খুলনা : কচুরিপানা ও ময়লা-আবর্জনায় ভয়পুর এক সময়ের প্রমত্তা ময়ূর নদী
১ এপ্রিল ২০১৭, শনিবার, ১০:২১

অব্যাহত দখল রক্ষণাবেক্ষণে অবহেলা ও মাত্রাতিরিক্ত দূষণে ময়ূর নদীর পানি সম্পূর্ণ ব্যবহার অনুপযোগী

# মহানগরীঘেঁষা এ নদীটি অচিরেই হারিয়ে যেতে পারে
অব্যাহত দখল, রক্ষণাবেক্ষণে অবহেলা ও মাত্রাতিরিক্ত দূষণে এ নদীর পানি সম্পূর্ণ ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। নিঃশেষের পথে খুলনা মহানগরীর অন্যতম গর্ব ময়ূর নদী। বর্তমানে এ নদীর পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ গ্রহণযোগ্য মান মাত্রার চেয়ে কম থাকায় এ পানি কৃষি ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা যাচ্ছে না। ফলে খুলনা মহানগরী ঘেঁষা এ নদীটি অচিরেই হারিয়ে যেতে পারে। খুলনা বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তর ও সিটি কর্পোরেশনের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, খুলনা মহানগরীর পশ্চিম পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ময়ূর নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ২২ কিলোমিটার। এই নদী এক সময়ে এ অঞ্চলের মানুষের সুপেয় পানি ও মাছের অন্যতম আধার ছিল। পাশাপাশি কৃষি ক্ষেত্রের কাজে ব্যবহার হতো এ নদীর পানি। কিন্তু অপরিকল্পিত নগরায়ন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার শিকার হয়ে এ নদীর পানি দূষিত হয়ে পড়েছে।
অপরদিকে অপ্রতিরোধ্য দখলে দিন দিন ময়ূর নদী তার আয়তনও হারাচ্ছে। এই নদীর পানি নিয়ে খুলনার পরিবেশ অধিদপ্তর ২০১১ সালে পরীক্ষা শুরু করে। ওই পরীক্ষায় নদীর পানিতে দিন দিন দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা কমে আসছে বলে তথ্য মিলেছে। যা জলজ প্রাণির বেঁচে থাকা ও কৃষিকাজে ব্যবহার অনুপযোগী। পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা ১৯৯৭ অনুযায়ী, মাছসহ জলজ প্রাণী বেঁচে থাকা ও নদীর পানি কৃষি কাজে ব্যবহারের জন্য পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন সর্বনি¤œ প্রতিলিটারে ৫ মিলিগ্রাম থাকার কথা। কিন্তু ২০১১ সালের নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষাকালে পানিতে দ্রবীভুত অক্সিজেনের মাত্র ছিলো প্রতিলিটারে ৪ মিলিগ্রাম। যা কমে বর্তমানে এসে গড়ে প্রতিলিটারে ২ মিলিগ্রামের এসে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থায় গত বছরের ১৮ আগস্ট পরিবেশ অধিদপ্তর নদীটিকে রক্ষায় সিটি কর্পোরেশন, বিভাগীয় ও জেলা প্রশাসন, খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠান, সুশীল সমাজ, এনজিও ও পরিবেশ অধিদপ্তর খুলনাকে যৌথভাবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিলেও এখনও পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়েনি।
পরিবেশ অধিদপ্তর খুলনার সিনিয়র কেমিস্ট মো. কামরুজ্জামান সরকার বলেন, দিন দিন ময়ূর নদীর পানিতে দ্রবভূত অক্সিজেনের মাত্রা কমছে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে নদীর পানিতে প্রতি লিটারে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা ছিল ১.১, ফেব্রুয়ারিতে যা দাঁড়িয়েছে ১.৩ মিলিগ্রাম। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে বায়োলজিক্যালি অর্থাৎ বৈজ্ঞানিকভাবে এই নদী মৃত হয়ে যেতে পারে।
তার দেয়া তথ্য অনুযায়ী, গত বছর মার্চ মাসে ওই নদীর প্রতি লিটার পানিতে অক্সিজেনের দ্রবীভূত মাত্রা ছিলো শূণ্য দশমিক ৫ মিলিগ্রাম, মে মাসে শূণ্য দশমিক ৮, জুনে শূণ্য দশমিক ৮, জুলাইয়ে দুই দশমিক ১, আগস্টে দুই দশমিক ৫, সেপ্টেম্বরে দুই দশমিক ৮ ও অক্টোবরে দুই দশমিক ৯ মিলিগ্রাম।
অপরদিকে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) গবেষণা অনুয়ায়ী, আরএস খতিয়ানে ময়ূর নদীর যে এলাকা ছিল সেখান থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত নদী দখল হয়েছে ৫ দশমিক ১২ শতাংশ, ২০০৪ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত নদীর আরও ৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ জমি দখলদারদের কবলে চলে গেছে। আর ২০১০ থেকে ২০১৪ এই চার বছরে নদী তার সর্বশেষ আয়তনের ৪ দশমিক ১৭ শতাংশ হারিয়েছে।
ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক তুষার কান্তি রায় তার গবেষণার তথ্য দিয়ে বলেন, ময়ূর নদীর পানির স্বাভাবিক পানি প্রবাহ বর্তমানে চরমভাবে বাধাগ্রস্ত। রূপসা নদীর সঙ্গে সংযোগ স্থলে স্লুইজগেট নির্মাণ ও তা রক্ষণাবেক্ষণ না করায় ময়ূর একটি বদ্ধ জলাধারে পরিণত হয়েছে। এর ফলে এই পানিতে দূষণের মাত্রা দিন দিন বাড়ছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর খুলনার একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, খুলনা সিটি কর্পোরেশনের ২৬টি ড্রেন থেকে বর্জ্যমিশ্রিত পানি প্রতিনিয়ত পড়ছে ময়ূর নদীতে, যার ফলে এই নদীতে মারাত্মক দূষণের সৃষ্টি হয়েছে। অপরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ বিষয়ে অসচেতনতা, অপর্যাপ্ত পানি প্রবাহসহ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ঐতিহ্যবাহী এই নদীটি রাজধানীর বুড়িগঙ্গা, নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা ও তুরাগের মতো দূষণের পর্যায়ে উপনীত হয়েছে।
খুলনা সিটি কর্পোরেশনের (কেসিসি) চীফ প্লানিং অফিসার আবীর উল জব্বার বলেন, ‘ময়ূর নদী বাঁচাতে আমরা যে পরিকল্পনা নিয়েছি তা কতিপয় স্বার্থান্বেষী মহলের কারণে বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না।
ময়ুর নদীকে ঘিরে এখনও পর্যন্ত যে কটি পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে তা মামলার কারণে আটকে রয়েছে। এছাড়াও নগরীর সোয়ারেজ ব্যবস্থা না থাকায় বর্জ্যও ড্রেনের মাধ্যমে ময়ূর নদীতে পড়ছে। কিন্তু এ ব্যাপারে ওয়াসা কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে না। তবে ময়ুর নদী দূষণ রোধ ও ড্রেনেজ ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে ২০১৭ সাল থেকে আটশ’ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫ বছর মেয়াদী একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সিটি কর্পোরেশন। দাতা সংস্থার অর্থায়ন পেলে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। এগুলি বাস্তবায়ন হলে ঐতিহ্যবাহী এ নদীটিকে রক্ষা করা সম্ভব হবে।

http://www.dailysangram.com/post/277940-