১৪ এপ্রিল ২০১৭, শুক্রবার, ৯:১১

বাংলাদেশ সংস্কৃতির অতিত ও বর্তমান

আবুল আসাদ : বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বিবর্তনের স্বরূপ সন্ধানের আগে সংস্কৃতি বিষয়টির দিকে দৃষ্টিপাত করা প্রয়োজন। সংস্কৃতির স্বরূপ নিয়ে বিতর্ক অনেক আছে, কিন্তু আমাদের দেশে এটা বড় কোনো সমস্যা নয়। সংস্কৃতির মৌল প্রকৃতি নিয়ে বলা যায় আমাদের মাঝে দর্শনীয় ঐক্যই বর্তমান। ড. এনামুল হক ও শিব প্রসন্ন লাহিড়ী সম্পাদিত বাংলা একাডেমী প্রকাশিত ‘ব্যবহারিক বাংলা অভিধান’-এ সংস্কৃতির অর্থ বোঝাতে গিয়ে বলা হয়েছে ‘সংস্কার’, শুদ্ধিকরণ’, ‘অনুশীলন দ্বারা অর্জিত জ্ঞান’ এবং ‘বুদ্ধির উৎকর্ষ’। কোলকাতার কাজী আব্দুল ওদুদের ‘ব্যবহারিক শব্দ কোষ’-এ সংস্কৃতি শব্দের অর্থে বলা হয়েছে ‘সংস্কার’, ‘বিশুদ্ধিকরণ’, ‘চর্চা করিয়া বা সভ্যতার ফলে লব্ধ উৎকর্ষ’ ইত্যাদি। অভিধান দ্বয়ের সংজ্ঞার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। কিছুদিন আগে বাংলাদেশের সংস্কৃতির ওপর সুকান্ত একাডেমীর তত্ত্বাবধানে বাম বা বাঁকা বুদ্ধিজীবীদের একটা সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছিল। উক্ত সেমিনারের মূল প্রবন্ধ পাঠক নরেন বিশ্বাসও সংস্কৃতির অনুরূপ সংজ্ঞাই দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, সংস্কৃতির আভিধানিক অর্থ শিক্ষা বা অভ্যাস দ্বারা লব্ধ উৎকর্ষ বা কৃষ্টি। সম + কৃ + ক্তি-এ ব্যুৎপত্তির মধ্যেই নিহিত থাকে পরিশীলিত, পরিমার্জিত,পরিশ্রুত, নির্মলীকৃত, শোধিত এ ধরনের অনুভবসমূহ। ফলে উৎকর্ষময় বা পরিশ্রুত জীবন চেতনাই সংস্কৃতির সারাৎসার। এমন কি ধর্ম ও নৈতিকতার ধার ধারেন না এমন বুদ্ধিজীবী আহমদ শরীফ পর্যন্ত সংস্কৃতির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘সত্য, সুন্দর ও মঙ্গলের প্রতি মানুষের যে প্রবণতা, মানুষ সচেতন চেষ্টার দ্বারা যে সৌন্দর্যচেতনা, কল্যাণ-বুদ্ধি ও শোভন জগৎ দৃষ্টি অর্জন করতে চায়, তাকে হয়তো তার সংস্কৃতি বলে অভিহিত করা যায়। সংস্কৃতি হলো মানুষের অর্জিত আচরণ, পরিশ্রুত জীবন চেতনা। জীবিকা সম্পৃক্ত ও পরিবেষ্টনী প্রসূত হলেও প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি চিত্তেই এর উদ্ভব এবং বিকাশ, ব্যক্তি থেকে ক্রমে সমাজ এবং সমাজ থেকে বিশ্বে তা হয় পরিব্যাপ্ত। চিন্তায়, কর্মে ও আচরণে জীবনের সুন্দর, শোভন, পরিশীলিত ও পরিমার্জিত অভিব্যক্তিই সংস্কৃতি।” আর আবুল মনসুর আহমদ সংস্কৃতির বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন, “কালচার বা সংস্কৃতি মানুষের মন বিকাশের বিশেষ স্তরবোধক। তার মানে, কোনো সমাজ বা জাতির মনে কোনো এক ব্যাপারে একটা স্ট্যান্ডার্ড ব্যবহার বিধি মোটামুটি সর্বজনীন চরিত্র বা ক্যারেক্টার, আচরণ বা আখলাকের রূপ ধারণ করলেই সেটাকে ঐ ব্যাপারে ঐ মানব গোষ্ঠীর কালচার বলা হয়ে থাকে।” একটা বিষয় এখানে লক্ষণীয় যে, জনাব আবুল মনসুর আহমদ সংস্কৃতির যে সংজ্ঞা এখানে দিলেন তা পূর্ববর্তী উদ্ধৃতিগুলো থেকে দৃষ্টিভংগীগত দিক থেকে অনেকখানি আলাদা। নরেন বিশ্বাস ও আহমদ শরিফের উদ্ধৃতির মধ্যে সংস্কৃতির পরিশীলিত, পরিমার্জিত, পরিশ্রুত একটা চিন্তা ও কর্মরূপ আমরা পাই, কিন্তু সেখানে তা নির্দিষ্ট কোনো মূল্যমান বা স্ট্যান্ডার্ড নিয়ন্ত্রিত নয়। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এই স্টান্ডার্ডের বিষয়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই স্ট্যান্ডার্ডই সংস্কৃতির বহিরাঙ্গ বা সীমানা নির্ধারণ করে এবং জাতিতে জাতিতে যে সাংস্কৃতিক বিভিন্নতা, ভিন্ন যে স্বকীয়তা, তারও মূল কারণ এই স্ট্যান্ডার্ড। সংস্কৃতির এই সংজ্ঞায়নের ক্ষেত্রে আরেকটি জিনিসও এখানে পরিষ্কার হয়ে যাওয়া দরকার। সেটা হলো, সংস্কৃতির এই যে স্ট্যান্ডার্ড তারও কিছু নিয়ামক আছে যা সংস্কৃতির প্রাণবস্তু বা মৌলিক উপাদান হিসেবে চিহ্নিত হয়। প্রকৃতই মৌলিক উপাদান সমন্বিত প্রাণবস্তু ছাড়া সংস্কৃতির অস্তিত্বই কল্পনা করা যায় না। কায়াহীন কাজ যেমন সম্ভব নয়, তেমনি পরিশীলন, পরিমার্জন ও পরিশ্রুতির ব্যাপারটা বর্ণ পরিচয়হীন হতে পারে না। এগুলো নির্দিষ্ট চরিত্র অনুসরণ করেই চলে। বিভিন্ন জাতির সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যের কারণ এখানেই। কিছু পরিচিত ভিত্তির উদাহরণ আমরা এখানে তুলে ধরতে পারি। বস্তুবাদ ও দ্বন্দ্বিকতা কম্যুনিস্ট সংস্কৃতির ভিত্তি। বস্তুবাদ ও খ্রিস্টান বিশ্বাস পুঁজিবাদী পশ্চিমী সংস্কৃতির ভিত্তি। রামায়ন, মহাভারত, বেদ ও উপনিষদীয় দর্শন ভারতের আর্য সংস্কৃতির ভিত্তি। কিন্তু এ সবই স্থ’ূল অর্থে। সংস্কৃতির মৌল উপাদানগুলো এ সংক্ষিপ্ত কথাগুলোর মধ্য দিয়ে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে না। যে বস্তুটিকে সংস্কৃতি বলে অভিহিত করা হয় তা গঠিত হয় পাঁচটি মৌলনীতি বা দৃষ্টিভংগী দ্বারা। এই পাঁচটি মৌল নীতির প্রথম হলো, দুনিয়ার জীবন সম্পর্কে ধারণা, দ্বিতীয়, জীবনের চরম লক্ষ্য, তৃতীয়, বুনিয়াদি আকিদা ও চিন্তাধারা, চতুর্থ ব্যক্তি প্রশিক্ষণ এবং পঞ্চম হলো সমাজব্যবস্থা। এই বিষয়গুলো সম্মিলিতভাবে একটা জাতীয় মূল্যমান বা স্ট্যান্ডার্ডের জন্ম দেয় যা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে বা সৃষ্টি করে সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকা-।


সংস্কৃতি বিষয়টার সাথে এই অন্তরঙ্গতার পর যেদিকে আমাদের নজর দিতে হয় সেটা হলো শিরোনামের বাংলাদেশ। বাংলাদেশ আমাদের প্রিয় রাষ্ট্রভূমির নাম। এর জন্ম ১৯৭১ সালে। খুব বেশি এগুলে ব্রিটিশ যুগে কিংবা তারও আগে মোগল বা সুলতানি যুগে বাংলা নামের সন্ধান খুব ভালোভাবেই পাই। কিন্তু সেই ‘বাংলা’ এবং আমাদের আজকের বাংলাদেশের চেহারা এক নয়। ইতিহাসে কোনো সময়ই আমাদের বাংলাদেশ ‘বাংলাদেশ’ ছিল না। খ্রিস্টীয় তৃতীয় চতুর্থ শতক থেকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রিক সত্তার ভাঙা-গড়া শুরু। ভারতের গুপ্ত শাসনের সমসাময়িক বাংলাদেশের নায়করা কারা তাদের সকলের নাম ইতিহাস বলতে অক্ষম, তবে এক বিষয়ে ইতিহাস একমত। তখনকার টুকরো টুকরো সেই বাংলাদেশে কোনো সময়ই একক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এমন কি বাংলায় প্রবল পরাক্রান্ত হিন্দু শাসক শশাংকের পক্ষে দক্ষিণ ও পূর্ববংগে পা রাখা সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশ তখন অঙ্গ, বঙ্গ, সূক্ষ্ম, পুন্ড্র, রাঢ়, সমতট, হরিকেল প্রভৃতি শতনামে শত খন্ডে বিভক্ত ছিল। গোটা পাল শাসন আমলে দক্ষিণ ও পূর্ববঙ্গ দেববংশ, হরিকেল রাজবংশ, চন্দ্র বংশ, বর্মন বংশ প্রভৃতি অনেক রাজবংশ দ্বারা ভিন্ন ভিন্নভাবে শাসিত হয়েছে। বাংলার মুসলিম শাসনামলে অবস্থার অনেক উন্নতি ঘটলেও বাংলায় কোনো সংঘাতমুক্ত একক রাজনৈতিক সত্তা গড়ে ওঠেনি। ব্রিটিশ আমলেই এর প্রথম প্রকাশ ঘটে।


বাংলাদেশের রাষ্ট্রিক সত্তার মত তার সাংস্কৃতিক সত্তাও বিভেদ ও সংঘাতপূর্ণ বিবর্তনে জর্জরিত হয়েছে। এই সংঘাতের শুরু বাংলাদেশের জানা ইতিহাসের শুরু থেকেই। শুরুর এই স্বারূপটাকে আমরা ভারতব্যাপি দ্রাবিড়, আর্য বা আদিবাসি আর্য সংঘাতের প্রলম্বিত রূপ হিসেবে অভিহিত করতে পারি।


আর্যদের আগ্রাসি আধিপত্যবাদ দ্রাবিড় আদিবাসিদের দেশছাড়া করে ঠেলে দিয়েছিল দক্ষিণ দিকে লংকা পর্যন্ত। আর পূর্বদিকে গভীর বন ও নদী জড়াজড়ি করে থাকা বাংলার দুর্গম প্রান্তর পর্যন্ত। পালিয়ে এসেও তারা কিন্তু বাঁচেনি। বাংলার জংগলঘেরা শান্ত নদীর তীরে নতুন নীড় গড়ে বাংলার এ দরিদ্র মানুষেরা ভেবেছিল আর কিছু না হোক তারা তাদের বিশ্বাস ও সংস্কৃতি নিয়ে শান্তিতে বাস করতে পারবে। কিন্তু রাজনৈতিক আধিপত্যের কাঁধে ভর করে আর্য সংস্কৃতির নিষ্ঠুর সয়লাব এসে গ্রাস করে তাদেরকে। ভারতে বৌদ্ধ মৌর্য যুগের পতনের পর ৩৩০ খ্রিস্টাব্দে গুপ্ত যুগের সূচনা ঘটে। পরবর্তী ৪২০ বছর বাংলার মানুষের এক চরম দুর্ভাগ্যের কাল। অহিংস ও শান্তিবাদী বৌদ্ধ ধর্ম এবং নিরীহ দ্রাবিড়ীয় জীবন চর্চা যে শাস্ত্র ও সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের সৃষ্টি করে তা আর্যদের কর্মবাদী ও নিপীড়নমূলক সংস্কৃতির আগ্রাসনে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বিশেষ করে সপ্তদশ শতকের প্রথমার্ধে বাংলায় হিন্দু রাজ শশাংকের শাসনকালে বৌদ্ধ সমাজ সংস্কৃতি ধ্বংসের সম্মুখীন হয়। বৃষ্টি¯œাত সুজলা সুফলা নদী বিধৌত পলিমাটির বাংলাদেশের শান্ত ও কোমল হৃদয়ের মানুষগুলো শুরু থেকেই অধ্যাত্মবাদী ও মানবিক দর্শন ও সংস্কৃতির অনুসারী যার সাথে কর্মবাদী আর্য ধর্ম ও সংস্কৃতির সংঘাত অত্যন্ত মৌলিক। এই সংঘাতে নিষ্পিষ্ট ও জর্জরিত হয় বাংলার মানুষ।


৭৫০ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় বৌদ্ধ পাল বংশের শাসন শুরু হবার পর বাংলার মানুষ কিছুটা হাফ ছেড়ে বাঁচে। বৌদ্ধ শাসনের অধীনে বাংলার বৌদ্ধ সমাজ-সংস্কৃতি আবার মাথা তুলে নবজীবন লাভ করে। কিন্তু এরপরও বাংলায় সাংস্কৃতিক সংঘাতের তিনটি ধারা বাংলার সাধারণ জনজীবনকে বিপর্যস্ত করেই চলে। ৩২৫ বছরের পাল শাসনে সমাজের বৌদ্ধ আভিজাতরা ভালই ছিল। কিন্তু পেশা-কর্মবাদী নিপীড়ন থেকে তারা বাংলার সাধারণ মানুষকে মুক্তি দিতে পারেনি। হিন্দু সামন্তরা তখনও ছিল প্রভাবশীল। তাদের সহায়তায় দিবয়ার কৈবর্ত বিদ্রোহের মাধ্যমে উত্তর বঙ্গে হিন্দু শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা একবার হয়। বর্ণবাদী ধর্ম-সংস্কৃতির প্রতিভূ সামন্ত শ্রেণীর শোষণে বাংলার সাধারণ মানুষ সীমাহীন দুর্ভোগের শিকার হয়। সেই সময়ের এক কবির কথায়: “নিরানন্দে তার দেহ সমুন্নত ও শীর্ষ, পরিধানে জীর্ণ বস্ত্র। ক্ষুধায় চোখ ও পেট বসে গিয়েছে শিশুদের, তারা ব্যাকুল হয়ে খাবার চাইছে। দীন-দরিদ্র গৃহিণী চোখের জলে গাল ভাসিয়ে প্রার্থনা করছে যেন এক মান ও তন্দুলে একশ দিন চলে।” এই নিপীড়ন ছিল অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাংস্কৃতিক উদ্দেশ্যজাত। গোবিন্দ চন্দ্রের ময়নামতি প্লেটে স্বামীহারা ম্লেচ্ছ নারীদের বিলাপের এক ধর্মস্পর্শী চিত্র পাওয়া যায়। উক্ত প্লেটের সপ্তম শ্লোকের মূল কথা এই: “কল্যাণ চন্দ্রের হাতে এত ম্লেচ্ছ পুরুষ মারা গিয়েছিল যে, স্বামীহারা ম্লেচ্ছ নারীদের চোখের পানিতে লোহিতরা (ব্রহ্মপুত্র) নদীর পানি চার গুণ বেড়ে গিয়েছিল”। গণ পর্যায়ের এই নিপীড়ন নির্যাতন বৌদ্ধ পাল রাজাদের শাসনে অবসান না ঘটলেও এ সময় বৌদ্ধ ধর্ম সংস্কৃতির তথা বাংলার ভাষা সাহিত্যের নতুন বিকাশ ঘটেছিল। কিন্তু একটি দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো আর্য আধিপত্যের ৪২০ বছরে বাংলা ভাষা যে অবহেলার শিকার হয়, তার ফলে বাংলা ভাষায় কিছু সংস্কৃত শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটলেও বাংলা ভাষা ধ্বংস হয়ে যায়নি সত্য, কিন্তু শাসক বা অভিজাত সমাজের চত্বর থেকে বাংলা ভাষা বিতাড়িত হয়েছিল। পাল আমলের তিনশ বছরেও বাংলা ভাষা এ অধিকার ফিরে পায়নি। পাল আমলের চর্যাপদ, বৌদ্ধগান ও দোহার মত গীতিকবিতার অনেকগুলোতে আমরা সুস্পষ্ট বাংলার দেখা পাই, কিন্তু পাল আমলের বিখ্যাত কবিগণ যেমন হরিচরিত রচয়িতা চতুর্ভুজ, রামচরিত প্রণেতা মালাকার নন্দী এবং বীরদের সকলেই সংস্কৃত ভাষায় কাব্য চর্চা করেছেন। অর্থাৎ আর্য সংস্কৃতির বিরুদ্ধে ভীষণ বিপ্লবের আকার নিয়ে বৌদ্ধ এবং স্বদেশীয় পাল শাসনের পত্তন হলেও পাল রাজারা বর্ণবাদী আর্য সাংস্কৃতির নিপীড়ন থেকে সাধারণ জনগণকে মুক্ত করতে পারেননি, তেমনি রাজসভা ও সাহিত্যেও বাংলাভাষার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। বলা যায়, পাল রাজারা তাদের ৩২৫ বছরের শাসনে সমাজের উচ্চ স্তরে বৌদ্ধ সমাজ-সংস্কৃতির উজ্জীবন ঘটাতে পারলেও সেখান থেকে আর্য ভাষার মূলোচ্ছেদ ঘটাতে পারেননি, আর সাধারণভাবে জনগণের পর্যায়ে আর্য সংস্কৃতির আধিপত্যের কাছে পরাজয়ই বরণ করেছে।


সুতরাং ১০৯৭ সালে যখন বৌদ্ধ পাল রাজাদের অবক্ষয়ের পটভূমিতে ভারতের কর্নাট থেকে আসা হিন্দু সেন রাজাদের উত্থান ঘটল বাংলার শাসন মঞ্চে, তখন বাংলার বৌদ্ধ ও ভক্তিবাদী দ্রাবীড়ীয় জনগণের সাহিত্য সংস্কৃতির ওপর আপতিত অন্ধকার দ্রুত ঘনীভূত হয়ে উঠল, সৃষ্টি করল প্রবল এক অমানিশা। আগেই বলেছি, এই অমানিশার শুরু ভারতের কেন্দ্রীয় বৌদ্ধ রাজশক্তির পতন এবং তৃতীয় শতকে হিন্দু গুপ্ত রাজশক্তির উত্থানের কাল থেকে। এরপর বাংলার বৌদ্ধ পাল শাসন পর্যন্ত দীর্ঘ ৪২০ বছরে বর্ণবাদী আর্য সংস্কৃতির হৃদয়হীন আধিপত্যে বাংলার বৌদ্ধ ও দ্রাবীড়ীয় জীবন সংস্কৃতি নিষ্পিষ্ট হয়। আশা ছিল বৌদ্ধ পাল রাজাদের আমলে এর অবসান ঘটবে, কিন্তু ঘটেনি। এর কারণ হিসেবে ইতিহাস বলে, ধর্মপাল গৌড়ের রাজা নির্বাচিত হবার পূর্বে উড়িষ্যা ও বংগদেশে পাঁচটি পৃথক রাজ্য ছিল যার রাজা ছিলেন আর্য সমাজের ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য। বৌদ্ধরাজ ধর্মপাল এদের সকলের ওপর রাজা হয়ে বসলেও এদের আর্য সমাজ বন্ধন, আচার ও সংস্কৃতিকে অবহেলা করে বৌদ্ধ সংস্কৃতি সার্বিকভাবে পুনর্জ্জীবিত করার সামর্থ তার ছিল না। কারণ প্রদেশগুলোর শাসন তখনও ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য রাজাদের হাতেই ছিল। এদের গায়ে হাত দেয়া যে বিপজ্জনক ছিল মহিপালের আমলের দিবয়ার কৈবর্ত বিদ্রোহ তার একটা প্রমাণ। বৌদ্ধ পাল রাজাদের এই সাংস্কৃতিক ব্যর্থতার আরেকটা বড় কারণ ছিল দীর্ঘ ৪২০ বছরের আর্য শাসনে বৌদ্ধদের জীবন সংস্কৃতিও অনেকখানি পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল। তারা তাদের প্রাচীন সংস্কৃতি ছেড়ে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অনকরণে নিজেদের গড়ে নেবার চেষ্টা করছিল। বৌদ্ধ জীবন সংস্কৃতিতে মহাযান পন্থার আবির্ভাব বৌদ্ধ ধর্মকে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের কাছাকাছি নিয়ে যায়। বৌদ্ধ ধর্মে দেবতা না থাকলেও স্বয়ং বুদ্ধ দেবতার আসন পেয়ে যায় এবং বৌদ্ধ সমাজেও শুরু হয়ে যায় পূজা অর্চনা। ব্রাহ্মণ ধর্মের সাথে তাদের পার্থক্য রইল শুধু দেবতা নির্বাচন ও পূজার পদ্ধতিতে। বৌদ্ধ সমাজে এই অবস্থা সাংস্কৃতিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি করে। একদিকে তাদের ছিল বর্ণবাদী আর্য সংস্কৃতির বিরুদ্ধে অদম্য প্রতিরোধ স্পৃহা, অন্যদিকে আর্য দেবতাদের মোকাবিলায় নিজেদের জন্যে স্বতন্ত্র সহায় খোঁজার স্বাভাবিক মানসিকতা। এর ফলেই সৃষ্টি হয় মনসাদেবী, বরুণ দেব, শীতলা দেবী প্রভৃতি অনেক দেব-দেবীর যারা আর্য দেবতা দেবী থেকে সম্পূর্ণই ভিন্ন। ব্রাহ্মণ্যবাদী শোষণ নিপীড়নে নিস্পিষ্ট বাংলার অসহায় জনশ্রেণী শক্তি, সাহস, মুক্তি ও মদদের জন্যে এদের কাছেই আশ্রয় খুঁজত। ইতিহাস বলে, ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রভাব বাংলার দুর্জয় দ্রাবিড় ও মাদল জনশ্রেণীর এমন পরিণতি ঘটায় যে প্রাকৃতিক প্রতিকুলতা দমন করার উপায়ও তারা চিন্তা করতে পারেনি। বুদ্ধির জড়তার জন্যে তারা দেবতা, উপদেবতা ও রাক্ষসের অনুগ্রহ ও নগ্রহ ছাড়া প্রকৃতিতে আর কিছুই দেখেনি। তারা প্রাকৃতিক ও অপ্রাকৃতিক নানা শক্তি, জীব ও বস্তুকে পুজা করে তাদের অনুগ্রহ লাভের চেষ্টা করেছে। কিন্তু কখনই আত্মশক্তিতে প্রকৃতিকে জয় করে প্রকৃতির ওপর মানুষের বিজয় পতাকা উড্ডীন করার কথা কল্পনায়ও আনতে পারেনি।


বাংলার মানুষের এই সাংস্কৃতিক বন্দীদশা হিন্দু সেন রাজাদের ১২৬ বছরের শাসনে আরও মর্মান্তিক আকার ধারণ করে। সেন রাজাদের আমলে বাংলার জনসমাজের অবক্ষয়মুখী পরিবর্তন আরও প্রকট রূপ নেয়। এ সময়ে বর্ণবাদী ব্রাহ্মণ্য অভিজাত শ্রেণীর প্রতিপত্তি পরাক্রম আরও বৃদ্ধি পায়। একজন সাংস্কৃতিক ইতিহাস সন্ধানী এ সময়ের ভয়াবহ চিত্র আঁকতে গিয়ে বলেছেন, “এমন এক পরাক্রান্ত ও দুর্নীতিপূর্ণ সামন্ততন্ত্র জন্মলাভ করে, যার ফলে পূর্বতন সাহিত্য সংস্কৃতির বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয় এবং সমাজে দুর্নীতি, ব্যভিচার ও শোষণ নির্যাতন তীব্রতা লাভ করে। ‘কেলি-কলা কুতূহল’ই তখনকার সংস্কৃতির মূল উপাদানে পর্যবসিত হয়। এই পর্বের ধর্মে, সাহিত্যে, ভাস্কর্যে, সংগীতে, কাব্যে তাই কোনো মহৎ ও বৃহতের আকাক্সক্ষা নেই, আছে এক গভীর অবক্ষয়। সামন্ত শ্রেণী এ পর্বে জনগণ থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন এবং সামন্ত সংস্কৃতিও তখন প্রাণহীন।” সামন্ত শক্তি ও সংস্কৃতি তখন প্রাণহীন ছিল বলেই বাংলার সেন রাজা লক্ষণ সেন মুসলিম সৈন্যের আগমনের কথা শুনে একে দেবতা নির্ধারিত ভাগ্যলিপি মনে করে বিনা প্রতিরোধে খিড়কির দরজা দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন।


বাংলার এই ঘোর দুর্দিনে ঘোর অমানিশায় মুক্তির সূর্য হিসেবে বাংলাদেশে ইসলামের আবির্ভাব ঘটে দরবেশ ও মিশনারীদের মাধ্যমে। এদের পথ ধরেই ১২০৩ সালে মুসলিম বিজয়ের আকারে বাংলায় ইসলামি সংস্কৃতির আগমন ঘটে। নতুন মুসলিম বাংলায় বাংলা সাহিত্যের নবজন্ম সম্পর্কে দীনেশচন্দ্র সেন বলেছেন, “ব্রাহ্মণগণ প্রথমত ভাষাগ্রন্থ প্রচারের বিরোধী ছিলেন, কৃত্তিবাস ও কাশীদাসকে ইহারা ‘সর্বনেশে’ উপাধি প্রদান করিয়াছিলেন এবং অষ্টাদশ পুরাণ অনুবাদকগনের জন্যে ইহারা রৌরব নামক নরকে স্থান নির্ধারিত করিয়াছিলেন। এদিকে গৌড়েশ্বরগণের সভায় সংস্কৃত পুরাণ পাঠ ও ললিত লবঙ্গলতা পরিশীলন কোমল মলয় সমীরণ-এর ন্যায় পদাবলি প্রতিনিয়ত প্রতিধ্বনিত হইত। এই সমৃদ্ধ সভাগৃহে বঙ্গভাষা কি প্রকারে প্রবেশ করিল? আমাদের বিশ্বাস, মুসলমান কর্তৃক বঙ্গ বিজয়ই বঙ্গভাষার এই সৌভাগ্যের কারণ হইয়া দাঁড়াইয়াছিল।”


কিন্তু এই সৌভাগ্য শুধু বংঙ্গভাষারই নয়, ইসলামের সমাজ সংস্কৃতি গোটা বঙ্গবাসীর জন্যে ও বয়ে এনেছিল মহা সৌভাগ্য। গুপ্ত যুগের সেই ৩৩০ খ্রিস্টাব্দ থেকে দীর্ঘ ৮৯৩ বছরের এক ভয়াল অন্ধকার যুগ ধরে বাংলার নির্যাতিত, নিপীড়িত অসহায় জনগোষ্ঠী যেন আকুলভাবে এই মহাসৌভাগ্যেরই সন্ধান করে এসেছে। সেই সন্ধান যখন তারা পেলো, তখন যেন পাগলের মতই তাকে দু’হাতে বুকে জড়িয়ে ধরল। ইসলাম প্রবেশ করল বাংলার হৃদয়ের অন্তস্থলে, ছড়িয়ে পড়ল বাংলার গ্রাম-গ্রামান্তর সর্বত্র। স্যার উইলিয়াম হান্টার তার ঞযব ওহফরধহ গঁংধষসধহং গ্রন্থে লিখেছেন, “অহংকারী আর্যদের দ্বারা নিগৃহীত, পদদলিত বাংলার আদিবাসী ও নি¤œবর্ণের মানুষ দু’হাত বাড়িয়ে ইসলাম প্রচারকদের বুকে জড়িয়ে ধরেছিল। এই দরিদ্র লোকদের কাছে ইসলাম যেন ছিল এক পরম স্বর্গীয় সওগাত।” উইলিয়াম হান্টার এই বিষয়টিকে আরও বিস্তৃত করে তার ঞযব ওহফরধহ গঁংধষসধহং গ্রন্থে এইভাবে বলেছেন, “এই অঞ্চলের (বাংলাদেশের) জলাভূমি ও নদীবহুল জেলাগুলোর আদি বাসিন্দাদেরকে কখনো ভদ্র সমাজে স্থান দেয়া হয়নি। তাদের কোনো সামাজিক মর্যাদা ছিল না। তারা এতদূর অচ্ছুত যে, উচ্চ কোনো ব্রাহ্মণ সে অঞ্চলে গিয়ে তাদের ছোঁয়া বাঁচিয়ে বাস করতে পারেন না। মুসলমানদের এসব বর্ণ বৈষম্যের বালাই ছিল না। মুসলমানরা যেখানেই গেছে ধর্ম প্রচার করেছে। কতকটা তলোয়ারের জোরে, কিন্ত বেশির ভাগ মানুষেরই হৃদয়ের কোমলতম দু’টো তন্ত্রীতে সজোরে আঘাত করে। হিন্দুরা এই বদ্বীপের বাসিন্দাদেরকে কখনো তাদের সমাজে স্থান দেয়নি। মুসলমানরা ব্রাহ্মণ ও নি¤œজাতি নির্বিশেষে ইসলামের পূর্ণ অধিকার সবাইকে সমানভাবে দান করেছিল। তাদের উৎসাহী ধর্মপ্রাচারকরা এই শিক্ষা দিয়েছিল “তোমরা সকলেই তোমাদের আল্লাহর কাছে নতজানু। তার দৃষ্টিতে সবাই সমান, সব সৃষ্টি জীব ধরার ধুলার মতই। এক আল্লাহ্ ছাড়া আর প্রভু নেই এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর রসূল।


এভাবেই ইসলাম ব্রাহ্মণবাদী সংস্কৃতির নিপীড়ন নিগড়ে বন্দী বাংলার মানুষকে মুক্ত করল। ৫৬২ বছর পর্যন্ত বাংলার মুসলিম শাসনামলে মুসলিম শাসকগণ ইসলামি সমাজ সংস্কৃতির পূর্ণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেননি এ কথা সত্য, কিন্তু এরপরেও এই সময়েই মুসলমানদের ধর্ম ও সংস্কৃতি বাংলার মন ও মাটির সাথে এক হয়ে যায়, ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির শোষণ শাসন বন্ধ হয়ে যায়। এমন কি ইসলামি ধর্ম সংস্কৃতি ব্রাহ্মণ্য ধর্ম সংস্কৃতিকেও বিপুলভাবে প্রভাবিত করে। হিন্দু ধর্মকে জাত-পাত থেকে মুক্ত করে তাকে বাঁচানোর চেষ্টা অনেকেই করেন। মুসলিম যুগে শ্রীচৈতন্যের প্রচেষ্টা এবং রাম মোহন রায়দের প্রয়াস এরই দৃষ্টান্ত। বাংলাদেশে ইসলামের আগমন বাংলার মানুষকে যেমন, তেমনি বাংলা ভাষা সাহিত্যকেও যে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচায় তা ড. দীনেশচন্দ্র সেনের স্বীকারোক্তি থেকে আগেই আমরা জেনেছি। বাংলার মুসলিম জীবন ও সংস্কৃতি চর্চ্চা বাংলা ভাষাকে নতুন জীবন ও নতুন ধারা দান করে। শেষ পর্যায়ে নয়শ’ বছরের ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির শাসনে রাষ্ট্র ও অভিজাত পর্যায়ে সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃতি চালুর চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু গণ পর্যায়ে তার কোনো প্রভাব ছিল না। সেখানে বাংলা ভাষারই চর্চা হতো। পাল ও সেন যুগের প্রাম্য গীতিকাগুলোই তার প্রমাণ। কিন্তু মুসলিম আমলে ইসলামী সংস্কৃতির ধারক হয়ে আসা আরবি ফারসি ভাষার শব্দমালা বাংলায় রূপান্তর লাভ করে মানুষের মুখের ভাষা হয়ে যায় যা বাংলা ভাষাকে নতুন বলে বলিয়ান করে সৃষ্টি করে বাংলাদেশে এক সমৃদ্ধ গণসাহিত্য। বাংলার এই গণসাহিত্যই আমাদের পুঁথি সাহিত্য যার সংখ্যা ৮ হাজারেরও বেশি। বাংলার এই সময়ের নগর সাহিত্য সংখ্যার দিক দিয়ে এত সমৃদ্ধ নয়। এর থেকে প্রমাণ হয় ইসলামি জীবন ও সংস্কৃতি বাংলার গ্রামাঞ্চলে আদৃত হয়েছিল সবচেয়ে বেশি। এর উল্টোটা ঘটেছিল বাংলার ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির ক্ষেত্রে। ঐ ৯শ’ বছরের শাসন ও ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি শহর পেরিয়ে গ্রামবাংলার জনমনে প্রবেশ করতে পারেনি।


ব্রিটিশ শাসনামলে গোটা ১৯০ বছরই ব্রিটিশ শাসন ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে মুসলমানদের অবিরাম লড়াইয়ের কাল। এই সুযোগে হিন্দুরা তাদের নতুন মনিব ব্রিটিশের মিত্র বনে যায় এবং নতুন মনিবের সহায়তায় ব্রাহ্মণ্য জাতীয়তা ও সংস্কৃতি নতুনভাবে বিন্যস্ত ও বিকশিত হবার সুযোগ লাভ করে। মোগল আমলে শিবাজী হিন্দুদের জাতীয় জাগরণের যে সূত্রপাত ঘটায়, ব্রিটিশ আমলে তা বাল গঙ্গাধর তিলক, লালা লাজপত রায়, বিপিন চন্দ্র পালদের বিভিন্ন সংস্থা সংগঠন ও হিন্দু কংগ্রেসের মাধ্যমে দুরন্ত গতি লাভ করে। তাদের মধ্যে আবার ফিরে আসে গুপ্ত, পাল ও সেন যুগীয় সেই সর্বগ্রাসী চরিত্র। তারা যেমন করে বৌদ্ধসহ সব সংস্কৃতিকেই গ্রাস করেছিল, তেমনি করে চাইল ইসলামি সংস্কৃতিকেও হজম করতে। তারা বলল, ভারত শুধু ভারতীয় জাতি এবং ভারতীয় সংস্কৃতির জন্যেই। সুতরাং মুসলমানদেরকে ভারতীয় সংস্কৃতি অর্থাৎ হিন্দু সংস্কৃতির আচরণই রপ্ত করতে হবে যদি তারা ভারতে থাকতে চায়। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্যে ভারতীয় হিন্দুরা এক ভারত রাষ্ট্র গঠনের তীব্র লড়াইয়ে রত হলো।
এ অবস্থায় আত্মরক্ষার জন্যে ভারতীয় মুসলমানদেরকে একই সাথে দুই শত্রু, ব্রিটিশ ও ভারতীয় হিন্দু, এর বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে হলো। তাদেরকে প্রমাণ করতে হলো, তারা শিক্ষ, বিশ্বাস, আচরণ, ঐতিহ্য, সভ্যতা, ইতিহাস অর্থাৎ সার্বিক জীবন ও সংস্কৃতির দিক থেকে মুসলমানরা পৃথক জাতি। এ সাংস্কৃতিক লড়াইকে এগিয়ে নেবার জন্যে তৈরি হলো রাজনৈতিক প্লাটফরম বা মুসলিম স্বার্থ দেখার জন্যে একটা রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগ। লড়াইয়ে অবশেষে জয় হলো। ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হলো মুসলিম জাতি-সংস্কৃতির প্রথক আবাসভূমি হিসেবে এক পৃথক রাষ্ট্র, আর হিন্দু জাতি সংস্কৃতির আবাসভূমি হিসেবে সৃষ্টি হয়েছে আলাদা রাষ্ট্র। সেই আলাদা মুসলিম রাষ্ট্রেরই পূর্বাঞ্চল আজকের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালে এক রক্তাক্ত সংগ্রামের মাধ্যমে এ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটেছে।


ব্রিটিশ আমলের সাংস্কৃতিক লড়াই এবং তার ফলে মুসলিম সাংস্কৃতিক আবাসভূমি হিসেবে পৃথক রাষ্ট্র থেকে এই বাংলাদেশের সৃষ্টি বাংলার সংস্কৃতিক সংঘাত ও বিবর্তনের ইতিহাসে এক মহা উল্লেখযোগ্য ঘটনা। অতীতে সাংস্কৃতিক বিবর্তন পরিবর্তন অনেক এনেছে, কিন্তু তা এসেছে রাজনৈতিক রাজ্য স্থাপনের পথ ধরে। নিরেট ধর্ম ও সাংস্কৃতিক কারণে দেশ বিভাগ বা দেশ গঠন ইতিহাসে এই প্রথম। এর সুফল এই হয়েছে যে, আমাদের ইসলামি সংস্কৃতি এবং প্রতিদ্বন্দ্বী সংস্কৃতিগুলো সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত হয়েছে।


এর আরও একটা বড় সুফল এই যে, আমাদের আত্ম পরিচয় এর আগে এমন সুস্পষ্টভাবে আমাদের সামনে আসেনি। কিন্তু এর দু’টো প্রতিক্রিয়া আছে। একটি হলো আন্তঃসংস্কৃতি সংঘাত, প্রতিদ্বন্দ্বী সংস্কৃতির সংঘাত দুই রাষ্ট্র গঠন করে শেষ হয়ে যায়নি, বরং প্রতিদ্বন্দ্বিতা নতুন রূপ পরিগ্রহ করছে। বিশেষ করে ভারতে প্রতিদ্বন্দ্বীর সংস্কৃতি আগ্রাসী রূপ নিয়ে মাথা তুলছে। দ্বিতীয় প্রতিক্রিয়া হলো, ব্রিটিশ আমলে সাংস্কৃতিক সংঘাত যে চূড়ান্ত রূপ লাভ করে, সেই সাংস্কৃতিক সচেতনতায় একটা ক্লান্তি বা সব পাওয়াজনিত একটি অবসাদ বা অবসন্নতা নামে পৃথক আবাস ভূমি পাওয়ার পর। দুর্ভাগ্যের বিষয় সেটা আমাদের অনেকের চিন্তা ও মননকে গ্রাস করে ফেলেছে। এমনকি অনেকে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ধর্মীয় ও ঐতিহ্যগত ভূমিকা অস্বীকার করে আজ চরম সেকুলার সাজতে চাচ্ছেন। এটা মারাত্মক ধরনের ভ্রান্তি ও বিপথগামিতা। বিশেষ করে প্রতিদ্বন্দ্বী সংস্কৃতির আগ্রাসী উত্থানের মুখে একে এক উৎকট উদ্বেগের বিষয়ই বলতে হবে। এই সাংস্কৃতিক বিপথগামিতা চলতে দিলে, বাড়তে দিলে ব্রিটিশ যুগে যে বিজয় আমরা লাভ করেছি, সামনের সাংস্কৃতিক সংঘাতে তা পরাজয়ে পরিণত হবে। বাংলার সাংস্কৃতিক সংঘাত ও বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় আরেকটি নতুন সংঘাত আসন্ন যার মঞ্চ ইতিমধ্যেই আমরা তৈরি দেখছি। বিবর্তনের এই পর্যায়ে নতুন সাংস্কৃতিক সংঘাত ইসলামি সংস্কৃতি ও ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির সাথে সেক্যুলার সংস্কৃতিও যোগ হতে যাচ্ছে। তবে আমাদের দেশে সেক্যুলার সংস্কৃতি ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতিকে সহায়তা দান করারই একটা প্লাটফরম। পহেলা বৈশাখে সকলের উপর মঙ্গল শোভাযাত্রা চালিয়ে দেয়া সে ধরনেরই সহায়তা কি না, এর উদ্যোক্তাসহ সকলকেই তা ভাবতে হবে। অনুধাবন করতে হবে সাংস্কৃতিক সংঘাত রাজনৈতিক সংঘাতের চেয়ে অনেক বেশি জটিল ও সুদূরপ্রসারী।

http://www.dailysangram.com/post/279789