১৩ এপ্রিল ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১১:০৩

বৈশাখ : ধর্ম ও সংস্কৃতি ভাবনা

আমরা সাদাকে সাদা দেখি, কালোকে দেখি কালো। তারপরেও আমরা সাদাকে সাদা এবং কালোকে কালো বলতে পারি না। এখানে রয়েছে আমাদের মেরুদ-ের সমস্যা। কোনো জাতির নৈতিক মেরুদ- শক্ত না হলে শুধু বচন-প্রবচন কিংবা কথামালায় কাক্সিক্ষত সমৃদ্ধি ও প্রগতি সম্পন্ন হতে পারে না। আজকাল যেন আমাদের বিবেচনা শক্তিও রহিত হয়ে গেছে। কোনো জিনিসের পুরোটা দেখার মত ধৈর্য্য আমাদের নেই। অর্ধসত্য নিয়েই আমাদের যত উল্লম্ফন। অল্প জ্ঞানের ভয়ঙ্কর সব চিত্র আমরা লক্ষ্য করছি। এ বিষয়গুলো এখন আমাদের সমাজের জন্য মূল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, আইন-কানুন, প্রশাসন, ধর্ম-দর্শন কোনো কিছুই এখন ওই সমস্যার বাইরে নয়। অথচ এ সমস্যার সমাধান সম্ভব। তবে এজন্য প্রয়োজন সুস্থ ও উদার মনোভাব।

বৈশাখ উদযাপনের কথাই ধরা যাক। এখানেও আমরা দু’টা পক্ষ লক্ষ্য করছি। খণ্ডিত চেতনা ও বিভাজনের দৃষ্টিভঙ্গি এখানেও জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হতে দেয় নি। এ বিষয়ে ‘বাংলাদেশ প্রতিদিন’ পত্রিকার পহেলা বৈশাখের এক সংখ্যায় বিশিষ্ট চলচ্চিত্র ও নাট্য পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর একটি লেখা মুদ্রিত হয়েছে। ‘এই চেতনা লইয়া আমরা কী করিব’ শীর্ষক লেখাটিতে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার নীরিখে কিছু কথা বলার চেষ্টা করেছেন তিনি। এতে আমাদের সমাজচিত্রটা বেশ ভালভাবেই ফুটে উঠেছে। একজনের প্রশ্ন ‘পহেলা বৈশাখ উদযাপন অনৈসলামিক। আপনি এটা উদযাপন করছেন কেন?’ জনাব ফারুকী আরো লিখেছেন, “কিছুদিন আগে ৭১ টিভিতে আমার খুবই প্রিয় একজন শিল্পী ঢালাওভাবে বোরকা পরাকে সমালোচনা করতে গিয়ে এটাকে অবাঙালি সংস্কৃতি হিসেবে বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়েছেন। এই দুই বিপরীত মেরুর চিন্তার মাঝে আমি বিশেষ পার্থক্য দেখতে পারছি না। বরং মিল খুঁজে পাচ্ছি। সেটা হচ্ছে সহনশীলতা আর উদারতার ব্যাপক ফারাক। আমাদের পরিচয়ের সূত্রগুলো মোটামুটি এই দুই দেয়ালে মাথা ঠুকে ঠুকে রক্তাক্ত হয়ে পড়ে আছে। প্রথমে দেখি, আমাদের প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদীদের পরিচয়ের ধারাপাতে কি লেখা আছে। ছোটবেলায় সংস্কৃতি চর্চার উদ্দেশে নাখালপাড়া থেকে দুই পা বাহিরে ফেলিয়া শাহবাগ অঞ্চলে পৌঁছে অনেক ভাল ভাল ধারণার সঙ্গে কিছু অদ্ভূত ধারণাও পেলাম। শাহবাগের আড্ডা, টিএসসি, আজিজ মার্কেট-এই রাস্তাঘাট, ইট-পাথর সবই ছিল আমার শ্রেণিশিক্ষক। শাহবাগের কাছে তাই আমার আজন্মের ঋণ। তো সেখানে গিয়েই আবিষ্কার করলাম সংস্কৃতি কর্মীরা পূজোয় যাবে, বড়দিনে যাবে, পূজো নিয়ে গল্প করবে, ভাই-ফোঁটা দিবে, কিন্তু শবে-বরাতে তাদের কোনো কর্মসূচি থাকবে না। তারা ঈদের জামাত নিয়ে বেশি বাক্য ব্যয় করবে না। আমার কেন যেন মনে হতো ইসলামী আচার বা সংস্কৃতি নিয়ে বেশি উচ্চবাচ্য না করাটাই প্রগতিশীল প্রমাণ করার উপায়। এই যে এভাবে আমাদের পরিচয় থেকে ধর্মীয় উপাদানকে তাড়ানোর চেষ্টা করলো আমাদের প্রগতিশীল শিবিরের একটা বড় অংশ, এটা কি আদৌ এই জাতির বিকাশে কোনো সাহায্য করেছে? নাকি এ জাতিকে ভগ্নাংশে পরিণত করেছে কেবল? একইভাবে আমাদের ধর্মীয় শিবির থেকে যেভাবে আমাদের জাতীয় চিহ্ন, উৎসব বা পরিচয়ের উপাদানকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করার চেষ্টা করা হয়েছে, সেটা কি ইসলাম ধর্মের কোনো উপকারে এসেছে অহেতুক বিতর্ক বাড়ানো ছাড়া?” জনাব ফারুকী তার লেখাটিতে আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, “যে কোনো বিষয়ে বিরোধ-বিতর্ক সমাজের সুস্থতার লক্ষণ। কিন্তু আমাদের সব বিতর্ক আর বিরোধ অন্যমতকে নির্মূল করার প্রচেষ্টায় পর্যবসিত হয়। আমাদের সব হুঙ্কারই অন্যকে নির্মূল করার হুঙ্কার। আমাদের সব কমিটি নির্মূল কমিটি।’ তিনি আরো লিখেছেন, ‘আমাদের পরিচয় কী হবে এ বিষয়ে বিতর্ক একটা সহনীয় পর্যায়ে নিষ্পত্তি না হলে আমরা জাতি হিসেবে যে আগাতে পারবো না, এটা তো পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে।”
‘এই চেতনা লইয়া আমরা কী করিব’ শীর্ষক লেখাটিতে জনাব ফারুকী যে বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করেছেন তা বর্তমান সবয়ের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে আমরা মনে করি। পক্ষপাতদুষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি পরিহার করে আমরা যদি সত্যনিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গিতে বিষয়গুলো পর্যালোচনা করি, তাহলে ঐকমত্যে পৌঁছা কোনো কঠিন বিষয় নয়। আর যদি নিজেদের খণ্ডিত কিংবা স্বার্থান্ধ চেতনাকে ‘সবার চেতনা’ হিসেবে প্রোপাগাণ্ডা চালিয়ে তা জাতির উপর চাপিয়ে দিতে চাই, তাহলে আমাদের সংকটের মাত্রাই শুধু বাড়বে। এমন পরিবেশে পরস্পরকে নির্মূলের চেতনা ও নির্মূল কমিটির সংখ্যাই শুধু বাড়তে থাকবে। এমন চেতনা নিয়ে আর যাই হোক জাতির উন্নতি ও প্রগতির স্বপ্ন পূরণ হতে পারে না।

বর্তমান সময়ের একটা সংকট হলো, আমরা সবাই নিজের বা নিজ ঘরানার চিন্তা-চেতনাকে জাতির-চিন্তা চেতনা বলে প্রোপাগাণ্ডা করে বেড়াই। কিন্তু আসলেই জাতির চিন্তা-চেতনা ও জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার খবর আমরা কতটুকু রাখি? স্পষ্ট করে বলতে গেলে বলতে হয়, বাংলাদেশের জনগণ সম্প্রীতির সমাজেই বসবাস করতে চায়। এই জনপদের মানুষের ভাষা ও খাদ্যভ্যাসে যেমন মিল রয়েছে, তেমনি ধর্ম-ভাবনায় রয়েছে আবার পার্থক্য বা বৈচিত্র্য। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ধর্ম ও সংস্কৃতি ভাবনায় স্বাতন্ত্র্যের কথাও এখানে উল্লেখ করা যায়। এরপরেও উল্লেখ করতে হয় যে, মিল ও অমিলের নানা বিষয় নিয়েও আমাদের সমাজ হতে পারে শান্তি ও সম্প্রীতির সমাজ। এই জনপদের হাজার বছরের ইতিহাস তেমন সাক্ষ্যই বহন করে। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ধর্ম ও সংস্কৃতির মর্মবাণী উপলব্ধি করা। স্বার্থান্ধ ব্যক্তিরা ধর্ম ও সংস্কৃতির মর্মবাণী উপলব্ধির বদলে বরং এর স্বাতন্ত্র্য ও বৈচিত্র্যকে হিংসা-বিদ্বেষ ও বিভক্তি বাড়াতে কাজে লাগায়। প্রসঙ্গত এখানে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি বক্তব্য উল্লেখ করা যায়। তিনি বলেছিলেন, “এখন জগৎ জুড়িয়া সমস্যা এই নহে যে, কি করিয়া ভেদ ঘুচাইয়া মিলন হইবে, কিন্তু কি করিয়া ভেদ রক্ষা করিয়া মিলন হইবে সেইটাই বড় কথা। কারণ সেইখানে কোনো ফাঁকি চলে না, বরং প্রত্যেকের জন্য প্রত্যেকের জায়গা ছাড়িয়া দিতে হয়।” আসলে যারা ফাঁকির রাজনীতি করেন, ফাঁকির সংস্কৃতি চর্চা করেন তাদের দ্বারা কোনো জনপদে ঐক্য কিংবা মিলনের সেতুবন্ধন রচনা সম্ভব নয়। কারণ তারা ভেদ-বিভেদ, অনৈক্য ও নির্মূলের গান গাইতেই আনন্দ পান।

জনাব ফারুকী যে সব বিষয় উত্থাপন করেছেন, আজ হয়তো তার সবকিছু নিয়ে কথা বলা সম্ভব হবে না? তবে বৈশাখ উদযাপন নিয়ে কিছু কথা অবশ্যই বলতে হয়। বৈশাখ আসলে কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয় বরং একটি সামাজিক অনুষ্ঠান। পবিত্র ধর্ম ইসলাম যে কোনো জনপদের সামাজিক অনুষ্ঠানও (উরফ) প্রথা তথা স্থানীয় সংস্কৃতির বিষয়গুলোকে অনুমোদন দেয়, যদি সেখানে মানুষের জন্য ক্ষতিকর কিংবা হারাম কোনো বিষয় না থাকে। বৈশাখের মত অনুষ্ঠানকে ইসলাম ‘উরফ’ হিসেবে বিবেচনা করে। শুধু বৈশাখ কেন, নামাযের মত পবিত্র ইবাদতেও যদি কারো মন্দ মতলব থাকে তাহলে তা ইসলামে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয় না। এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি আমাদের উপলব্ধি করতে হবে। তাই বলতে হয়, বৈশাখ উদযাপন ইসলামে কোনো নিষিদ্ধ বিষয় নয়।

বৈশাখের কোনো অনুষ্ঠান তখনই নিষিদ্ধ বলে বিবেচিত হতে পারে; যদি সেখানে শিরক, কুসংস্কার, টোটেম বিশ্বাস কিংবা কোনো মন্দ বা নিষিদ্ধ বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ইসলাম যা বলেনি তাকে ইসলামের বিষয় বলে যারা প্রচার করেন তারা আসলে ইসলামের প্রতিনিধিত্ব করার যোগ্যতা হারান। আর যারা ভুল বক্তব্যকে গ্রহণ করে ইসলামের ইমেজ বিনষ্ট করার তৎপরতায় যুক্ত হন তাদের মন্দ মানুষ হিসেবেই বিবেচনা করতে হয়। এদের প্রোপাগান্ডায় যারা বিভ্রান্ত হবেন তাদের দ্বারা দেশ ও জাতির কল্যাণ সম্ভব নয়। যারা ইলাম ধর্মের দর্শন ও শরিয়া সম্পর্কে অবগত আছেন, তারা এ কথা স্পষ্টভাবেই জানেন যে, বৈশাখের স্বাভাবিক ও অনাবিল উৎসবে জড়িত থাকার পরেও ভাল মুসলমান থাকা যায়। আমরা যদি বাংলাদেশকে সমৃদ্ধি ও প্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই, তাহলে একই সাথে আমাদের এই জনপদের মানুষের ধর্মভাব ও সংস্কৃতিভাবকে সুসমঞ্জসভাবে বিকশিত করতে হবে। এই সত্য উপলব্ধিতে ভুল হলে আমাদের অভিযাত্রা হয়তো কাক্সিক্ষত পথ খুঁজে পাবে না।

http://www.dailysangram.com/post/279710