সম্প্রতি হবিগঞ্জের মাধবপুরে রেলসেতুর পিলার ধসে পড়ার চিত্র
৯ এপ্রিল ২০১৭, রবিবার, ২:০৩

দেড়শ বছর আগে নির্মিত ২ হাজার ৩২ সেতু-কালভার্ট দিয়ে চলছে পূর্বাঞ্চল রেল

# অহরহ ঘটছে দুর্ঘটনা কমছে ট্রেনের গতি

হবিগঞ্জের মাধবপুরে সম্প্রতি একটি রেলসেতুর পিলার ধসে পাঁচ দিন বন্ধ ছিল সিলেটের সঙ্গে রেলযোগাযোগ। এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতে মৌলভীবাজারেও ধসেপড়ে আরেকটি রেলসেতু। কেবল হবিগঞ্জ ও সিলেট নয়, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রতি বছরই বর্ষা মৌসুমে ঝুঁকিপূর্ণ সেতুর কারণে রেল যোগাযোগে ব্যহত হয়ে থাকে। কিন্তু দুর্ঘটনার আশঙ্কা সত্ত্বেও স্থায়ীভাবে মেরামত করা হয় না এসব রেল সেতু। রেলের পক্ষ থেকে অতি ঝুঁকিপূর্ণ ৩৩ টি সেতু চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব সেতু নিয়মিত মেরামত না করায় প্রকৌশল বিভাগকেই দায়ী করছে সংশ্লিষ্টরা।
রেলওয়ের প্রকৌশল বিভাগের তথ্যমতে, রেলের পূর্বাঞ্চলে মোট সেতু-কালভার্টের সংখ্যা ২ হাজার ৩২। এর মধ্যে কয়েকশ সেতু ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় রয়েছে। তবে ৩৩টি সেতু রয়েছে ভয়াবহ ঝুঁকিতে। ঝুঁকিপূর্ণ এসব সেতুর কারণে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। অনেক সময় ট্রেনের গতি অস্বাভাবিক কমে যায়। এতে গন্তব্যে পৌঁছানোর সময় বেড়ে যাওয়া ছাড়াও ঝুঁকি নিয়েই চলাচল করে যাত্রী ও মালবাহী ট্রেন।
সূত্র জানায়, ১৮৬২ সালে প্রথম রেল চালু হওয়ার পর এসব রেল সেতুর বেশিরভাগ তৈরি করা হয়। বছরের পর বছর পার হলেও রেলসতু সংস্কারের কোন কাজ হয়নি। ফলে মেয়াদোত্তীর্ণ এসব রেলসেতু দিয়েই চলছে রেল।
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, কয়েক বছর ধরে ঢাকা-চট্টগগ্রাম, ঢাকা-সিলেট, চট্টগ্রাম-সিলেট ও চট্টগ্রাম-দোহাজারী রুটের বেশকয়েকটি রেলসেতু মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে পড়ে। ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে একাধিক ডাবল লাইন প্রকল্প বাস্তবায়িত হওয়ায় এ রুটের ঝুঁকিপূর্ণ সেতুগুলো মেরামত করা হয়। কিন্তু চট্টগ্রাম ও ঢাকা থেকে সিলেট রুটের সেতু এবং চট্টগ্রাম থেকে দোহাজারী পর্যন্ত বিভিন্ন সেকশনের ঝুঁকিপূর্ণ সেতুগুলো মেরামতে গড়িমসি করছে রেলওয়ে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অতি ঝুঁকিপূর্ণ সেতুর তালিকায় রয়েছে চট্টগ্রাম-ঢাকা-সিলেট রুটের বিভিন্ন সেকশন। ঝুঁকিপূর্ণ এসব সেতুর মধ্যে রয়েছে শমসেরনগর-টিলাগাঁও সেকশনের ২০০ নম্বর সেতু, মোগলাবাজার-মাইজগাঁও সেকশনের ৪৩, ৪৫ ও ৪৭ নম্বর সেতু, কুলাউড়া-বরমচাল সেকশনের ৫ ও ৭ নম্বর সেতু, সাতগাঁও-শ্রীমঙ্গল সেকশনের ১৪১ নম্বর সেতু, শ্রীমঙ্গল-ভানুগাছ সেকশনের ১৫৭ নম্বর সেতু এবং মনতোলা-ইটাখোলা সেকশনের ৫৬ নম্বর সেতু। গত ২৯ মার্চ মনতোলা-ইটাখোলা সেকশনের ৫৬ নম্বর সেতুটি ভেঙে যাওয়ায় সিলেটের সঙ্গে সারা দেশের ট্রেনচলাচল বন্ধ হয়ে যায়। সাময়িক মেরামতের মাধ্যমে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক করা হলেও ৫ এপ্রিল সাতগাঁও-শ্রীমঙ্গল সেকশনের ১৪১ নম্বর সেতুটিও বৃষ্টির পানিতে নড়বড়ে হয়ে পড়ে।
রেলের একটি সূত্র বলছে, রেলের ট্র্যাক সংস্কার, নতুন নতুন লাইন নির্মাণে প্রকল্প নেয়া হলেও সেতু মেরামত ও নির্মাণে বড় কোনো প্রকল্প নেয়া হয়নি। এতে প্রতি বছর ট্রেন দুর্ঘটনা যেমন ঘটছে, তেমনি বড় বিনিয়োগের পরও রেলের গতিবাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। ট্র্যাকে ট্রেনের গতি বাড়ানোর জন্য অনুমোদন চাওয়া হলেও প্রকৌশল বিভাগ গতি বাড়াতে অনীহাপ্রকাশ করে। বরং বর্ষা মৌসুম এলেই ট্রেনের গতি কমানোর প্রস্তাব দেয়া হয় পরিবহন বিভাগকে।
রেলের প্রকৌশল বিভাগের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মোগলাবাজার-মাইজগাঁও সেকশনের ট্রেনের গতিসীমা ৭০ কিলোমিটার হলেও ৪৩ ও ৪৫ নম্বর সেতুর বেড ব্লক ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থায় রয়েছে। এজন্য এ দুটি সেতুতে প্রবেশের আগে ট্রেনেরগতি সীমা ২০ কিলোমিটারে নামিয়ে আনার প্রস্তাব করা হয়েছে। ষোলশহর-দোহাজারী সেকশনের সিডি-৪৬ নম্বর সেতুর গার্ডার ক্ষয় প্রাপ্ত হওয়ায় গতি ২০ কিলোমিটারে রেখে ৫ মিনিট অতিরিক্ত থামার নির্দেশনা দেয়া হয়।
সূত্র জানায়, আখাউড়া-নরসিংদী সেকশনের গতি ৭২ কিলোমিটার হলেও ৪৮ নম্বর সেতুর পুনঃনির্মাণ কাজের জন্য মাত্র ৮ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলাচলের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এছাড়া মনতোলা-ইটাখোলা সেকশনের ট্রেনের গতি ৭০ কিলোমিটার হলেও ৫৬ নম্বর সেতুর পিলারের মাটি ধসে যাওয়ায় ট্রেন থেমে ১০ কিলোমিটার গতিতে চলাচল ও অতিরিক্ত ৫ মিনিটের অতিরিক্ত গতি নিয়ন্ত্রণাদেশ মেনে চলার পরামর্শদেয়া হয়েছে।
রেলের মহাব্যবস্থাপক আবদুল হাই দাবী করেন, পূর্বাঞ্চলে দুই হাজারের বেশি সেতু ও কালভার্ট রয়েছে। ব্রিটিশ আমলে তৈরি অধিকাংশ সেতুই এখন ঝুঁকিপূর্ণ। এগুলো মেরামতের প্রয়োজন রয়েছে। রেলের সেতু সংস্কারের মাধ্যমে ট্রেনের চলাচল স্বাভাবিক রাখার নিয়ম থাকায় দ্রুত সময়ের মধ্যে মেরামত কিংবা নতুন করে সেতু স্থাপন সম্ভব নয়। তবে রেলওয়ে নিয়মিত বিরতিতে মেরামত কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।

http://www.dailysangram.com/post/279133-