হাজারীবাগ ট্যানারিতে গতকাল গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানি সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হচ্ছে : নয়া দিগন্ত
৯ এপ্রিল ২০১৭, রবিবার, ১:৫৪

হাজারীবাগে কান্নার রোল

গ্যাস-পানি-বিদ্যুতের ৬০ ভাগ লাইন কাটা হয়েছে বাকিগুলো আজ

কী মালিক, কী শ্রমিক। অঝোরে কাঁদছেন সবাই। কাঁদছেন বিভিন্ন কারখানায় পণ্য সরবরাহকারী, ঠিকাদার, ভ্যানচালকও। কাঁদবেন না কেন? দীর্ঘ ৬০ বছরের সম্পর্ক। অনেকের জন্মই হয়েছে এই ট্যানারির দুর্গন্ধযুক্ত পরিবেশে। বাপ-দাদার পেশাকে নিজের করে নিয়েছেন অনেকে। সব কিছু ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে। তাদের বুকভরা কান্নায় ভারি হয়ে আসছিল হাজারীবাগের বাতাস। আদালতের নির্দেশে ৬০ শতাংশ কারখানার পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে গতকাল। পাঁচজন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে চারটি টিম গ্যাস সংযোগ, ছয়টি টিম বিদ্যুৎ সংযোগ এবং চারটি টিম সারা দিন পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে। সময়ের অভাবে যেসব সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব হয়নি সেগুলো কাটা হবে আজ। সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন আজ দুপুরের মধ্যেই সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণের কাজ শেষ করা সম্ভব হবে। এ বিষয়ে আদালতে রিপোর্ট জমা দেয়া হবে বিকেলে।
পরিবেশ অধিদফতরের মহাপরিচালক রাইসুল আলম মণ্ডলের নির্দেশে সকাল ১০টায় শুরু হয় সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার কার্যক্রম। অভিযানে অংশ নেন পাঁচজন ম্যাজিস্ট্রেট। তাদের সার্বিক তত্ত্বাবধানে গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে ৪টি ইউনিট, বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্নে ৬টি ইউনিট এবং পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে কাজ করছে ৪টি ইউনিট। গ্যাস বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে বিদ্যুতের মিটার, জেনারেটর গ্যাস মিটার এবং গ্যাসের লেজার নিয়ে যান সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার কাজে নিয়োজিতরা। গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন কাজে নিয়োজিতরা জানান, জেনারেটর গ্যাস মিটার ও গ্যাসের লেজার নিয়ে যাওয়ার কারণে কারখানাগুলো তিতাসের লাইনের গ্যাস পাবেন না। যদি কেউ নতুন মিটার লাগিয়ে গ্যাস সংযোগ নেয় তবে তার বিরুদ্ধে মামলা করা হবে। তবে মিটার না লাগিয়ে কারখানা কর্তৃপ যদি চায় তাহলে সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করতে পারবে। কারণ সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহারের জন্য এই মিটারের প্রয়োজন নেই।
এ বিষয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের সাথে আলাপকালে পরিবেশ অধিদফতরের মহাপরিচালক রাইসুল আলম মণ্ডল বলেন, আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী বৃহস্পতিবারই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার কথা ছিল। কিন্তুলোকবল সঙ্কটের কারণে ওই দিন আমরা কার্যক্রম চালাতে পারিনি। এখন যত দ্রুত সম্ভব আমরা কাজ শেষ করতে চাই। কারণ আদালতে আমাদের প্রতিবেদন জমা দিতে হবে। সব ট্যানারির গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে রোরবার দুপুরের মধ্যেই এ বিষয়ে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা চেষ্টা করছি শনিবারের মধ্যেই সব সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার কাজ সম্পন্ন করতে। যদি আজ কাজ শেষ না হয় তবে রোববার দুপুরের আগেই সব সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হবে। সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে আমরা আদালতে প্রতিবেদন জমা দেবো। গতকাল বিকেল পর্যন্ত প্রায় ৬০ ভাগ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
ট্যানারি মালিকদের পক্ষ থেকে আগেই জানিয়ে দেয়া হয় যে, সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণ কর্মসূচিতে তারা বাধা দেবেন না। সে অনুযায়ী কর্তৃপক্ষকে কোনো বাধার মুখেই পড়তে হয়নি। যদিও কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এলাকায় বহুসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল। বিভিন্ন ট্যানারির মালিক-শ্রমিকদের গতকালও নিজ নিজ কারখানার মালামাল সরিয়ে নেয়ার কাজে ব্যস্ত থাকতে দেখা গেছে। তাদের মাঝে কাজ করছিল চাপা ক্ষোভ। ব্যবসায় ও চাকরি হারানোর আতঙ্ক দেখা যাচ্ছিল সবার চোখে-মুখে।
এ প্রসঙ্গে আলাপকালে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত হোসেন নয়া দিগন্তকে বলেন, আমরা তো আমাদের সমস্যাগুলো সরকারকে জানানোর চেষ্টা করেছি। আদালতের নির্দেশের ব্যাপারে তো কারোই কিছু করার নেই। আমরা বারবার সরকারকে বলেছি সাভারে গ্যাস সংযোগ দেয়ার জন্য। কিন্তু এখানো সেখানে গ্যাস সংযোগ দেয়া হয়নি। আমরা কাজ করব কিভাবে? আমরা কাজ না করতে পারলে মাল ডেলিভারি দিতে পারব না। আর মাল ডেলিভারি দিতে না পারলে বেতন দেবো কিভাবে?’
সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায়, পরিবেশ অধিদফতরের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত সংযোগ বিচ্ছিন্ন কার্যক্রমে গ্যাস-বিদ্যুৎ লাইন কাটার পাশাপাশি মিটারও কারখানাগুলো থেকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এসব মালামাল জমা রাখা হবে ডেমরার সারুলিয়ায়। আজ সকাল ১০ টায় বিচ্ছিন্নকরণ কার্যক্রম ফের শুরু হবে বলে জানান তারা।
এ দিকে গত ১৫ বছর ধরে হাজারীবাগে অবস্থিত অ্যাপেক্স ট্যানারিতে কাজ করা সালেহা গতকাল বিলাপ করে কাঁদছিলেন আর সংবাদকর্মীদের বলছিলেন, ৯০০ টাকা দিয়ে কাজ শুরু করে এখন তার মাসিক বেতন ছয় হাজার টাকা। রিকশাচালক স্বামীর উপার্জন ও নিজের এ স্বল্পআয়ে কোনোমতে চালিয়ে নেন সংসার। সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণের মাধ্যমে কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বেকার হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘স্যার আমরা কই যামু, কী খামু। মালিকগো তো অনেক টাকা আছে, তাগো সমস্যা হইব না।’ তিনি জানান, হাজারীবাগ থেকে কারখানা সাভারে সরিয়ে নিচ্ছে। ওখানে তাদের থাকার জায়গা নেই। তাদের পে এখান থেকে ওখানে গিয়েও কাজ করা সম্ভব নয়। ফলে এখন বেকার হয়ে যেতে হবে তাদের। বেকার হলে কী করবেন, কী খাবেন। তাদের কথা কেউ ভাবে না। রাজ্যের হতাশা দেখা যায় সালেহার মতো শত শত শ্রমিকের চোখে-মুখে।
গত ২ মার্চ হাজারীবাগের ১৫৪টি ট্যানারি কারখানার বকেয়া বাবদ ৩০ কোটি ৮৫ লাখ টাকা জরিমানা দুই সপ্তাহের মধ্যে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেয়ার নির্দেশ দেন হাইকোর্টের বিচারপতি মো: আশফাকুল ইসলাম ও বিচারপতি আশীষ রঞ্জন দাসের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ। পরে এ আদেশ স্থগিত চেয়ে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন ও ফিনিশড লেদার, লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন আদালতে আবেদন করেন। ৬ মার্চ সব ট্যানারি অবিলম্বে বন্ধের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। একই সাথে কারখানাগুলোর বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি বিচ্ছিন্ন করাসহ সব সুযোগ-সুবিধা বন্ধ করে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। ১২ মার্চ কারখানাগুলো অবিলম্বে বন্ধে হাইকোর্টের নির্দেশ বহাল রাখেন আপিল বিভাগ।
৩০ মার্চ হাজারীবাগে থাকা ট্যানারিগুলোর সব কার্যক্রম ৬ এপ্রিলের মধ্যে বন্ধ করা হলে জরিমানা মওকুফের বিষয়ে বিবেচনার কথা জানান সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। আজ ৯ এপ্রিল এ-সংক্রান্ত পরবর্তী শুনানি গ্রহণের কথাও জানান আদালত। আদালতের ওই নির্দেশনার পরিপ্রেেিত ধানমন্ডির একটি রেস্টুরেন্টে সংবাদ সম্মেলন করে ট্যানারি মালিকরা জানান, ৬ এপ্রিল থেকে সব ট্যানারি বন্ধ করে দেবেন তারা। তবে ৬ এপ্রিলের মধ্যে সাভারে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানি সংযোগ দেয়ার দাবিও করেন তারা। কিন্তু আদালতের নির্দেশনা ও মালিকদের প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও ৬ এপ্রিল ট্যানারিগুলোর কোনো সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়নি।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/210743