৩১ মার্চ ২০১৭, শুক্রবার, ৭:২৭

ঝিনাইদহে পাঁচ, চট্টগ্রামে তিন, নওগাঁয় তিন এবং রাজশাহীর বাগমারা থেকে একজনকে নিয়ে যাওয়া হয়

৪ জেলায় ১২ জনকে তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ

দেশের চার জেলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে গত ১০ দিনে কমপক্ষে ১২ জনকে তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। ঝিনাইদহে পাঁচজন, চট্টগ্রামে এক পরিবহন ব্যবসায়ী ও তাঁর দুই শ্যালক, নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলা থেকে তিন যুবক এবং রাজশাহীর বাগমারা থেকে এক ব্যক্তিকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে এসব অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে।
ঝিনাইদহে ১০ দিনের ব্যবধানে বিভিন্ন স্থান থেকে পাঁচ ব্যক্তিকে পুলিশ পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। এর মধ্যে কোটচাঁদপুর উপজেলা থেকে তিনজন ও সদর উপজেলা থেকে দুজনকে নিয়ে যাওয়া হয়। নিখোঁজ ব্যক্তিদের মধ্যে স্থানীয় একটি কলেজের অধ্যক্ষও রয়েছেন।
নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবার সূত্রে জানা গেছে, গত ২২ মার্চ কোটচাঁদপুরের জালালপুর গ্রামের ইমরুল হোসেন, সদর উপজেলার কাশিমনগর গ্রামের ইব্রাহিম গাজি ও রেজাউল ইসলামকে পুলিশ পরিচয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। এ ছাড়া কোটচাঁদপুরের বলাবাড়িয়া গ্রামের আলম খানকে গত মঙ্গলবার রাতে নিজ বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া হয়। আর কোটচাঁদপুর পৌর কলেজের অধ্যক্ষ হুমায়ন কবিরকে বুধবার দুপুরে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।
সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলোর স্বজনেরা বলছেন, তাঁরা কোথাও নিখোঁজ ব্যক্তিদের সন্ধান পাচ্ছেন না। থানায় খোঁজ নিতে গেলে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এ বিষয়ে তাঁরা কিছুই জানেন না।
নিখোঁজ ইমরুল হোসেনের স্ত্রী চম্পা খাতুন বলেন, ২২ মার্চ রাত ১২টার পর পুলিশ পরিচয়ে কয়েকজন বাড়ির দরজা খুলতে বলেন। দরজা খোলার পর ইমরুলকে বের করে গাড়িতে তোলা হয়। কী কারণে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, জানতে চাইলে ওই ব্যক্তিরা বলেন, এক আসামির বাড়ি চেনার জন্য তাঁকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এরপর থেকে তাঁর সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না। কোটচাঁদপুর থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে গেলে পুলিশ নেয়নি।
নিখোঁজ আলম খানের ছেলে জুবায়ের খান বলেন, তাঁর বাবাকে মঙ্গলবার রাত দুইটার দিকে নিজ বাড়ি থেকে উঠিয়ে নিয়ে যায় পুলিশ পরিচয় দেওয়া ৮-১০ জন। কোটচাঁদপুর পৌর কলেজের দপ্তরি শাহজাহান আলী জানান, বুধবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে একটি সাদা মাইক্রোবাস এসে থামে তাদের কলেজের পাশে। এরপর অধ্যক্ষ হুমায়ন কবিরকে ডাক দেন সাদাপোশাকধারী অস্ত্রধারী ব্যক্তিরা। মাইক্রোবাসের কাছে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।
ঝিনাইদহ অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজবাহার আলী শেখ বলেন, এ ধরনের খবর তাঁরাও শুনেছেন। তবে পুলিশের পক্ষ থেকে কাউকে তুলে আনার কথাটি ঠিক নয়। তাঁরাও নিখোঁজ ব্যক্তিদের খোঁজ করছেন।
ব্যবসায়ী ও দুই শ্যালককে তুলে নেওয়া হয়
চট্টগ্রামে দিনদুপুরে বাসায় ঢুকে এক পরিবহন ব্যবসায়ী ও তাঁর দুই শ্যালককে গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ২৪ মার্চ দুপুরে চট্টগ্রাম নগরের ২ নম্বর গেট এলাকার আল ফালাহ গলির একটি ভাড়া বাসা থেকে তাঁদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। ঘটনার ছয় দিন পর গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে এই তথ্য জানান ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা।
নিখোঁজ তিনজন হলেন পরিবহন ব্যবসায়ী এস এম শফিকুর রহমান, তাঁর দুই শ্যালক মো. হাসান তারেক ও মো. মোয়াজ্জেম হোসেন। আল ফালাহ গলির ‘ভুইয়া মঞ্জিল’ নামের পাঁচতলা একটি ভবনের দ্বিতীয় তলার একটি ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকে শফিকুরের পরিবার।
সংবাদ সম্মেলনে ব্যবসায়ী শফিকুরের স্ত্রী সুলতানা রাজিয়া বলেন, ডিবি পুলিশ পরিচয় দেওয়া ছয়জন লোক ২৪ মার্চ বেলা দুইটার দিকে তাঁদের বাসায় ঢোকেন। ঢাকা থেকে এসেছেন জানিয়ে শফিককে তাঁদের সঙ্গে আগ্রাবাদ নিয়ে যেতে যান। সেখানে একজন লোককে চিনিয়ে দিয়ে শফিক আবার বাসায় চলে আসতে পারবেন বলে তাঁদের জানান। সেদিন বাসায় একটি পারিবারিক অনুষ্ঠান থাকায় তাঁর বড় ভাই তারেক (চট্টগ্রাম নগরের বায়েজিদ এলাকায় মুঠোফোনের দোকান রয়েছে) ও ছোট ভাই মোয়াজ্জেম (ওমানপ্রবাসী, পাঁচ মাস আগে দেশে আসেন) তখন বাসায় ছিলেন। ডিবি পরিচয় দেওয়া লোকেরা শফিকের সঙ্গে মোয়াজ্জেমকেও নিয়ে যান। বাসার নিচে একটি সাদা রঙের মাইক্রোবাস ছিল। তবে গাড়িটিতে কোনো নম্বরপ্লেট ছিল না। ওই দুজনকে গাড়িতে তোলার পর তাঁর বড় ভাই হাসান মোটরসাইকেল নিয়ে গাড়িটি অনুসরণ করেন। পরে তাঁকেও মাইক্রোবাসে তুলে নেওয়া হয়।
জানতে চাইলে খুলশী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মো. নাসির উদ্দিন বলেন, ডিবি পুলিশের কেউ ওই বাসা থেকে কাউকে তুলে নিয়ে যায়নি। কারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ওসির দাবি, শফিকুর ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত। তবে তাঁর নামে থানায় কোনো মামলা নেই।
চট্টগ্রাম নগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের উপকমিশনার মো. মারুফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ডিবি পুলিশের কেউ ওই তিনজনকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায়নি। বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে।
সংবাদ সম্মেলনে ব্যবসায়ী শফিকুরের স্ত্রী সুলতানা রাজিয়া বলেন, গত কয়েক দিনে তাঁর স্বামীর মুঠোফোন নম্বর থেকে সাত-আটবার তাঁর মুঠোফোনে কল এসেছে। তবে কোনোবারই স্বামীর সঙ্গে এক-দেড় মিনিটের বেশি কথা বলতে পারেননি। কোথায় আছেন জানতে চাইলেই মুঠোফোন সংযোগ কেটে দেওয়া হয়। ফোনে তাঁর স্বামী বারবার উদ্ধারের আকুতি জানান, তাঁদের ওপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে বলেও জানান। পরে ওই নম্বরে ফোন করলে তা বন্ধ পান। কখনো কখনো রিং হলেও কেউ ফোন ধরেন না।
নওগাঁয় নিখোঁজ তিন যুবক
নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলা থেকে পুলিশ পরিচয়ে তিন যুবককে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে গত রোববার এবং মঙ্গলবার রাতে। তাঁরা হলেন উপজেলার ভাবিচা ইউনিয়নের ধর্মপুর গ্রামের আল আমিন, মিলন রহমান ও নুর আমিন।
নওগাঁর যুবকদের পরিবার ও গ্রামবাসী সূত্রে জানা গেছে, গত রোববার রাতে সাদাপোশাকে ১৫ থেকে ২০ জন লোক পুলিশ পরিচয়ে বাড়ি থেকে আল আমিনকে ধরে নিয়ে যায়। পরে মঙ্গলবার রাতে আবারও কয়েকজন লোক এসে মিলন রহমান ও নুর আমিনকে ধরে নিয়ে যায়। উভয় ঘটনায় পুলিশ পরিচয় দেওয়া লোকদের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র ছিল।
এ ছাড়া রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার হামিরকুৎসা গ্রাম থেকে আবদুল কুদ্দুসকে (৫৪) গত বৃহস্পতিবার পুলিশ পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। নিখোঁজ ব্যক্তির ছেলে জাহিদ হোসেন বলেন, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় তাঁর বাবা বাড়ির পাশের মাঠ থেকে গরু নিয়ে ফিরছিলেন। এ সময় দুটি মোটরসাইকেলে করে চারজন ব্যক্তি এসে তাঁর বাবাকে তুলে নিয়ে যায়। আবদুল কুদ্দুসের বিরুদ্ধে জঙ্গিসংশ্লিষ্টতার অভিযোগে মামলা ছিল এবং তা থেকে তিনি অব্যাহতি পেয়েছেন বলে পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
বাগমারা থানা-পুলিশের পক্ষ থেকে আবদুল কুদ্দুস নামের কাউকে আটকের বিষয়টি অস্বীকার করা হয়। রাজশাহী জেলা গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক সেলিম হোসেন বলেন, তাঁরা এ বিষয়ে কিছু জানেন না।
জানতে চাইলে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক নূর খান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, এভাবে একের পর এক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। অথচ কোনো সংস্থা স্বীকার করছে না। এটা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। তিনি বলেন, দেশে এখন একটা পরিস্থিতি চলছে। বিভিন্ন সময় দেখা গেছে নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিরা জঙ্গিদের সঙ্গে আটক হচ্ছে। আর ক্রসফায়ারের আশঙ্কা তো আছেই।

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1129036/