১ এপ্রিল ২০১৭, শনিবার, ১০:১৯

লোকসান ঠেকাতে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের

রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলো আমানতের অর্ধেকও ঋণ দিতে পারছে না। খেলাপি হতে পারে এমন আশঙ্কায় ঋণ দিচ্ছে না এসব ব্যাংক। আমানতের প্রবৃদ্ধির চেয়ে অনেক কম হচ্ছে ঋণের প্রবৃদ্ধি। এই উল্টোচিত্র ভাবিয়ে তুলছে ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে। বিশেষজ্ঞদের মতে একটি ব্যাংক রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন রেখে বাকি ব্যাংকগুলো বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া যেতে পারে। এভাবে ভর্তুকি দিয়ে ব্যাংকগুলোকে বেশিদিন টিকিয়ে রাখা যাবে না।
রাষ্ট্রীয় ৮টি ব্যাংকে এমন চিত্র নতুন কিছু নয়। গত ৪০ বছর ধরেই এ অবস্থার উন্নতির চেষ্টা চলছে। এর মধ্যে গত ২০০৩ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত কিছুটা ভাল ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাংকগুলো। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে এসব ব্যাংকের শাখাগুলোর ওপর ঋণ দেয়ার বাধ্যবাধকতা আরোপ করছেন কোন কোন ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
বিশ্লেষকরা বিষয়টিকে দেখছেন চূড়ান্ত অদক্ষতা হিসেবে। তাদের মতে, যেকোন একটি ব্যাংক বাদে বাকিগুলোকে বেসরকারিখাতে ছেড়ে দেয়াই এর একমাত্র সমাধান। এভাবে বছরের পর বছর ভর্তুকি দিয়ে সমস্যা স্থায়ী করার কোন মানে হয় না।
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সোনালী ব্যাংক। আমানতের ৮০ দশমিক ৫০ শতাংশ বিনিয়োগ করার কথা থাকলেও সবশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী ব্যাংকটি মাত্র ৩৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ বিনিয়োগ করতে পেরেছে। ব্যাংকটির আমানতের প্রবৃদ্ধি যেখানে ১৩ দশমিক ৪০ শতাংশ সেখানে ঋণের প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৬৪ শতাংশ।
রুপালী ব্যাংকের আমানতের ৫৮ দশমিক শূন্য চার শতাংশ বিনিয়েগ করা হয়েছে। তাদেরও বিনিয়োগ করার কথা ছিল আমানতের ৮০ ভাগ। কিন্তু এ ব্যাংকটিও অনেক পিছিয়ে রয়েছে।
আগ্রণী ব্যাংকের আমানতের ৮০ ভাগ বিনিয়োগের কথা থাকলেও তারা বিনিয়োগ করেছে মাত্র ৫৩ দশমিক শূণ্য ৩ শতাংশ। এ ব্যাংকটির আমানতের প্রবৃদ্ধি রয়েছে ১০ শাতাংে শর উপরে। আর ঋণ প্রবৃদ্ধি রয়েছে ৭ শতাংশের উপরে। একই অবস্থা বিরাজ করছে রাষ্ট্রীয় কৃষি ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক।
এ ব্যাপারে আগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও শামস-উল-ইসলাম বলেন, লাভের টার্গেট নিয়েই আমরা কাজ করছি। লোকসান কাটিয়ে উঠতে আমরা বেশি নতুন প্রকল্পও হাতে নিয়েছি। কিন্তু তাতে তেমন কাজ হচ্ছে না। তাছাড়া ঋণ দেয়া ক্ষেত্রে আগের চেয়ে অনেক সর্তক রয়েছি। আর এ কারণেই ঋণ প্রবৃদ্ধি কমেছে। আর এতে করে আমানতের পরিমান বেড়েছে।
আহসান এইচ মনসুর বলেন,গত ৪০ বছর ধরেই অবস্থার উন্নতির চেষ্টা চলছে। কিন্তু কোন কাজে আসেনি। ২০০৩ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত এসব ব্যাংকের অবস্থা কিছুটা ভাল ছিল। কারন তখন সরকার বেশ মনিটরিং করেছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও অনেক সর্তক ছিল। ২০০৯ সালেও পরে এসব ব্যাংকগুলোর অবস্থার আরও বেশি অবনতি হয়েছে। এসব ব্যাংক আর ঘুরে দাড়ানোর কোন সুযোগ নেই।
তিনি আরও বলেন, ঋণ দিয়ে খেলাপি হওয়ার চেয়ে ঋণ না দেয়াই ভাল। তবে এভাবে কোন ব্যাংক টিকিয়ে রাখা খুবই কঠিন।
অর্থনীতিবিদ সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার বলেন, শুধুমাত্র একটি ব্যাংক সরকারি রেখে বাকি ব্যাংকগুলো বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া যেতে পারে। এতগুলো ব্যাংক সরকারের হাতে রাখার কোন মানে হয়না। ভর্তুকি দিয়ে এসব ব্যাংক টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে।
একইভাবে বিভিন্ন সময় নানা সমস্যার কথা উঠে এসেছে ব্যাংকগুলোর কর্তৃপক্ষের তরফ থেকেই। বড় সমস্যার মধ্যে রয়েছে মূলধন ঘাটতি ও ঋণ খেলাপি। এই মূলধন ঘাটতি পূরণ করতে প্রায়ই সরকারের কাছে অর্থায়ন চায় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এসব ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ি ২০১৬ সাল শেষে সোনালি ব্যাংকের ঘাটতি ৩ হাজার ৪৭৪ কোটি টাকা, রুপালী ব্যাংকের ৭১৪ কোটি, কৃষি ব্যাংকের ৭ হাজার ৮৩ কোটি আর রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ৭৪২ কোটি টাকা। বেসিক ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি রয়েছে ২ হাজার ৪২৩ কোটি টাকা। জনতা ব্যাংকের ঘাটতি ৭৭১ কোটি টাকা এবং অগ্রণী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি রয়েছে ২০০ কোটি টাকা। ফলে মূলধন জোগানই এই রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর বড় চ্যালেঞ্জ।
বিশ্লেষকদের অভিমত, রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন মূলক কাজে বা জনগনের স্বার্থে সরকার অর্থায়নের মাধ্যমে ব্যাংকগুলোকে সহায়তা করতে পারে। তবে শুধু সরকারের সহায়তা নিলেই নয় ঋণ খেলাপি কমানোর পাশাপাশি ব্যাংকগুলোকেও ভালো কার্যক্রম উপহার দিতে হবে।
রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি পূরণে যে শর্ত দেওয়া হয়েছিল সেগুলো যথাযথভাবে পালিত হ”েছ কি না তা খতিয়ে দেখতে বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। চিঠিতে শর্ত পূরণের সর্বশেষ অব¯’া সম্পর্কে জানাতে বলা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পাঠানো তথ্যে কোনো ব্যাংক মূলধন ঘাটতি পূরণে সরকার প্রদত্ত শর্ত পূরণে ব্যর্থ প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যব¯’া নেওয়া হবে বলে সূত্র জানিয়েছে।
সূত্র জানায়, ঋণ বিতরণে বিভিন্ন অনিয়ম আর দুর্নীতির কারণে পর্যাপ্ত মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থ হচ্ছে সরকারি ব্যাংকগুলো। ব্যাংকগুলোর আর্থিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে সরকারও প্রতিবছর শর্তসাপেক্ষে মূলধন ঘাটতি পূরণে টাকা দিচ্ছে। তারপরও অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে না। এ অবস্থায় মূলধন ঘাটতি পূরণে সরকার প্রদত্ত সহায়তা সঠিকভাবে ব্যবহার হচ্ছে কি না তা নিশ্চিত করতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
সূত্র জানায়, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, অব্যবস্থাপনা ও তদারকির অভাবে ব্যাংকিং খাতে মন্দ ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। এতে সরকারি ব্যাংকগুলো মূলধন সংকটে পড়ছে। রাজনৈতিক চাপ ও ব্যাংকে অব্যবস্থাপনার কারণে মূলধন ঘাটতি বাড়ছে। আর এর খেসারত দিতে জনগণের ঘাড়ে করের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছর বাদে ২০০৯-২০১০ অর্থবছর থেকে প্রতি অর্থবছরই সরকারি ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি পূরণে ৫ হাজার কোটি টাকা করে বরাদ্দ রাখা হয়েছে। দফায় দফায় পূরণ করা হয়েছে ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি। তবে মূলধন ঘাটতি পূরণে অর্থ বিভাগ থেকে চারটি শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়। এগুলো হলো- অর্থ ব্যয়ে প্রচলিত সব আর্থিক বিধি-বিধান এবং অনুশাসন যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে। মূলধন পুনর্ভরণ ছাড়া এ অর্থ অন্য কোনো খাতে ব্যবহার করা যাবে না। ব্যাংকটির অটোমেশন এবং বিজনেস প্ল্যান বাস্তবায়নের অগ্রগতি, বিশেষ করে, পুঞ্জিভূত খেলাপি ঋণের বৃদ্ধি/হ্রাস ত্রৈমাসিকভিত্তিতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে জানাতে হবে। সর্বশেষ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে পর্যালোচনা সভা আয়োজন এবং সভার কার্যবিবরণী অর্থ বিভাগে পাঠাতে হবে বলে শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়।
সূত্র জানায়, মূলধন পুনর্ভরণ বাবদ অর্থ পাওয়ার পর ব্যাংকের অনুমোদিত মূলধনের চেয়ে পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ বেশি হলে মেমোরেনডাম অব এসোসিয়েশন সংশোধন করতে হবে বলে শর্ত দেওয়া হয়। ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতির পরিমাণ না কমায় এসব শর্ত পূরণ হচ্ছে কি না তা খতিয়ে দেখতে চাইছে সরকার। বিশেষ করে মূলধন ঘাটতির টাকা সঠিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে কি না তা জানতে চাইছে সরকার।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, সরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে মূলধনের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি নাজুক অবস্থায় বিশেষায়িত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক। সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকটির ঘাটতি ৬ হাজার ৯৮১ কোটি টাকা, জুনে যা ছিল ৭ হাজার ৪১৬ কোটি টাকা। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২ হাজার ৪২৩ কোটি টাকার ঘাটতি বেসিক ব্যাংকের, জুনে যা ছিল ২ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা। এরপরে সোনালী ব্যাংকের ঘাটতি ২ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা, জুনে এর পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৬০৬ কোটি টাকা।
এ ছাড়া সেপ্টেম্বর শেষে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন রূপালী ব্যাংকের ঘাটতি ১ হাজার ৩৬৮ কোটি টাকা। জুনে ব্যাংকটির ঘাটতি ছিল ১ হাজার ৫৩ কোটি টাকা। জনতা ব্যাংকের ঘাটতি ৭৭১ কোটি টাকা, জুন শেষে মূলধন ঘাটতি ছিল ৬৬৪ কোটি টাকা। তবে সেপ্টেম্বরে অগ্রণী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ২০০ কোটি টাকা থেকে কমে ১১২ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। বিশেষায়িত রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ঘাটতি ৭২৬ কোটি টাকা, জুনে এর পরিমাণ ছিল ৬৯৯ কোটি টাকা।
ব্যাংকগুলোর আর্থিক সুস্থতা ও স্থিতিশীলতার অন্যতম পরিমাপক হচ্ছে মূলধন পর্যাপ্ততা। আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং নীতিমালা ব্যাসেল-৩-এর আলোকে ব্যাংকগুলোর মূলধন রাখতে হচ্ছে। এর আগে ব্যাসেল-২ নীতিমালার আলোকে ন্যূনতম ৪০০ কোটি টাকা অথবা ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ১০ শতাংশ, এর মধ্যে যেটি বেশি সে হারে মূলধন রাখতে হতো। এখনো একই হারে মূলধন রাখতে হচ্ছে। তবে পরিবর্তনটা এসেছে উদ্যোক্তা মূলধন রাখার বেলায়। এখন ১০ শতাংশের মধ্যে উদ্যোক্তা মূলধন রাখতে হচ্ছে ন্যূনতম সাড়ে ৪ শতাংশ। এ ছাড়া ব্যাংকিং পরিভাষায় টিআর-১ ও টিআর-২ নামে পরিচিত ঘরে আলাদাভাবে মূলধনের হিসাব করা হচ্ছে। নতুন এ নীতিমালা বাস্তবায়নে ব্যাংকগুলো ২০১৯ সাল পর্যন্ত সময় পাবে।

http://www.dailysangram.com/post/277933-