৬ এপ্রিল ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৯:৪১

ঘুমিয়ে আছে বিশ্ববিবেক

সামাজিক অবিচার, বৈষম্য ও বৈশ্বিক আগ্রাসন পৃথিবী নামক ছোট্ট এই গ্রহে মানুষের জীবন যাপনকে অস্থির ও দুঃখময় করে তুলেছে। বিষয়টি স্পষ্ট হওয়ার পরেও এ বিষয়ে সত্য ভাষণ খুব কমই শোনা যায়। যাদের কারণে মানুষের দুরবস্থা তারা তো ছলাকলায় বেশ পারদর্শী। পুরো পৃথিবীটাকে রঙ্গমঞ্চ বানিয়ে তারা এখন অভিনয় করে চলেছেন। পরাশক্তির দাপটের কথা তো আমরা জানি। পৃথিবীর নানা অঞ্চলে তারা সংকট সৃষ্টি করেন এবং সেই সংকট সুরাহায় তারা নেতৃত্ব প্রদানের অভিনয়ও করে যান। আর সবচাইতে দুঃখের বিষয় হলো, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর নেতা-নেত্রীরাও ওদের রচিত পাণ্ডুলিপিতে অভিনয় করার জন্য লাইন দিয়ে আছেন। এমন বাস্তবতায় বর্তমান সভ্যতায় মজলুম মানুষের মুক্তির পথ কঠিন হয়ে উঠছে। বর্তমান পৃথিবীতে জনপদগুলো নানাভাবে শোষিত-বঞ্চিত ও নিপীড়িত। মানুষের দুঃখ-বেদনা ও হাহাকারের মাত্রা বেড়ে চললেও আশাবাদের তেমন কোনো উদাহরণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। তাই বলে পৃথিবীতে কথামালার রাজনীতি কিন্তু থেমে নেই। এখনো বিশ্বনেতাদের অনেকেই কৃত্রিম কণ্ঠে ন্যায়, মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও ভ্রাতৃচেতনার কথা উচ্চারণ করে থাকেন। এমন নাটুকে সভ্যতার অবসান কখন হবে কে জানে?
জঙ্গিবাদ নিয়ে এখন অনেক কথা হচ্ছে। কথা বলেছেন ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের (আইপিইউ) মহাসচিব মার্টিন চুংগংও। তিনি বলেছেন, ‘সমাজে অসাম্য ও বিচারহীনতার কারণে সারাবিশ্বে সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদের সৃষ্টি হচ্ছে। এই অসাম্য তৈরি হয় রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে। আমাদের এ সম্মেলনের উদ্দেশ্য হলো তা দূর করা।’ রাজধানী ঢাকায় আইপিইউ সম্মেলনের প্রাক্কালে ৩১ মার্চ এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। মার্টিন চুং গং আরো বলেন, পৃথিবীতে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে ব্যাপক বৈষম্য রয়েছে। অনেক মানুষই পেছনে পড়ে আছে। এই পেছনে পড়ে থাকাদের সংখ্যা আমরা কমাতে চাই। এক প্রশ্নের জবাবে আইপিইউ মহাসচিব বলেন, আইপিইউ জাতিসংঘের সিকিউরিটি কাউন্সিল নয়, এটি কাউকে সিদ্ধান্ত মানতে বাধ্য করে না। তবে আইপিইউ এ বিষয়ে সরকার ও সংসদের নৈতিক দায়বদ্ধতা এবং সমাজ ও রাজনীতিকদের বিবেককে জাগ্রত করতে কাজ করে। এভাবেই বিশ্বের ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য কমাতে চায় আইপিইউ। উল্লেখ্য যে, ১৩১ সদস্য দেশের সংসদ সদস্যদের নিয়ে এবার আইপিইউ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে ঢাকায়। আইপিইউ মহাসচিব মার্টিন চুং গং তো সরকার ও সংসদের নৈতিক দায়বদ্ধতা এবং সমাজ ও রাজনীতিকদের বিবেককে জাগ্রত করার কথা বললেন। বর্তমান সভ্যতা ও বিশ্ব-বাস্তবতার প্রেক্ষিতে এর চাইতে গুরুত্বপূর্ণ কথা আর হতে পারে না। কিন্তু ভাবনার বিষয় হলো, বর্তমান সময়ে পৃথিবীতে যারা সরকার পরিচালনা করছেন, যারা সমাজ ও রাজনৈতিক অঙ্গনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তারা নৈতিক দায়বদ্ধতাকে কতটা গুরুত্ব দেন এবং বিবেকের আহ্বানে কতটা সাড়া দেন? সাড়া দেন না বলেই তো আজ পৃথিবীতে এত অন্যায়-অবিচার ও বৈষম্য। আর বর্তমান সময়ে বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের যে উত্থান লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তার দায়দায়িত্বও বিশ্ব নেতৃবৃন্দের ঘাড়েই বর্তায়। কিন্তু তারা তো তা স্বীকার করতে চান না। বরং চাতুর্যময় কথাবার্তা ও অভিনয় সৌকর্যে তারা উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে চলেছেন। ফলে বিশ্ব সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ থেকে মুক্ত হতে পারছে না। সত্য ও ন্যায়ের বদলে যদি ‘মিথ্যা’ পৃথিবীকে শাসন করতে থাকে তাহলে পৃথিবী আর কতকাল মানুষের বাসযোগ্য থাকবে? এ বিষয়টি পৃথিবীর ছোট-বড় সব দেশের নেতাদের ভেবে দেখা উচিত। পৃথিবীর চিন্তাশীল, বিবেকবান এবং প্রাগ্রসর নাগরিকরাও তাদের দায়িত্বের ব্যাপারে গাফেল থাকতে পারেন না। প্রসঙ্গত প্রশ্ন জাগে, বর্তমান সময়ে রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীরা দায়িত্বের বিষয়টিকে কোন্ মানদণ্ডে উপলব্ধি করেন? আদৌ কোনো মানদণ্ড আছে কী? এক্ষেত্রে আসলেই সংকট রয়েছে। এই সংকটের কারণেই পৃথিবী তার স্বাভাবিক চেহারা হারাচ্ছে। আর অপরাধীরা পরছে নানা ধরনের মুখোশ।
বিশ্ব রাজনীতি ও রাজনীতিকদের গ্রহণযোগ্যতা এখন প্রায় তলানিতে এসে ঠেকেছে। এমন মনোভাব শুধু যে শোষিত বঞ্চিত ও নিপীড়িত সাধারণ মানুষের মধ্যে বিরাজ করছে তা নয়, উন্নত বিশ্বের বিবেকবান মানুষের মধ্যেও এখন একই মনোভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নিজেদের দাপুটে ও দাম্ভিক নেতাদের ওপর তাঁরাও আর আস্থা রাখতে পারছেন না। বিশ্ব-রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে তাঁরাও তাঁদের নেতাদের চতুর অভিনেতা হিসেবেই ভাবছেন। এতদিন সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ নিয়ে যে এক ধরনের নাটক বা প্রহসন চলছে, তা বলার চেষ্টা করেছেন বিপর্যস্ত মুসলিম নাগরিকরা। এখন সেই উচ্চারণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে পাশ্চাত্যের বুদ্ধিজীবীদের কণ্ঠেও।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হয়তো নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে এবং রাজনৈতিক সমর্থন বাড়াতে সাজানো সন্ত্রাসী হামলার পরিকল্পনা করে বসতে পারেন। আর কেউ নয়, এমন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী নোয়াম চমস্কি। উল্লেখ্য যে, সম্প্রতি বেশ কয়েকটি ব্যর্থতার মুখে পড়তে হয়েছে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কয়েকটি দেশের নাগরিকদের ওপর তাঁর দুই দফা ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার কার্যকারিতা আদালত আটকে দিয়েছেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা প্রশাসনের স্বাস্থ্য সেবা কর্মসূচি ‘ওবামা কেয়ার’ উল্টে দেয়ার চেষ্টাও ব্যর্থ হয়। সংবাদ মাধ্যম প্রতিষ্ঠান অল্টারনেটকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে নোয়াম চমস্্কি বলেন, ভোটাররা যখন ট্রাম্পকে প্রতারক হিসেবে বিবেচনা করবে এবং তার প্রতিশ্রুতিগুলো ‘বালির উপর নির্মিত’ বলেই মনে হবে, তখন হয়তো জনপ্রিয়তা বাড়ানোর স্বার্থে ট্রাম্প চরমপন্থা অবলম্বনের দিকে ঝুঁকবেন। তিনি আরো বলেন, ‘আমার মনে হয়, সাজানো বা কথিত সন্ত্রাসী কর্মকা-ের সম্ভাবনার বিষয়টি আমাদের উপেক্ষা করা উচিত হবে না, যে ঘটনা মুহূর্তেই পুরো দেশকেই বদলে দেবে।’
নোয়াম চমস্কি নিজ দেশের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্পর্কে যে ধারণা পোষণ করেন, তা গুরুত্বের সাথে ভেবে দেখা প্রয়োজন। প্রসঙ্গত এখানে বলে রাখা প্রয়োজন যে, বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদকে উপাদান হিসেবে ব্যবহার করে যে পান্ডুলিপি তৈরি করা হয়েছে, তার অভিনেতা শুধু ট্রাম্প নন, আরো অনেকেই আছেন। ভাবতে অবাক লাগে, সন্ত্রাস বা জঙ্গীবাদের মত ঘটনা বর্তমান সভ্যতায় সাজানো হয়ে থাকে। আর সাজানো ঘটনাকে কেন্দ্র করে কত প্রোপাগান্ডা হয়, ইসলাম ও মুসলমানদের ইমেজ ক্ষুণœ করা হয়, নির্যাতন-নিপীড়ন হয় এবং পরাশক্তিদের পরিকল্পিত যুদ্ধে নিহত হয় অসংখ্য মুসলিম নর-নারী-শিশু, আর বিপর্যস্ত হয় মুসলিম জনপদগুলো। সাজানো সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ সম্পর্কে নোয়াম চমস্কির মত বুদ্ধিজীবী যখন কথা বলেন তখন কি বিশ্বের বিবেকবান মানুষদের জেগে ওঠা উচিত নয়? প্রশ্ন জাগে, ‘বিশ্ব-বিবেক’ বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব এখন পৃথিবীতে আছে কী?

http://www.dailysangram.com/post/278747-