৭ এপ্রিল ২০১৭, শুক্রবার, ৯:১৪

দিনে দেড় কোটি মানুষের কর্মক্ষমতা নষ্ট চিকিৎসায়

দেশে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ১০ কোটি, যাদের বয়স ১৫ থেকে ৬৪ বছরের মধ্যে। প্রতিদিন প্রায় দেড় কোটি কর্মক্ষম মানুষকে কোনো না কোনোভাবে পুরো সময় ব্যয় করতে হয় স্বাস্থ্যসেবা নেওয়ার পেছনে। এ সময় অচল থাকে তাদের পুরো কর্মক্ষমতা। আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন-অগ্রগতিতে তা আর কাজে লাগে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দিনে দিনে দেশে যতই অসুখ-বিসুখের মাত্রা বাড়ছে, ততই মানুষ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অচল হয়ে পড়ছে। একজনের সঙ্গে অচল হয়ে থাকে আরো কয়েকজনের কর্মশক্তি, যা দেশের উন্নয়নে বড় একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানান, সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডাক্তারের চেম্বার, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, হোমিওপ্যাথি, আর্য়ুবেদি, ইউনানি চিকিৎসাকেন্দ্রে যেভাবে প্রতিদিন মানুষের ভিড় বেড়ে চলছে তা খুবই উদ্বেগজনক। এটা যেমন রোগের বিস্তার বাড়ার একটি নমুনা, তেমনি আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন অগ্রগতিকে পেছনে টেনে রাখার একটি গুরুত্বপূর্ণ চিত্রও। বিশেষ করে যে রোগে আক্রান্ত হয়ে বা রোগী হিসেবে চিকিৎসা কেন্দ্রে যায় তার নিজের আয়-রোজগার বা কর্মক্ষমতা যেমন অচল থাকে, তেমনি তার সহযোগীরও একই অবস্থা হয়।
৩০ বছর বয়সী রাশিদা বেগম কাজ করেন ঢাকার একটি পোশাক কারখানায়। কয়েক দিন ধরেই ভুগছেন শ্বাসকষ্টে। বুধবার দুপুরে রাজধানীর মহাখালী বক্ষব্যাধি হাসপাতালের সামনে বসে ছিলেন একটি রিকশা-ভ্যানের ওপর। পাশে বসা স্বামী মতিউরও গার্মেন্টকর্মী। সঙ্গে ক্লাস সেভেনে পড়া মেয়ে রাখি।
মতিউর বলেন, ‘সকাল ৮টায় এইহানে আইছিলাম। ডাক্তার দেহাইছি। টেস্ট দিচ্ছে। অর্ধেক টেস্ট করাইছি, বাকিডা কাইলকা করণ লাগবো। এহন বাসায় নিয়া যাইতে বলছে। একজনে অসুখে পইর্যা তিনজনের সর্বনাশ অইয়া যাইতে আছে। রোগীর নিজের কাজ তো বন্ধ অইলোই, আমারও পুরা দিন নষ্ট অইলো, মেয়েটারও স্কুল কামাই গেল। কাইলকার দিনও এমনেই যাইবো। আমাগো তো কামে না গেলে বেতন বন্ধ। আল্লাই জানে আরো কয়দিন ভুগতে অইবো। ’
লালমাটিয়ার মুদি দোকানি বেলাল মিয়ার বয়স ৪০। বেশ কিছু দিন ধরেই ভুগছেন হাঁটুর ব্যথায়। হঠাৎ ব্যথা বেড়ে যাওয়ায় বুধবার সকালে যান পঙ্গু হাসপাতালে। ডাক্তার দেখিয়ে ঘুরছিলেন এমআরআই রুমের সামনে। বললেন, ডাক্তার এমআরআই করাতে বলেছেন, কিন্তু এখানে এসে শুনি, সিরিয়াল পেতে অনেক সময় লাগবে। তাই দেখছি কোনো লাইনঘাট করা যায় কি না। তা নাইলে বাইরের কোনো হাসপাতালে যাওন লাগবো। নয়তো আরো কয়দিন দোকানটা বন্ধ রাখা লাগে কে জানে!
গত মঙ্গল ও বুধবার রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, জাতীয় ক্যান্সার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল, বারডেম, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, ধানমণ্ডির পপুলার হাসপাতাল, ইবনে সিনাসহ আরো কয়েকটি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক ঘুরে দেখা যায়, রোগী ও তাদের স্বজনদের উপচে পড়া ভিড়। এই রোগীদের বেশির ভাগেরই বয়স ২৫ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে।
ক্যান্সার হাসপাতালের নিচতলায় রোগী সুরাইয়া বেগমের সঙ্গে তার স্বামী ও দুই সন্তান অপেক্ষা করছেন। সুরাইয়ার স্বামী মনিরুল বলেন, ‘কেমোথেরাপির জন্য এসে অপেক্ষা করছি। কখন ডাক পড়ে জানি না। ’ একজন রোগীর সঙ্গে আরো তিনজন এলেন কেন? প্রশ্ন শুনে মনিরুল বলেন, এই তিনজনও তো কুলাইতে পারি না, আরো একজন লাগে। একজনের রোগীর কাছে সব সময়ই থাকতে হয়; ওষুধ আনতে ছুটতে হয় একজনকে; কেমোর ওখানে খোঁজ নিতে ছুটতে হয় আরেকজনকে। আবার রোগীকে কোলে নিয়া ওঠা-নামাও করতে হয়। কত যে ভোগান্তি! আমার চাকরি, এক ছেলের কলেজ, আরেক ছেলের ট্রাকের ড্রাইভারি—সবই বন্ধ হয়ে আছে।
ক্যান্সার হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মোয়াররফ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমার এই হাসপাতালে রোগীর ধারণক্ষমতা মাত্র তিন শ জনের। কিন্তু প্রতিদিন রোগী আসে প্রায় ১২ শ। তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে তিন-চারজন করে সহায়ক হিসেবে আসে। সব মিলিয়ে এখানে প্রতিদিন তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার মানুষ সময় পার করে। যাদের প্রত্যেকের পরিবার-সংসার, আয়-উপার্জন অচল থাকে। আমাদের নেই প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত সুবিধা ও জনবল। তাই রোগীর সঙ্গে আত্মীয়স্বজন থাকার সুযোগ না দিয়ে উপায় থাকে না। পরিচালক বলেন, ক্যান্সারের রোগীর মধ্যে প্রতিদিন প্রায় ৫০০ জন থাকে শুধু রেডিয়েশনের জন্যই, যাদের বড় অংশের বয়স ২৫-৬০-এর মধ্যে। অর্থাৎ যে সময়টাতে মানুষ সবচেয়ে কর্মক্ষম থাকে, সেই বয়সেই ইদানীং বেশি মানুষের মধ্যে ক্যান্সারের প্রবণতা বাড়ছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোভিসি ও বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের সদস্য অধ্যাপক ডা. সারফুদ্দিন আহম্মেদ বলেন, এ দেশের মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতার মাত্রা কম। মানুষ অসুস্থ হয়ে তারপর চিকিৎসার জন্য ছোটাছুটি করে। কিন্তু সবাই যদি আগে থেকে সচেতন থাকে অসুস্থ না হওয়ার জন্য তবে কিন্তু তার ডাক্তার-ওষুধ, পরীক্ষা-নিরীক্ষার পেছনে হয়রানি, অর্থ ব্যয়, সময় নষ্ট কোনোটাই লাগে না। বরং নিজেকে সুস্থ রেখে কর্মক্ষমতা ও অর্থ দুটোই রক্ষা করতে পারে।
ডা. সারফুদ্দিন আহম্মেদ বলেন, নিয়ম মেনে জীবনযাপন করা, স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলা, তামাক-মাদক পরিহার করা, কায়িক পরিশ্রম করা, খাওয়ার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা, ক্ষতিকর খাদ্য না খাওয়া, উচ্চ রক্তচাপ-ডায়াবেটিসের মতো সমস্যা নিয়ন্ত্রণে রাখা, মানসিকভাবে সুস্থ থাকা, বিষণ্নতায় আক্রান্ত না হওয়া, কথায় কথায় নিজে থেকে ওষুধ না খাওয়ার ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ হেলথ বুলেটিনের তথ্য অনুসারেই ২০১৫ সালে সরকারি পর্যায়ের ১৬ হাজার ২০০ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রেজিস্টার্ড রোগী ছিল প্রায় ১৮ কোটি (একজন রোগী একাধিকবার ভিজিটসহ)। এ হিসাবে কেবল সরকারি এসব কেন্দ্রে একদিনে রোগী আসে (ইনডোর-আউটডোর মিলে) প্রায় পাঁচ লাখ। তাদের সঙ্গে গড়ে কমপক্ষে একজন করে সহযোগী-স্বজন থাকে। ফলে ওই রোগী ও স্বজন মিলে প্রতিদিন কেবল সরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রেই আটকে যায় কমপক্ষে ১০ লাখ মানুষ।
অন্যদিকে দেশে প্রায় পাঁচ হাজার প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিকের প্রতিটিতে দিনে ১০০ জন করে হলেও পাঁচ লাখ মানুষ ইনডোর ও আউটডোরে নিয়মিত চিকিৎসা নেয়। তাদের সঙ্গে সহায়ক হিসেবে আসে আরো পাঁচ লাখ মানুষ।
এ ছাড়া বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন সূত্র জানায়, দেশের বিভিন্ন প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক, মেডিক্যাল সেন্টার এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ের প্রাইভেট চেম্বারে প্রতিদিন আরো কমপক্ষে ২০ হাজার চিকিৎসক দিনে গড়ে ২৫ জন করে মোট পাঁচ লাখ রোগীর চিকিৎসা দেন। তাদের সঙ্গে গড়ে এজন করে থাকে আরো পাঁচ লাখ মানুষ। পাশাপাশি বিভিন্ন পর্যায়ে ডিপ্লোমাধারী আরো দুই লাখ স্বাস্থ্যকর্মী নিয়মিত প্র্যাকটিস করায় তাদের কাছে দিনে গড়ে ১০ জন করে হলেও মোট ২০ লাখ রোগী থাকে। সঙ্গে সহায়ক থাকে আরো ২০ লাখ।
বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথি বোর্ডের চেয়ারম্যান ডা. দিলীপ কুমার রায় কালের কণ্ঠকে জানান, দেশে নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত প্রায় দুই লাখ হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক প্রতিদিন নিয়মিত প্র্যাকটিস করেন। যাঁদের কাছে গড়ে দিনে ১০ জন করে রোগী এলেও সব মিলিয়ে এ সংখ্যা প্রতিদিন দাঁড়ায় প্রায় ২০ লাখ। এর বাইরে দেশের ৫৭টি হোমিওপ্যাথি হাসপাতালে গড়ে ৫০ জন করে হলেও প্রায় তিন হাজার রোগী ভিড় করে, যাদের প্রত্যেকের সঙ্গে গড়ে একজন করে সহায়ক-স্বজন থাকে। অর্থাৎ দিনে কেবল হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার পেছনেই সময় ব্যয় করে প্রায় ৪৬ লাখ মানুষ।
এর বাইরে আর্য়ুবেদি ও ইউনানির আরো প্রায় এক লাখ চিকিৎসক সেবা দেন গড়ে পাঁচজন করে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষকে; তাদের সঙ্গে আটকে থাকে আরো পাঁচ লাখ। এর সঙ্গে অনানুষ্ঠানিকভাবে প্রতিদিনই একশ্রেণির মানুষ চিকিৎসার খোঁজে ছুটে ছুটে দিন পার করে কবিরাজ, ওঝা, বাইদা শ্রেণির মানুষের কাছে, যাদের কোনো হিসাব বা পরিসংখ্যান নেই। তবে এমন সংখ্যা একেবারেও কম নয় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। কারো কারো ধারণা, দেশে এমন অস্বীকৃত চিকিৎসা দেওয়ার মানুষ এক লাখের নিচে নয়। এভাবে সব মিলিয়ে দেশে প্রতিদিন চিকিৎসার পেছনে ছুটে বেড়ানো মানুষের সংখ্যা প্রায় দেড় কোটি।

http://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2017/04/07/483763