১৪ এপ্রিল ২০১৭, শুক্রবার, ৯:১৯

পিডিবি সামিট থেকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ কিনেছে ২০ টাকায়

# ৬ বছরে লোকসান গুণেছে ৪০ হাজার কোটি টাকা
# গ্রাহকের উপর তৈরি হচ্ছে মূল্যবৃদ্ধির চাপ
কমদামে কুইক রেন্টাল থেকে বিদ্যুৎ কেনার সুযোগ থাকার পরও বেশি দামের বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ ক্রয় করছে পিডিবি। এতে করে একদিকে লোকসানের পাল্লা যেমন বাড়ছে তেমনি বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর মাধ্যমে গ্রাহকদের বারবার পকেট কাটার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। এছাড়া ভুতুড়ে বিলের মাধ্যমে গ্রাহকদের নিকট থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায় করা হচ্ছে । পরিসংখ্যান বলছে, গত ৬ বছরে ৪০ হাজার কোটি টাকা লোকসান গুণেছে পিডিবি। আর আরেক দফা বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর তোড়জোড় চলছে। ইতোমধ্যে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব বিইআরসিতে দেয়া হয়েছে।
পিডিবির ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা গেছে বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র সামিট থেকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ ২০টাকা দরে কিনেছে পিডিবি। মেঘনা ঘাটে অবস্থিত এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে গত অর্থবছরে সবচেয়ে বেশী বিদ্যুৎ কেনা হয়েছে।
সূত্র জানায়, একই জ্বালানি উপকরণের কোনো কেন্দ্র ইউনিটপ্রতি বিদ্যুতের দাম ৩ টাকা। কোনো কেন্দ্রে আবার ১৬ টাকা। ইউনিটপ্রতি ২০ টাকাও পড়ছে ফার্নেস অয়েলভিত্তিক কোনো কোনো কেন্দ্রের বিদ্যুতের দাম। যদিও বেশি দামের এসব কেন্দ্র থেকেই বেশি বিদ্যুৎ কিনছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। এতে একদিকে পিডিবির ক্ষতি বাড়ছে, অন্যদিকে মূল্যবৃদ্ধির চাপ তৈরি হচ্ছে গ্রাহকের ওপর।

পিডিবির সর্বশেষ ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ফার্নেস অয়েলভিত্তিক ১৫টি বেসরকারি কেন্দ্রের প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ গড় দাম ১১ টাকা ৬৭ পয়সা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দাম সামিট মেঘনাঘাট পাওয়ার লিমিটেডের বিদ্যুৎ ইউনিট প্রতি ২০ টাকা ৪০ পয়সা। এ কেন্দ্র থেকেই গত অর্থবছর সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ কিনেছে পিডিবি।
সূত্র জানায়, সামিট থেকে ১০১ কোটি ৪৭ লাখ ১০ হাজার ১৩৫ কিলোওয়াট ঘণ্টা (ইউনিট) বিদ্যুতের বিপরীতে পিডিবি কোম্পানিটিকে পরিশোধ করেছে ২ হাজার ৬৯ কোটি ৭১ লাখ ৫৪ হাজার ৩৪৬ টাকা। অথচ একই জ্বালানিভিত্তিক ডরিন পাওয়ার জেনারেশন অ্যান্ড সিস্টেম লিমিটেড, ফেনীর প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ২ টাকা ৪৫ পয়সা হলেও কেন্দ্রটি থেকে কেনা হয়েছে ১৪ কোটি ৯২ লাখ ৭৩ হাজার ইউনিট।

আর ইউনিটপ্রতি ২ টাকা ৭৪ পয়সা মূল্যের ডরিন পাওয়ার জেনারেশন অ্যান্ড সিস্টেম লিমিটেড, টাঙ্গাইল থেকে গত অর্থবছর পিডিবি বিদ্যুৎ কিনেছে ১২ কোটি ৫০ লাখ ২১ হাজার ৭২ ইউনিট।
ফার্নেস অয়েলভিত্তিক অন্যান্য ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারের (আইপিপি) ক্ষেত্রেও একই চিত্র দেখা গেছে। বারাকা, ডিজিটাল পাওয়ার ও সিনহা পিপল এনার্জিসহ আরো কয়েকটি বেসরকারি কেন্দ্র থেকে ৭ থেকে সাড়ে ৭ টাকায় বিদ্যুৎ কেনার সুযোগ থাকলেও সেখান থেকে কেনা হয়েছে তুলনামূলক কম। যদিও স্বাভাবিক যুক্তি অনুযায়ী সাশ্রয়ী কেন্দ্র থেকে বেশি বিদ্যুৎ কেনার কথা।
পিডিবির সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ফার্নেস অয়েলভিত্তিক এনইপিসি বাংলাদেশ লিমিটেড, হরিপুর কেন্দ্রের প্রতি ইউনিটের দাম ছিল গত অর্থবছর ১৫ টাকা ৭২ পয়সা। এ কেন্দ্র থেকেই ওই অর্থবছর চতুর্থ সর্বোচ্চ ৩২ কোটি ৮৫ লাখ ৭ হাজার ৫০০ ইউনিট বিদ্যুৎ কেনে পিডিবি। এজন্য কোম্পানিটিকে পিডিবি পরিশোধ করে ৫১৬ কোটি ৫৩ লাখ ৩৯ হাজার টাকা।

ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বেশি দামের আরেক বিদ্যুৎ কেন্দ্র আরপিসিএল ৫২ মেগাওয়াট গাজীপুর কেন্দ্র থেকে গত অর্থবছর ২২ কোটি ৮৩ লাখ ২৫ হাজার ৫৭২ ইউনিট বিদ্যুৎ কেনে পিডিবি। যদিও এ কেন্দ্রটির বিদ্যুতের দামও তুলনামূলক বেশি প্রতি ইউনিট ১৪ টাকা ৫২ পয়সা।

এছাড়া রাজ লংকা পাওয়ার লিমিটেডের কাছ থেকে গত অর্থবছর প্রতি ইউনিট সাড়ে ১৬ টাকা দরে ১৮ কোটি ৫৭ লাখ ৯৬ হাজার ইউনিট বিদ্যুৎ কেনে পিডিবি। এর বিপরীতে কোম্পানিটিকে পরিশোধ করা হয় ৩০৬ কোটি ৬২ লাখ ৩২ হাজার টাকা। অথচ ২ টাকা ৪৫ পয়সা ও ২ টাকা ৭৪ পয়সা দরে ডরিন পাওয়ারের দুটি কেন্দ্র থেকে ২৮ কোটি ইউনিট বিদ্যুৎ ক্রয়ে খরচ হয়েছে মাত্র ৭০ কোটি ৮৯ লাখ টাকা।

বিদ্যুৎ বিভাগের নীতিগবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক প্রকৌশলী বিডি রহমত উল¬াহ বলেন, দরপত্র ছাড়াই ওয়ান টু ওয়ান পদ্ধতিতে বেসরকারি কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কেনা হয়। এর সঙ্গে সংশি¬ষ্ট কর্মকর্তাদের স্বার্থ জড়িত। এ কারণে কম দামে বিদ্যুৎ ক্রয়ের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও বেশি দামে কেনা হয়। জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে তাই দরপত্রের মাধ্যমে বেসরকারি খাত থেকে বিদ্যুৎ কেনা উচিত।

সূত্র জানায়, বর্তমানে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ১৫ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়েছে। দেশে মোট বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০৭টিতে। নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র যোগ হয়েছে ৭৪টি। এর মধ্যে বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র তথা আইপিপি ২৮টি। বিদ্যুৎ খাতের এসব অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক ক্ষতও বেড়েছে পিডিবির।

২০১০-১১ অর্থবছরে বেসরকারি কেন্দ্র থেকে বেশি দামে বিদ্যুৎ কেনা শুরু হয়। ওই অর্থবছরই লোকসানে পড়ে পিডিবি। পরবর্তীতে লোকসানের পরিমাণ বাড়তে থাকে। সর্বশেষ ২০১৫-১৬ অর্থবছরেও প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা লোকসান করে পিডিবি। গত ছয় বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত এ সংস্থা লোকসান গুনেছে ৪০ হাজার কোটি টাকার বেশি।

http://www.dailysangram.com/post/279803