১ এপ্রিল ২০১৭, শনিবার, ১০:২৪

আইএমইডির প্রতিবেদনে ব্যবস্থা নেয়ার তাগিদ

ধানমণ্ডি লেকের উন্নয়নে অনিয়ম

ধানমণ্ডি লেকের অবকাঠামো উন্নয়নে নেয়া ছোট একটি প্রকল্পে বড় রকমের অনিয়ম হয়েছে। ফলে প্রকল্পের সুফল বঞ্চিত হয়েছেন ঢাকাবাসী। প্রকল্পে অনিয়মের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ক্রটিপূর্ণ নির্মাণকাজ, অনুমোদিত উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবের (ডিপিপি) বাইরে কাজ করা, ঘন ঘন প্রকল্প পরিচালক বদলি, অডিট সম্পন্ন না করা, বাস্তবায়িত কম্পোনেন্ট অব্যবহৃত থাকায় অর্থের অপচয় এবং বাড়তি সময় ও ব্যয় বাড়ানো ইত্যাদি। প্রকল্পটির বাস্তবায়ন শেষ হওয়ার এক বছর পর পরিদর্শন করে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) এ চিত্র তুলে ধরেছে। সম্প্রতি প্রকাশিত সংস্থাটির এক মূল্যায়ন প্রতিবেদন থেকে আরও জানা গেছে, প্রকল্পটির উদ্দেশ্য পুরোপুরি অর্জিত হয়নি। কিছু ক্ষেত্রে পরিকল্পনা ও আর্থিক শৃংখলার পরিপন্থী কাজ করা হয়েছে এবং এসব বিষয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বাস্তবায়নকারী সংস্থাকে খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেয়ার তাগিদ দেয়া হয়েছে প্রতিবেদনে।
এ প্রসঙ্গে প্রকল্পটি পরিদর্শনকারী আইএমইডির কর্মকর্তা (বর্তমানে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব) মো. জাহাঙ্গীর আলম বৃহস্পতিবার টেলিফোনে যুগান্তরকে প্রথমে ‘মনে নেই’ বলে এড়িয়ে যেতে চাইলেও পরে বলেন, আমাদের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রকল্পটি পরিদর্শন করে যেসব ত্রুটি ও অনিয়ম পাওয়া গেছে সেগুলো প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। সঠিকভাবে এগুলো তুলে ধরা হয়েছে বলেই প্রতিবেদন অনুমোদন করাতে পেরেছিলাম। আমাদের এঙ্গেল থেকে ভুল হওয়ার সুযোগ নেই।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের আওতায় বাস্তবায়িত ‘ধানমণ্ডি লেকের ক্ষতিগ্রস্ত অবকাঠামো উন্নয়ন ও নাগরিক বিনোদন সুবিধা বৃদ্ধিসংক্রান্ত অবকাঠামো নির্মাণ’ প্রকল্পটি ২০১১ সালের এপ্রিল থেকে ২০১২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বাস্তবায়ন লক্ষ্য ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দুইবার সংশোধন করে ২০১৪ সালের জুনে সমাপ্ত হয়। এ ক্ষেত্রে এক বছর ৯ মাসের পরিবর্তে সময় লেগেছে তিন বছর তিন মাস। এ ছাড়া মূল অনুমোদিত ব্যয় ছিল ২৩ কোটি ৬৩ লাখ ৭৮ হাজার টাকা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে খরচ হয়েছে ২৪ কোটি ৫৩ লাখ ৭৮ হাজার টাকা। এ ক্ষেত্রে সামগ্রিকভাবে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে দেরি হওয়ায় ঢাকাবাসী বিশেষত ধানমণ্ডি এলাকাবাসী কাক্সিক্ষত মানের সেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। আইএমইডি বলেছে, প্রকল্পটি শেষ হওয়ায় এক বছর দুই মাসের মধ্যে ২০১৫ সালের ২৪ আগস্ট বাস্তবায়ন কার্যক্রম সরেজমিন পরিদর্শন করা হয়। এ সময় দেখা যায়, এক কোটি ৩৭ লাখ টাকা ব্যয়ে ওয়াকওয়ে পুনর্নির্মাণ করা হলেও পুরাতন ওয়াকওয়ে ও বর্ধিত ওয়াকওয়ের মধ্যে ফাটল ধরেছে। অনেক স্থানে ওয়াকওয়ের ইট সরে গেছে। এ ছাড়া ৬৫ লাখ ৩৭ হাজার টাকা ব্যয়ে এক দশমিক ২২ কিলোমিটার আরসিসি জগিং ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হলেও অল্প সময়েই উপরিভাগের আরসিসি রাস্তার স্টোন চিপস বেরিয়ে পড়েছে এবং ওয়াকওয়ের মাঝে ফাটল সৃষ্টি হয়েছে, যা স্বাভাবিক নয়। এ ছাড়া ড্রেনের পাশের এলাকা মাটিতে ভরাট হয়ে গেছে। বিষয়টি বাস্তবায়নকারী সংস্থা ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেয়ার তাগিদ দেয়া হয়েছে প্রতিবেদনে।
অন্যান্য অবকাঠামোর মধ্যে প্রকল্পের আওতায় ২ দশমিক ৪২ কিলোমিটার উন্মুক্ত ড্রেন ও ২ দশমিক ৫৭ কিলোমিটার পুরাতন ড্রেন সংস্কার করা হয়েছে। কিন্তু পাশের এলাকার মাটি এসে কিংবা গাছের লতাপাতা পড়ে অধিকাংশ উম্মুক্ত ড্রেন ভরাট হয়ে গেছে। এতে ড্রেনগুলো পানি নিষ্কাশনের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। প্রকল্পের আওতায় পুরাতন ফুটওভারব্রিজ সংস্কার ও দুটি নতুন ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু ফুটওভার ব্রিজগুলোর কোনোটির সিঁড়ির এক সারি ইট খোলা, সিঁড়ি ও ব্রিজের আরসিসি স্লাবের সংযোগস্থল এবড়ো-খেবড়ো, ব্রিজের মধ্যভাগ নিচের দিকে বেঁকে যাওয়া, কাঠের রুলার মাঝে মাঝে খুলে যাওয়ার ঘটনাও আছে। এ প্রসঙ্গে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা আইএমইডিকে জানিয়েছে, প্রকল্পের আওতায় পুরাতন ব্রিজগুলোর শুধু রেলিং ও স্লাব পরিবর্তন করা হয়েছে। কোনো পাইল-পিলার নির্মাণ করা হয়নি। তা ছাড়া লেকের শোভা বর্ধনের জন্য যে কম্পোনেন্টটি বাস্তবায়ন করা হয়েছে এর বেশ কিছু জিনিস ভালো থাকলেও খাবার পানির জন্য স্থাপিত ঝরনাগুলোর অধিকাংশ নষ্ট ছিল। নতুনভাবে লাগানো কোনো ঘাস বা ফ্লাওয়ার বোর্ডে লাগানো কোনো ফুলের গাছ পাওয়া যায়নি। প্রকল্পের অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী কোথাও কোনো বিলবোর্ডও দেখা যায়নি। অনুমোদিত পাঁচ জোড়া পাবলিক টয়লেট স্থাপনের স্থানে তিন জোড়া স্থাপন করা হয়েছে। এর মধ্যেও সীমান্ত স্কয়ারের কাছে স্থাপিত টয়লেটটিতে পাশের একটি রেস্টুরেন্টের বিভিন্ন উপকরণ রাখার কাজে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। প্রকল্পের আওতায় শিশুপার্ক নির্মাণ করা হলেও এর প্রবেশপথে গাছের ডালপালা স্তূপ করে রাখতে দেখা যায়। এ ছাড়া পার্কের একাংশে ভাঙা দোলনা, ব্যালান্স বার ভাঙা ও আগাছায় ভরপুর অবস্থায় দেখা যায়। অনুমোদিত ব্যয়ের চেয়ে দিগুণের বেশি ব্যয়ে অর্কিড প্লাজা নির্মাণ করা হলেও অর্কিড জাতীয় কোনো গাছ পাওয়া যায়নি। বরং সেগুলো আগাছায় পরিপূর্ণ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অনুমোদিত ডিপিপির বাইরে বিভিন্ন কাজ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে ডিপিপির অনুমোদিত ধানমণ্ডি ৬ নম্বর রোডে ২৫ লাখ টাকা ব্যয়ে অর্কিড প্লাজা স্থাপনের বিপরীতে ৬৯ লাখ ৯০ হাজার টাকা ব্যয়ে কলাবাগান ক্রিকেট মাঠের উত্তরে মিরপুর রোডে নির্মাণ করা হয়েছে। এ ছাড়া ১৯১৫ মিটার সীমানা প্রাচীর নির্মাণের জন্য এক কোটি ৪১ লাখ ৯৫ হাজার টাকা বরাদ্দের বিপরীতে দুই কোটি ৯৫ লাখ ৯৬ হাজার টাকা ব্যয়ে ২৫৩৬ মিটার সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করা হয়েছে। পাঁচ হাজার ৫০০ ঘনমিটার মাটি দিয়ে লেকের উন্নয়নে ৩২ লাখ টাকা বরাদ্দের বিপরীতে ৬৩ লাখ পাঁচ হাজার টাকা ব্যয়ে ১৭ হাজার ৯৭৮ দশমিক ৯৫ ঘনমিটার মাটির কাজ করা হয়েছে। প্রকল্প এলাকায় ওয়াইফাই সুবিধার জন্য ২৬ লাখ টাকা বরাদ্দ থাকলেও ওয়াইফাই স্থাপন করা হয়নি। ডিপিপি সংশোধন ছাড়াই এ ধরনের আন্তঃঅংগ সমন্বয়, ব্যয় বা কম্পোনেন্টের হ্রাস-বৃদ্ধি বা স্থান পরিবর্তন পরিকল্পনা ও আর্থিক শৃংখলার পরিপন্থী। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় খতিয়ে দেখতে পারে। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, প্রকল্পের আওতায় নির্মিত অর্কিড প্লাজা, শিশুপার্ক, একটি পাবলিক টয়লেট, একটি পর্যবেক্ষণ ডেক অব্যবহৃত থাকায় এর অবকাঠানো নষ্ট হচ্ছে। অন্য দিকে, বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হলেও জনগণ যেমন সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন তেমনি সরকারও রাজস্ব প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, এ প্রকল্পটি ছোট একটি প্রকল্প হলেও নয়জন প্রকল্প পরিচালক কাজ করেছেন। এ ক্ষেত্রে একজন প্রকল্প পরিচালক সর্বনিন্ম মাত্র তিন দিন ও সর্বোচ্চ ১০ মাস চার দিন দায়িত্ব পালন করেছেন। আইএমইডি বলেছে, ঘনঘন প্রকল্প পরিচালক বদলির ফলে প্রকল্পের সাবলীল অগ্রগতি ব্যাহত হয়েছে।

http://www.jugantor.com/last-page/2017/04/01/113857/