৬ এপ্রিল ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৯:৫৯

চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহার

প্রস্তুতি ছাড়াই ভারতের সঙ্গে চুক্তি করছে সরকার

প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে চুক্তি হতে পারে * সক্ষমতা না থাকায় পণ্য হ্যান্ডলিংয়ে এমনিতেই হিমশিম খাচ্ছে বন্দর কর্তৃপক্ষ * ভারতকে অগ্রাধিকার দিলে পণ্যজট বাড়বে

কোনো প্রকার সমীক্ষা চালানো হয়নি এখনও। বাড়তি পণ্য পরিবহনের প্রস্তুতিও নেই। এর পরও চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের সুযোগ দিয়ে ভারতের সঙ্গে চুক্তি করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ সরকার। এখানেই শেষ নয়, দুই বন্দরে ভারতীয় পণ্য জাহাজে ওঠানামার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেয়ার বিধানও রাখা হচ্ছে। এ চুক্তি হলে নৌপথের পাশাপাশি সড়কপথেও পণ্য আনানেয়ার সুযোগ পাবে ভারত। এ লক্ষ্যে ভারতের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে চুক্তির সব ধরনের প্রস্তুতি শেষ করে এনেছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন ভারত সফরে চুক্তিটি সই হচ্ছে। এটি কার্যকরের জন্য বাকি থাকবে কেবল স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) চুক্তিটি। সেটি স্বাক্ষরের পরই চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহার করে পণ্য আনানেয়া শুরু করতে পারবে ভারত।
চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ দুই বন্দরে ভারতের কী পরিমাণ পণ্য ওঠানামা করবে এবং পণ্যের ধরনই বা কেমন হবে তার কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই। এ ধরনের কোনো সমীক্ষাও হয়নি। তবে ভারতীয় পণ্য ওঠানামা করলে বন্দরের ওপর যে বাড়তি চাপ সৃষ্টি হবে তা মোকাবেলার সক্ষমতা বন্দরের নেই। এখনই চাহিদার তুলনায় বেশি পণ্য আসায় দুই বন্দরে প্রায়ই পণ্যজটের সৃষ্টি হচ্ছে। এর মাশুল দিতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ফলে সক্ষমতা না বাড়িয়ে ভারতীয় পণ্য পরিবহনের সুযোগ দেয়া হলে পণ্যজট আরও বাড়বে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান যুগান্তরকে বলেন, চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারে ভারতের সঙ্গে চুক্তির বিষয়ে আলোচনা চলছে। প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন সফরে এ চুক্তি যে হবে এমনটা নিশ্চিত নয়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের নিজস্ব চাহিদার তুলনায় পণ্য হ্যান্ডলিংয়ের সক্ষমতা নেই। এ কারণে বে টার্মিনাল, পতেঙ্গা টার্মিনাল ও লালদিয়া টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। চলতি বছর পতেঙ্গা টার্মিনাল নির্মাণের কাজ শুরু হয়ে ২০১৯ সালে শেষ হবে বলে আশা করছি। পর্যায়ক্রমে বাকি দুটি টার্মিনাল নির্মাণ করা হবে।’
জানা গেছে, খসড়া চুক্তির ‘পোর্ট ও অন্যান্য সুবিধা’- ধারায় বলা হয়েছে, এ চুক্তির আওতায় ভারতীয় পণ্য আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সুযোগ-সুবিধা প্রদানের ব্যবস্থা করবে। তবে নির্ধারিত চার্জ ও ফি আদায় করবে কর্তৃপক্ষ। পণ্য পরিবহনের রুট সম্পর্কে চারটি পয়েন্টের কথা উল্লেখ করা হয়েছে চুক্তিতে। এগুলো হল : ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া ও ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলা, সিলেটের তামাবিল ও ভারতের মেঘালয় রাজ্যের ডাউকি। বাকি দুটি পয়েন্ট- শ্যাওলা ও সুতারকান্দি এবং শ্রীমান্তপুর ও বিবিরবাজার। এ ছাড়া দুই দেশ আন্তঃকমিটি অনুমোদন করলে স্থলবন্দর ও রুটের সংখ্যা বাড়াতে পারবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, চুক্তি কার্যকরের পর উপরোক্ত পয়েন্ট দিয়ে সড়কপথে ভারতীয় পণ্য চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরে ঢুকবে এবং পরে সেখান থেকে জাহাজের মাধ্যমে বিভিন্ন গন্তব্যে চলে যাবে। একইভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ভারতীয় পণ্য বাংলাদেশের দুই বন্দর হয়ে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে পৌঁছবে। বিদ্যমান উপকূলীয় জাহাজ চুক্তির আওতায় ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে নৌপথে মংলা ও চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে সরাসরি পণ্য আনানেয়া করতে পারবে ভারত।
এদিকে বিদ্যমান অবস্থায় দুই বন্দর ব্যবহারে ভারতকে সুযোগ দেয়ার উদ্যোগের বিষয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে। তবে বিষয়টি স্পর্শকাতর হওয়ায় এ নিয়ে কেউ মুখ খুলতে রাজি নন। সম্প্রতি চট্টগ্রাম বন্দরের নিজস্ব এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, চলতি বছর বাংলাদেশের কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের চাহিদা রয়েছে ২৩ লাখ ৬৯ হাজার টিইউএস। আগামী বছর তা বেড়ে দাঁড়াবে ২৬ লাখ ৫৪ হাজার টিইউএস। সূত্র বলছে, বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরের সর্বোচ্চ সক্ষমতা রয়েছে ২৩ লাখ টিইউএস এবং মংলা বন্দরের সক্ষমতা ৭০ হাজার টিইউএস। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ২০১৯ সালের আগে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরের পণ্য হ্যান্ডলিংয়ের সক্ষমতা বড় আকারে বাড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তবে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা টার্মিনাল এবং মংলা বন্দরে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের মাধ্যমে ডেডিকেটেড জেটি নির্মাণের কথা রয়েছে। নির্ধারিত সময়ে এগুলোর নির্মাণ শেষ হলে দুই বন্দরের সক্ষমতা বাড়বে। চট্টগ্রাম বন্দরের সমীক্ষা রিপোর্ট অনুযায়ী, ওই সময়ে অর্থাৎ ২০১৯ সালে বাংলাদেশের নিজস্ব চাহিদা বেড়ে ২৯ লাখ ৬৪ হাজার টিইউএসে দাঁড়াবে। এর সঙ্গে যদি ভারতীয় পণ্য পরিবহন শুরু হয় তাহলে দুই বন্দরের ওপর চাপ বেড়ে যাবে।
চট্টগ্রাম বন্দরের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরে কী ধরনের এবং কী পরিমাণ ভারতীয় পণ্য ওঠানামা করবে তার কোনো ধারণা আমাদের দেয়া হয়নি। চট্টগ্রাম বন্দর উন্নয়নের স্বার্থে দেশীয় পণ্য পরিবহনের ওপর সমীক্ষা রয়েছে। কিন্তু ভারতের পণ্য পরিবহনের ওপর কোনো সমীক্ষা চালানো হয়নি। তাছাড়া আগামী পাঁচ বা দশ বছর পর পণ্যের পরিমাণ বেড়ে কত হবে তাও জানি না। চাহিদা না জানা পর্যন্ত বন্দর কর্তৃপক্ষও কোনো পরিকল্পনা নিতে পারছে না। তিনি বলেন, বছরে চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য পরিবহনের চাহিদা ১৫-১৬ শতাংশ হারে বাড়ে। রোজা, ঈদ এবং বাজেটের আগে বন্দরে কনটেইনার জট সৃষ্টি হয়।
ভারতীয় পণ্য পরিবহনের চাপ মোকাবেলায় মংলা বন্দর সক্ষম কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে মংলা বন্দরের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, কী পরিমাণ এবং কী ধরনের পণ্য ওঠানামা করবে তা আমাদের জানানো হয়নি। কোনো ধরনের প্রস্তুতিও নেই। তিনি বলেন, বর্তমানে বন্দরের ৫টি জেটিতে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের পণ্য ওঠানামা করা হচ্ছে। এ বন্দরের সক্ষমতা রয়েছে ৭০ হাজার টিইউএস। প্রাইভেট-পাবলিক পার্টনারশিপের ভিত্তিতে একটি ডেডিকেটেড জেটি নির্মাণে পাওয়ার প্যাক পোর্ট লিমিটেডের সঙ্গে সম্প্রতি একটি চুক্তি হয়েছে। দু’বছরের মধ্যে তা নির্মাণ করার শর্ত রয়েছে। এর আগে বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানো কষ্টকর।
খসড়া চুক্তিতে বলা হয়েছে, ভারতীয় পণ্যবাহী যানকে বাংলাদেশের প্রচলিত আইন ও বিধি মেনে চলতে হবে। বাংলাদেশের বন্দরে প্রবেশের সময় এনবিআর কর্মকর্তারা পণ্যবাহী গাড়ির সব তথ্য চেক করবেন। তবে সন্দেহ হলে বা বিশেষ প্রয়োজনে গাড়িতে তল্লাশি চালাতে পারবে। এ ছাড়া গাড়ির গতিবিধি লক্ষ্য রাখার জন্য লক ও সিল এবং গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম (জিপিএস) ব্যবহার করতে পারবে। এতে বলা হয়েছে, কোনো কারণে পণ্য ক্ষতিগ্রস্ত হলে, হারালে এবং কাস্টমস সিল ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাৎক্ষণিক এনবিআরকে জানাতে হবে। খসড়া চুক্তির অপর এক উপধারায় প্রস্তাবিত বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান ও নেপালের মধ্যকার মোটর ভেহিকল চুক্তির আওতায় চলাচলকারী গাড়িতে পণ্য পরিবহনের সুযোগ দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। যদিও এটি এখন কার্যকর হয়নি।

নৌ মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশের সড়ক ব্যবহার করে ভারতীয় পণ্য পরিবহনে নির্ধারিত চার্জ ও ফি পরিশোধ করতে হবে। তবে চার্জ ও ফি’র পরিমাণ কত হবে, তা স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউরে (এসওপি) উল্লেখ করা হবে। তারা বলেন, বিদ্যমান নৌপ্রটোকল চুক্তির আওতায় আশুগঞ্জ বন্দর থেকে আখাউড়া পর্যন্ত পণ্য পরিবহনে নামমাত্র ফি পরিশোধ করছে দেশটি। চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারের ক্ষেত্রেও একইভাবে আরোপিত চার্জ ও ফি ভারতকে পরিশোধ করতে হবে।
২০১৫ সালের ৬ জুন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারে ভারতকে সুযোগ দেয়ার বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হয়। ওই এমওইউর আলোকে এবার চুক্তি করতে যাচ্ছে দু’দেশ।

http://www.jugantor.com/first-page/2017/04/06/115409/