায় বলা হয়, বাংলা নববর্ষ ১৪২৪ আয়োজন উপলক্ষে একটি আন্ত:মন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে পহেলা বৈশাখে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় উৎসবমুখর পরিবেশে ও আড়ম্বরের সঙ্গে বাংলা বর্ষবরণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এছাড়া ইউনেস্কো কর্তৃক মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বিশ্বঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত করায় বিষয়টি গুরুত্বসহ উদযাপনের নির্দেশনা দেয়া হয়। এমতাবস্থায় মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের আওতাধীন সব প্রতিষ্ঠান প্রধানকে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় এ অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে।
বাংলা নববর্ষের মঙ্গল শোভাযাত্রার সমর্থক ও সুবিধাভোগীদের দাবি, এ শোভাযাত্রা নাকি হাজার বছরের ঐতিহ্য। কিন্তু ইতিহাস বলে ভিন্ন কথা। অনুসন্ধানে জানা যায়, আধুনিক নববর্ষ প্রথম উদযাপন হয় ১৯১৭ সালে। প্রথম মহাযুদ্ধে বৃটিশদের বিজয় কামনা করে সে বছর পহেলা বৈশাখে হোম কীর্তন ও পূজার ব্যবস্থা করা হয়। এরপর ১৯৩৮ সালেও অনুরূপ কর্মকান্ডের উল্লেখ পাওযা যায়। পরবর্তী সময়ে ১৯৬৭ সনের আগে ঘটা করে পহেলা বৈশাখ পালনের রীতি তেমন একটা জনপ্রিয় হয়নি।
ইংরেজ প্রভুদের মনোরঞ্জনে আয়োজিত পূজাকেই আজ বিবর্তিত রূপ মঙ্গল শোভাযাত্রাতে পরিণত করা হয়েছে। বর্তমানের মঙ্গলশোভা যাত্রা আরো অনেক পরে শুরু হয়েছে। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, কথিত ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ এভাবে শুরু - ১৯৮৯ সালে প্রথম আনন্দ শোভাযাত্রায় ছিল পাপেট, ঘোড়া, হাতি। ১৯৯০ এর আনন্দ শোভাযাত্রায়ও নানা ধরনের শিল্পকর্মের প্রতিকৃতি স্থান পায়। ১৯৯১ সালে চারুকলার শোভাযাত্রা জনপ্রিয়তায় নতুন মাত্রা লাভ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের শিক্ষার্থী, শিক্ষক-শিক্ষিকা ও শিল্পীদের উদ্যোগে হওয়া সেই শোভাযাত্রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর, বিশিষ্ট লেখক, শিল্পীগণ-সহ সাধারণ নাগরিকরা অংশ নেয়। শোভাযাত্রায় স্থান পায় বিশালকায় হাতি, বাঘের প্রতিকৃতির কারুকর্ম। কৃত্রিম ঢাক আর অসংখ্য মুখোশখচিত প্ল্যাকার্ডসহ মিছিলটি নাচে গানে উৎফুল্ল পরিবেশ সৃষ্টি করে। ১৯৯২ সালের আনন্দ শোভাযাত্রার সম্মুখে রং বেরংয়ের পোশাক পরিহিত ছাত্র-ছাত্রীদের কাঁধে ছিল বিরাট আকারের কুমির। বাঁশ এবং বহু বর্ণের কাপড় দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল কুমিরটি। ১৯৯৩ সালে ‘১৪০০ বঙ্গাব্দ উদযাপন কমিটি’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের সামনে থেকে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের করে। শোভাযাত্রার আকর্ষণ ছিল বাঘ, হাতি, ময়ূর, ঘোড়া, বিভিন্ন ধরনের মুখোশ। চারুকলার সামনে থেকে শোভাযাত্রাটি শুরু হয়ে শাহবাগ মোড় দিয়ে শিশু একাডেমি হয়ে পুনরায় চারুকলায় এসে শেষ হয়। অবশ্য বাংলাদেশে বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে প্রথম ১৯৮৬ সালে যশোরে শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। একশ্রেণির সাংস্কৃতিক বোদ্ধা যশোরে শুরু হওয়া ব্যাপারটিকে আজ হাজার বছরের বাঙ্গালীর ঐতিহ্য হিসেবে দাঁড় করানো হচ্ছে। একই সাথে সমাজে এমন একটা প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছেন, এই শোভাযাত্রার বিরুদ্ধে যিনিই কথা বলুন না কেন তিনি মৌলবাদী এবং গোঁরা। আর যারা হিন্দুয়ানি সংস্কৃতি লালন-পালন করে তারা নাকি প্রগতিশীল!
দীর্ঘদিন ধরে দেশের হাক্কানী আলেম সমাজসহ ধর্মীয় সংগঠনগুলো ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ বন্ধের দাবি তুলে আসছে। এ বছরও বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে হিন্দুয়ানি এ শোভাযাত্রা বন্ধের দাবি তোলা হয়েছে। অবশ্য ইউনেস্কোর স্বীকৃতির অজুহাত তুলে সরকারিভাবে পহেলা বৈশাখে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ পালনে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে বাধ্যতামূলক নির্দেশনা দেয়ায় তা নিয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।

অবশ্য, গত বুধবার গণভবনে এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, পহেলা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা মুঘল আমল থেকেই শুরু হয়। মঙ্গল শোভাযাত্রা বাঙালি সংস্কৃতিরই অংশ। এটি আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। এটি যুগ যুগ ধরে হয়ে আসছে। সব ধর্মের মানুষ একসঙ্গে বাংলা বছরের প্রথম দিন উদযাপন করে। এটি কোনও হিন্দুয়ানি শব্দ নয়। বাংলা নববর্ষ উদযাপনের সঙ্গে ধর্মের কোনও সংযোগ নেই। এখানে ধর্মকে টেনে আনার কোনও যৌক্তিকতা নেই। এটিকে নিয়ে অনেকে বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করেন।

গত ৮ এপ্রিল পহেলা বৈশাখে দেশের সব সরকারি স্কুল কলেজে মঙ্গল শোভাযাত্রা বাধ্যতামূলক করার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব আল্লামা হাফেজ মুহাম্মদ জুনায়েদ বাবুনগরী। একই সঙ্গে ঈমান-আক্বীদা ও ইসলাম বিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করে এই নির্দেশনা প্রত্যাহারেরও দাবি জানিয়েছেন তিনি। বাবুনগরী বলেন, মুসলিম ছাত্রদের ঈমান বিরোধী রীতি পালনে রাষ্ট্র কখনোই বাধ্য করতে পারে না। এটা নাগরিকদের অধিকার রক্ষার সংবিধানের মৌলিক নীতিমালার ঘোরতর বিরোধী। তিনি বলেন, আমরা দেশীয় রীতি ও সংস্কৃতির বিরোধী নই। তবে সংস্কৃতির লেবেল সেঁটে দিয়ে মুসলমানদের ঈমান হরণ করার আয়োজনে চুপ থাকার সুযোগ নেই। বিবৃতিতে আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী আরো বলেন, ইসলামের বিশ্বাস মতে কোন জীবজন্তু, বন্যপ্রাণী ও দেবদেবীর মূর্তির কাছে কল্যাণ ও মঙ্গল কামনা করলে ঈমান থাকবে না। সুতরাং মুসলমানদের জন্যে মঙ্গল শোভাযাত্রার সংস্কৃতি চর্চা অবশ্যই পরিত্যাজ্য।

বিবৃতিতে হেফাজত মহাসচিব ২০১৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরো কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পহেলা বৈশাখের নববর্ষ বরণ অনুষ্ঠানে নারী সমাজের উপর সংঘবদ্ধ যৌন-নির্যাতনের ঘটনার উল্লেখ করে বলেন, এর আগেও বহুবার বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে নারী নির্যাতন ও নারীদের সম্ভ্রমহানির মতো ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে। তাই মা-বোনদের প্রতি আহ্বান জানাবো, তারা যেন বর্ষবরণের নামে ইসলাম বিরোধী এসব অনুষ্ঠানে শরিক হওয়া থেকে বিরত থাকেন।

পয়লা বৈশাখে দেশের সব সরকারি স্কুল-কলেজে মঙ্গল শোভাযাত্রা বাধ্যতামূলক করাকে ইমান-আকিদা ও ইসলামী সংস্কৃতিবিরোধী হিসেবে আখ্যায়িত করে নির্দেশনা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন খেলাফতে ইসলামী বাংলাদেশের আমির ও ইসলামী ঐক্যজোটের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান মাওলানা আবুল হাসানাত আমিনীও। এছাড়া গত ১ এপ্রিল বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে ‘ইসলামী ঐতিহ্য সংরক্ষণ কমিটি’ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মঙ্গল শোভাযাত্রাসহ নববর্ষ উদযাপনের প্রজ্ঞাপন বাতিলের দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ করে।

মঙ্গল শোভাযাত্রা প্রসঙ্গে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেন, মুখোশ মানুষের জন্য কি মঙ্গল আনতে পারে ? মুখোশ মুখে দিয়ে কার কাছে মঙ্গল কামনা করা হয় সেই প্রশ্ন আমরা তুলেছি। আর মঙ্গল শোভাযাত্রা হচ্ছে হিন্দুদের সংস্কৃতি। এটা কোনোভাবেই মুসলমানদের উৎসব হতে পারে না। ভাস্কর্যের অপসারণ নিয়ে হেফাজতের বক্তব্য অনেক গণমাধ্যমে ভিন্ন ভাবে তুলে ধরা হয়েছে অভিযোগ করে আজিজুল হক বলেন, ,আমরা সব ভাস্কর্যের বিরোধিতা করছি না। শহীদ মিনার, স্মৃতিসৌধ আছে, ফোয়ারা আছে, শাপলা আছে, এসব নিয়ে আমাদের বিরোধিতা নেই। আমরা শুধু বলছি মানুষ বা কোন প্রাণীর আকৃতির মূর্তি নিয়ে, যা ইসলামে নিষেধ করা হয়েছে। সৌন্দর্য কি শুধু মূর্তি বানালেই হয় ? শাপলা চত্বরের শাপলা কি অসুন্দর ?

দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী বলছে, মঙ্গল শোভাযাত্রা ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ হারাম। এ শোভাযাত্রা বিজাতীয় সংস্কৃতির অংশ। গণমাধ্যমে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে জামায়াতের নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলেন, বাংলাদেশে সর্ব প্রথম ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে ১লা বৈশাখ মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রবর্তন করা হয়। মঙ্গল শোভা যাত্রায় বড়বড় পুতুল, হুতোম পেঁচা, হাতি, কুমির ও ঘোড়াসহ বিভিন্ন জীব-জন্তু মুখোশ পরিধান করে প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষ একসঙ্গে অশালীন পোশাক পরে অশ্লীল ভঙ্গিতে ঢোল বাদ্যের তালে তালে নৃত্য করে সড়ক প্রদক্ষিণ করার রীতি চালু করা হয়েছে, যা ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ হারাম। হিন্দু সমাজে শ্রী কৃষ্ণের জন্মদিনে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। তারা তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী মঙ্গলের প্রতীক হিসেবে পেঁচা, রামের বাহন হিসেবে হনুমান, দুর্গার বাহন হিসেবে সিংহের মুখোশ পরে ও দেবতার প্রতীক হিসেবে সূর্য এবং অন্যান্য জীব-জন্তুর মুখোশ পরে মঙ্গল শোভাযাত্রা করে থাকে।’

‘মঙ্গল শোভাযাত্রা বাঙালি সংস্কৃতির অংশ, ধর্মীয় সংশ্লিষ্টতা নেই’- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এমন বক্তব্যের বিরোধিতা করে মুজিবুর রহমান বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয়ই অবগত আছেন, বাংলাদেশের সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম এবং রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ বিদ্যমান আছে। এ অবস্থায় ক্ষমতার জোরে দেশের সংবিধান লঙ্ঘন করে দেশের জনগণের ওপর ভিন্ন ধর্মের অপসংস্কৃতি চাপিয়ে দেয়া উচিত হবে না। ভিন্ন ধর্মের রীতিনীতি তিনি দেশের শতকরা ৯০ জন মুসলমানের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়ার অপচেষ্টা চালালে তার পরিণতি শুভ হবে না।’

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ-এর আমীর মুফতী সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম পীর সাহেব চরমোনাই পহেলা বৈশাখে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’র আয়োজন গ্রামে-গঞ্জেও ছড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনার তীব্র সমালোচনা করে বলেন, বাঙ্গালী সংস্কৃতির সার্বজনীনতার তত্ত্বের আড়ালে এসব বিধর্মীয় প্রথা অনুশীলনের জন্যে এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ তৌহিদী জনতাকে বাধ্য করার উদ্যোগ গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা অমুসলিমদের প্রতীক ও উপমা ব্যবহার করে কল্যাণ কামনা করা মুসলিম সমাজে প্রচলিত নয়। মঙ্গল শোভাযাত্রা একটি সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ধর্ম ও সংস্কৃতির অংশ। মূলতঃ দেব-দেবীকে উদ্দেশ্য করে এসব আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে একটি সংখ্যালঘু গোষ্ঠী কল্যাণ কামনা করে থাকে।

এক বিবৃতিতে পীর সাহেব চরমোনাই বলেন, ‘এই মঙ্গল শোভাযাত্রায় থাকে বিচিত্র রকম পশুপাখীর মুখোশ পরিহিত নর-নারী। এরা বাঘ বিড়ালের মুখে চিংড়ি, মাছ, সন্তানতুল্য ছোট মাছ, হাঁস, পাখা মেলা ময়ূর, লক্ষ্মী পেঁচা, হরিণ শাবকের মাধ্যমে বাঙ্গালীর আবহমান ঐতিহ্যকে তুলে ধরার দাবি করে। যেসব পশু-পাখি নিয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রা করা হয়, তা ও এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ধর্মীয় বিশ্বাস ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের পরিপন্থী। কেননা সংখ্যালঘু একটি জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় বিশ্বাস মোতাবেক পেঁচা মঙ্গলের প্রতীক ও লক্ষ্মীর বাহন, ইঁদুর গণেশের বাহন, হনুমান রামের বাহন, হাঁস স্বরসতীর বাহন, সিংহ দূর্গার বাহন, গাভী রামের সহযাত্রী, সূর্য দেবতার প্রতীক ও ময়ূর কার্তিকের বাহন। কেউ কেউ শরীরে দেব-দেবীর, জন্তু-জানোয়ারের প্রতিকৃতি, কালির লোহিত বরণ জিহ্বা, গণেসের মস্তক ও মনসার উল্কি একে ভাড় সেজে এবং মৃদঙ্গ-মন্দিরা, খোল-করতাল বাজিয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করে। এদেশে একটি সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর ধর্ম হচ্ছে প্রতীকবাদী। প্রতীকের মাধ্যমে তারা পূজা-প্রার্থণা করেন। ইসলামে এটা সম্ভব নয়। তাই মঙ্গল শোভাযাত্রায় যেসব প্রতীক উপস্থিত করা হয়, মুসলমানদের কাছে তা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য।

চরমোনাই পীর হিজরী সনের পরিবর্তিত রূপ বাংলা সনের পহেলা বৈশাখকে আমাদের প্রধান সামাজিক উৎসব হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন, এই উৎসব নিজস্ব গুরুত্বে জাতীয় জীবনে বিশেষ চেতনার দ্যোতক। কিন্তু মঙ্গলশোভাযাত্রা, মঙ্গলঘট, মঙ্গল প্রদীপ, মাঙ্গলিক প্রতীক অঙ্কন, চৈত্র সংক্রান্তি, পান্তা ইলিশ, উলুধ্বনী, রাখি বন্ধন, ধুতি পরিধান সিঁদুরের ব্যবহার, হোলি খেলা প্রভৃতি আমদানী করা বিশেষ ধর্মীয় কুসংষ্কারাচ্ছন্ন আচার-রীতির আগ্রাসনে পহেলা বৈশাখের চেতনাকে বিজাতীয়মুখি করা হচ্ছে। এই আগ্রাসন পরিচালিত হচ্ছে আমাদের নিজস্ব সংষ্কৃতির স্বাভাবিক বিবর্তনকে বাধাগ্রস্ত করে একটি স্বাধীন জাতির স্বাতন্ত্রবোধকে ধ্বংস করার জন্যে বিভিন্ন প্রথা পদ্ধতি চালু করার মাধ্যমে। তিনি বলেন, গণতন্ত্রের দৃষ্টিতে অধিকাংশ মানুষের সংস্কৃতি ও মূল্যবোধকেই সার্বজনীনতার মর্যাদা

তিনি বলেন, ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় যুক্ত মঙ্গলশোভাযাত্রা সাম্প্রদায়িক। মঙ্গল শোভাযাত্রা কোন ক্রমেই বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জীবনধারার সঙ্গে যুক্ত নয়। কেননা মঙ্গল শোভাযাত্রার সাথে শিরক বা মহান আল্লাহর সাথে অংশীদারিত্বের ধারণা জড়িত। তাই মঙ্গল শোভাযাত্রা সার্বজনীন নয়। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার উৎসবও নয়।
পীর সাহে চরমোনাই বিবৃতিতে আরো বলেন, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা, জি-এইট প্রভৃতি একযোগে পরিকল্পিতভাবে মুসলিম দেশগুলোর শিক্ষা-সংস্কৃতিকে তাদের ইচ্ছা ও পরিকল্পনা অনুযায়ী ঢেলে সাজাচ্ছে। বাংলাদেশকেও তারা তাদের উদ্দেশ্যসাধনের যন্ত্রে পরিণত করে চলছে। তাদের ই ঘৃণ্য ভূমিকার গ্রাস থেকে আত্মরক্ষার করে চলার জন্যে নিজেদের আত্মশক্তির বিকাশ ঘটাতে হবে।
এদিকে, বাংলা নববর্ষ উদযাপনের নানা উৎসবের মধ্যে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’টি একেবারেই নবীন। তাহলে জাতিসংঘের -ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা, ইউনেস্কো একে বিশ্ব সংস্কৃতি হিসেবে স্বীকৃতি দিল কেন? বিবিসি বাংলার এমন এক প্রশ্নের জবাবে বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বাংলাদেশে ইউনেস্কো কমিশনের সচিব মঞ্জুর হোসেন বলেন, বাচনিক ঐতিহ্য বা সামাজিক চর্চাসহ বাকৃতিক বা বৈশ্বিক চর্চার বিষয়গুলো বিশ্ব সংস্কৃতির অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ রযয়েছে। এখানে দীর্ঘদিনের প্রথা হতে হবে এমন কোন বাধ্যবাধকতা নেই। বাংলাদেশে এখনো পর্যন্ত তিনটি বিষয়কে অপরিমেয় বিশ্ব সংস্কৃতির অংশ হিসেবে ঘোষণা করেছে ইউনেস্কো। ২০১৬ সালে মঙ্গল শোভাযাত্রা এবং জামদানি বুনন শিল্পকে স্বীকৃতি দিয়েছে সংস্থাটি। এর আগে ২০০৮ সালে স্বীকৃতি দেয়া হয় বাংলাদেশের বাউল সঙ্গীতকে।

http://www.dailysangram.com/post/279797