পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে সুন্দরবনের বৃক্ষ এভাবে ধ্বংস হচ্ছে। ছবিটি সুন্দরবন এলাকার দুবলার চর থেকে তোলা -সংগ্রাম
১ এপ্রিল ২০১৭, শনিবার, ১০:১৮

কপোতাক্ষ ও বেতনা খননের নামে ২৬২ কোটি টাকার হরিলুট চলতি বর্ষা মওসুমে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে জলাবদ্ধতার আশঙ্কা

আবু সাইদ বিশ্বাস, সাতক্ষীরা : ভারতের একতরফা পানি নিয়ন্ত্রণ, ফারাক্কা বাঁধ, মানবসৃষ্ট বিভিন্ন অব্যবস্থাপনা, নদী খননের নামে সরকারি টাকা হরিলুটসহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে সাতক্ষীরার বেশিরভাগ নদ-নদী হারিয়ে যেতে বসেছে। ফলে বাড়ছে জলাবদ্ধতা, কমছে ফসল উৎপাদন। সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় ২৭টি নদী রয়েছে। এদিকে কপোতাক্ষ ও বেতনা খনন প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে জেলার সবকটি নদী এখন মরা খালে পরিণত হয়েছে। এসব নদীকেন্দ্রিক খালগুলোর তলদেশ ফেঁটে চৌচির হয়ে গেছে। সূত্র জানায়, সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের দুটি বিভাগে ২১৬টি স্লুইস গেটের মধ্যে ২৮টি সম্পূর্ণ অকেজো, ৫০টির তলদেশ পলি জমে উঁচু হয়ে যাওয়ায় এগুলো পানি নিষ্কাশন ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। ফলে চলতি বর্ষা মওসুমে এ জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে জলাবদ্ধতার আশঙ্কা করছে ভুক্তভোগী পরিবার।
২০১১ সালে একনেকের বৈঠকে কপোতাক্ষ নদ খননের জন্য ৪ বছর মেয়াদী প্রায় ২৬২ কোটি টাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। প্রকল্পের বেশিরভাগ টাকায় লুটপাট হয়েছে। কাজের কাজ কিছুই হয়নি। স্কেবেটর মেশিন দিয়ে চেঁছে দায়সারা গোছের খনন করা হয়েছে। কপোতাক্ষ নদ খননের নকশা অনুযায়ী তলদেশ’র প্রস্থ হবে স্থান বিশেষে ১০৩ থেকে ১৩০ ফুট। মাথায় প্রস্থ হবে স্থান বিশেষ ১৪৮ থেকে ২০৩ ফুট এবং গভীরতা হবে স্থান বিশেষ ১০ থেকে ১৪ ফুট। কিন্তু খনন করা হয়েছে, তলদেশ প্রস্থ মাত্র ৩৩ ফুট, মাথায় প্রস্থ মাত্র ৪৯ ফুট ও গভীরতা সাড়ে ৬ ফুট। খননকৃত মাটি ১৭০ ফুট দূরে ফেলার কথা থাকলেও মাটি ফেলা হয়েছে নদীর মাঝখানে। বর্ষা আসলেই এসব মাটি ধসে আবারও নদী ভরাট হয়ে যাচেছ। ২৫ কোটি টাকার খনন করা হয়েছে সাতক্ষীরার এক সময়ের প্রমত্তা বেতনা নদী। কিন্তু খননের পূর্বের অবস্থার চেয়ে বর্তমান অবস্থা আরো খারাপ। খনন কাজের পূর্বে নদীটি কমপক্ষে ১৫০ থেকে ২০০ মিটার চওড়া ছিল। কিন্তু খননের পর নদীটি পরিণত হয়েছে নালায়। স্থানীয়দের অভিযোগ, যাচ্ছে তাইভাবে নদীটি খনন করায় দুর্ভোগ আরও বেড়েছে। বেতনা নদীর মাঝ বরাবর খনন করার কথা ছিল ১০ থেকে ১৮ ফুট। কিন্তু বাস্তবে তার কিছুই হয়নি। কেবল বিনেরপোতা ব্রিজের কাছে দুই থেকে তিন ফুট গভীর করে খোঁড়া হয়েছে। কোথাও এক ফুটের বেশি মাটি তোলা হয়নি। উপকূলীয় অঞ্চলের উন্নয়নে সাতক্ষীরার বেতনা নদী খনন ও পাড় বাঁধাই করার জন্য ২৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিল সরকার। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, ২৫ কোটি টাকার ওই প্রকল্পে নামমাত্র কাজ করে টাকা তোলার অভিযোগ আছে ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে। স্থানীয়রা জানান, সাতক্ষীরায় বেতনা ছাড়াও মরিচ্চাপ নদী অদক্ষ পরিকল্পনার শিকার হয়েছে। এক সময়ের স্রোতসিনী নদী এখন নালা। এছাড়া যমুনা, শালতা, শালিখা, সাপমারাসহ বিভিন্ন নদী-খালের অবস্থাও একই। জেলা সদরের লাবসা ইউনিয়নের বিনেরপোতা থেকে ব্রহ্মরাজপুর হয়ে ধুলিহর ইউনিয়নের সুপারিঘাটা পর্যন্ত বেতনা নদী সরু নর্দমায় পরিণত হয়েছে। মাছখোলা, দামারপোতা, শালো, বেড়াডাংগি, বড়দল, মাটিয়াডাংগা, নেহালপুর, তেঁতুলডাংগা গোবিন্দপুরসহ বিভিন্ন এলাকার পানি নিষ্কাশনের খালগুলো প্রভাবশালীরা দখল করে মাছের ঘের তৈরি করেছে। ফলে বন্ধ হয়ে গেছে পানি নিষ্কাশনের সব পথ। কপতাক্ষ ও বেতনা নদীর চর দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে ইটের ভাটা। খালের ঢালু পাড় বাঁধাই করে দেয়ার কথা থাকলেও শুধু কাদার প্রলেপ দেয়া হয়েছে। চর কেটে মাঝ দিয়ে উঁচু বেড়িবাঁধ তৈরি করায় নদী সরু হয়ে এসেছে। সাতক্ষীরা শহরের অভ্যন্তরে প্রবাহিত প্রাণশায়ের খালে পানি প্রবাহ বন্ধ হয়ে পড়েছে। ফলে দুর্বিসহ হয়ে পড়েছে শহরের জীবন।
বেশিদিন আগের কথা নয়। মাত্র দুই যুগ আগেও দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো সাতক্ষীরা জেলা ছিল সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামল, ধন-ধান্যে-সম্পদে-ঐতিহ্যে ভরপুর। এই অঞ্চলের মানুষ নিরীহ, ধর্মভীরু ও অতিথিপরায়ণ। অর্থনৈতিকভাবেও ছিল সফল। অধিকাংশ মানুষই ছিল আত্মনির্ভরশীল।
অর্থনীতির মূল বুনিয়াদ ছিল কৃষি। আখ, পাট, মাছ, গবাদিপশু, মূল্যবান বৃক্ষাদি ছিল প্রধান সম্পদ। তবে তাঁত, বাঁশ, মৃত্তিকা, বেত এবং মাদুরশিল্প এলাকার মানুষের আর্থিক উপার্জনের সহায়ক ছিল। কামার, কুমার, কাঠমিস্ত্রী, রাজমিস্ত্রীর খোদাই কাজ অবিভক্ত বাংলায় সুখ্যাতি বয়ে আনে। বছরের ছয়মাস ধরে চলতো গুড়পুকুরের মেলা। সাতক্ষীরার পাটকেলঘাটা, জেঠুয়া মাগুরা, তালা উপজেলা সদর, খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলা সদর, চুকনগর, কপিলমুনি, যশোরের নওয়াপাড়া রাজঘাট প্রসিদ্ধ বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল। পণ্য বহনের জন্য বাহারি বাণিজ্যিক নৌকায় ঠাসা থাকতো কপোতাক্ষ, ভবদহ, ভৈরবসহ সব নদীর তীর। কিন্তু এসব এখন অতীত। কপোতাক্ষ নদের প্রায় ৩০ কিঃ মিঃ এখন পলি পড়ে বিলুপ্ত হওয়ার পথে। ফলে বেতনা ও কপোতাক্ষের দু’কুলে যশোর-সাতক্ষীরা-খুলনার প্রায় ২০ লাখ মানুষ বছরে ছ’মাস পানিতে তলিয়ে থাকে। মানুষ বাড়ি ঘর ছেড়ে স্কুল, কলেজ ও উঁচু রাস্তার পাশে আশ্রয় নেয়। বর্তমানে সাতক্ষীরায় হাজার হাজার বিঘা চিংড়ি ঘের আছে। চিংড়ি চাষের ফলে কর্মহীন হয়ে পড়েছে হাজার হাজার কর্মজীবী কৃষক। একদিন পুরুষ-মহিলা সকলকে সারাবছর ব্যস্ত থাকতে হতো ধান-পাট কৃষিপণ্য উৎপাদন এবং এগুলো গুছিয়ে ঘরে উঠানোর জন্য। বর্তমানে কৃষক হারিয়েছে জমি, গবাদি পশু, গাছ-গাছালি। সব মিলিয়ে এখানকার মানুষ এখন দারুণ কষ্টে আছে। দেশের পত্র-পত্রিকাগুলো উত্তরবঙ্গের মঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে বার বার রিপোর্ট প্রকাশ করলেও এই এলাকার মানুষের দুর্দশার কথা কেউ প্রকাশ করে না। বিভিন্ন সময়ে সরকার এখানকার পানিবদ্ধতার স্থায়ী সমাধানের আশ্বাস দিলেও বাস্তবে কিছু হয়নি। ভুক্তভোগীরা আশা করে সরকারের সর্বোচ্চ মহল বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দেবে এবং জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

http://www.dailysangram.com/post/277925-