এ যেন উৎসব। তাই শিশুদেরও সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন নারী ভোটারদের কেউ কেউ। আনন্দমুখর পরিবেশে গতকাল অনুষ্ঠিত হয়েছে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন। শহরের বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্র থেকে তোলা ছবি l সাইফুল ইসলাম
৩১ মার্চ ২০১৭, শুক্রবার, ৭:২৪

বিশ্লেষণ

কুমিল্লায় নীরব ‘ভোটবিপ্লব’

কিছু বিক্ষিপ্ত অঘটনের মধ্যে গতকাল বিকেল চারটায় যখন ভোট গ্রহণ শেষ হলো, তখন অনেকেরই ধারণার বাইরে ছিল যে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আঞ্জুম সুলতানা সীমাকে হারিয়ে বিএনপির প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু দ্বিতীয়বারের মতো মেয়রের আসনে বসবেন।
কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের বেশির ভাগ কেন্দ্রের ভোটচিত্র ছিল মোটামুটি সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ। ভোটকেন্দ্রের বাইরের সড়কে আওয়ামী লীগের সমর্থকদের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। তুলনায় বিএনপির সমর্থকদের উপস্থিতি ছিল খুবই কম। কিন্তু কেন্দ্রের ভেতরে যে বিভিন্ন বয়স ও পেশার ভোটাররা জড়ো হয়েছিলেন, তাঁরা আগেই ঠিক করে এসেছেন কাকে ভোট দেবেন। ফলে ভোট গ্রহণ শেষ না হওয়া পর্যন্ত কেন্দ্রের বাইরে থাকা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী-সমর্থকেরা জানতেই পারেননি, নির্বাচনী ফলাফল কী হতে যাচ্ছে। অনেক কেন্দ্রে বিএনপির প্রার্থীর পোলিং এজেন্টও ছিলেন না। বিএনপির অনেক সমর্থক গায়ে নৌকার ব্যাজ লাগিয়ে কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিয়ে এসেছেন।
সকাল আটটায় ভোট গ্রহণ শুরুর পর বাগিচাগাঁও থেকে কান্দিরপাড়ে যেতে যে কটি ভোটকেন্দ্র সামনে পড়েছে, সেগুলোতে কিছুটা উত্তেজনা লক্ষ করা গেছে। বিশেষ করে মডার্ন হাইস্কুল কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ভোট দেওয়ার পর বাইরে কর্মী-সমর্থকেরা নৌকার পক্ষে স্লোগানও দিয়েছেন। বাইরে যা-ই হোক না কেন ভেতরের পরিবেশ ছিল শান্ত। ভোটারদের লাইনও ছিল দীর্ঘ। ভোট গ্রহণের বেশ আগেই তাঁরা নিজ নিজ কেন্দ্রে এসে পৌঁছান।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত পুলিশ, বিজিবি ও র্যা বের সদস্যরা কেন্দ্রের ভেতরে ও বাইরের শৃঙ্খলা রক্ষায় ছিলেন সদাতৎপর। নির্বাচনী পরিবেশ রক্ষায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরাও পেছনে বিজিবির ‘যুদ্ধপ্রস্তুত’ বাহন নিয়ে গোটা এলাকা টহল দিয়েছেন, যাতে কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে। তারপরও পরিবেশ সবখানে সুস্থ ও স্বাভাবিক ছিল বলা যাবে না। বিশেষ করে নৌকা-প্রভাবিত এলাকায় কেন্দ্রের ভেতরেও আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা ‘বিশেষ সুবিধা’ নেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
কিন্তু প্রিসাইডিং কর্মকর্তা এবং তাঁর সহকর্মীদের দৃঢ়তার কারণে নৌকার সমর্থকেরা সুবিধা করতে পারেননি। এটাই ছিল গতকালের নির্বাচনে ‘নীরব ভোটবিপ্লব’। ধানের শীষের ভোটাররা বুঝতেই দেননি ভেতর-ভেতরে কী হচ্ছে।
কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মোট ২৭টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৯টি বিশ্বরোডের ওপারে কোটবাড়ী এলাকায়। বাকি ১৮টি মূল শহরে। নির্বাচনের কাজে সংশ্লিষ্ট এবং গণমাধ্যমকর্মীরা আগেই আঁচ করেছিলেন কোটবাড়ী এলাকায় বড় ধরনের ‘গ্যাঞ্জাম’ হতে পারে। সেখানে দক্ষিণ বাগমারা গন্ধমতীর একটি বাড়িতে ‘জঙ্গি আটকের ঘটনা’ উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু এলাকার মানুষের মধ্যে এ নিয়ে তেমন উদ্বেগ নেই। তাঁদের অনেকেই পুলিশের বেষ্টনী পেরিয়ে ভোট দিতে এসেছেন। কাছাকাছি এক কেন্দ্রের বাইরে দেখা গেছে, বেশ কয়েকজন তরুণ নৌকার ব্যাজ লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
একজনকে জিজ্ঞেস করি, কী ব্যাপার, এখানে ধানের শীষের কোনো সমর্থক নেই? তিনি কী বুঝলেন, জানি না। নিজেকে ভিক্টোরিয়া কলেজের শিক্ষার্থী পরিচয় দিয়ে বললেন, তিনি আসলে ধানের শীষের সমর্থক। ‘বাস্তব’ কারণেই নৌকার ব্যাজ পরে এসেছেন। ২০১২ সালের শেষে ভোটার হলেও এই প্রথম ভোট দেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন।
ভিক্টোরিয়া কলেজিয়েট স্কুল, কুমিল্লা ক্যামব্রিয়ান কলেজ, শালবন বিহার প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের ভেতরের চিত্রও মোটামুটি শান্ত ছিল। ভোটাররা লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দিচ্ছেন। কিন্তু সব বুথে ধানের শীষের পোলিং এজেন্টকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। আবার যিনি নিজেকে ধানের শীষের পোলিং এজেন্ট পরিচয় দিয়েছেন, পরে জানা গেছে তিনিও আসলে ধানের শীষের এজেন্ট নন। কিন্তু ভোটাররা সঠিক প্রার্থীকেই বেছে নিয়েছেন।
আলাপ প্রসঙ্গে একটি কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা বলেন, ‘অনেক টেলিফোন পেয়েছি। হুমকি-ধমকি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমরা সাধ্যমতো দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেছি।’ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও ছিলেন অনড়।
তাই গতকালের সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য বিভিন্ন কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ও সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তার পাশাপাশি তাঁরাও কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন। কয়েকটি কেন্দ্রে গোলযোগ হলেও সেখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দ্রুত পরিস্থিতি সামাল দিতে পেরেছে।
এই নির্বাচন আরও প্রমাণ করল, ক্ষমতার দাপট বা প্রচারের জৌলুশ দেখিয়ে মানুষের মন জয় করা যায় না।
এই নির্বাচন নতুন কমিশনের জন্য বড় পরীক্ষা ছিল। সেই পরীক্ষায় তাঁরা জিপিএ-৫ না পেলেও মোটামুটি উতরে গেছেন। কুমিল্লার অভিজ্ঞতা অন্যান্য নির্বাচনে কাজে লাগালে ভবিষ্যতে জাতীয় নির্বাচনও সুষ্ঠু ও অবাধ হতে পারে।
শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গোটা নির্বাচনী এলাকায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা ছিলেন অতি সরব। আর বিএনপি কাজ করেছে নীরবে। তারা ভোটারদের মন জয় করার চেষ্টা করেছে। তবে ভোট দেওয়ার পর দুই প্রার্থীই বলেছিলেন, কুমিল্লাবাসী যে রায় দেন, সেটি তাঁরা মেনে নেবেন। আশা করি ফলাফল ঘোষণার পর পরাজিত প্রার্থী বিজয়ী প্রার্থীকে অভিনন্দন জানাবেন এবং বিজয়ীও তাঁর উদারতা দিয়ে প্রতিপক্ষকে গ্রহণ করবেন। যেমন করেছিলেন নারায়ণগঞ্জে সেলিনা হায়াৎ আইভী ও সাখাওয়াত হোসেন।
কুমিল্লার নির্বাচনটি নারায়ণগঞ্জের মতো ‘শতভাগ’ সুষ্ঠু হয়নি। হলে ভোটের ব্যবধান হয়তো আরও বেশি হতো।
নির্বাচনে দায়িত্ব পালন যে কত কঠিন, সেটি নিচের সংলাপটিই প্রমাণ। ভোট চলাকালে সরকারি দলের একজন ক্ষমতাবান ব্যক্তির সঙ্গে একটি কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তার টেলিফোন সংলাপটি দিয়ে কুমিল্লার ভোটের কড়চা শেষ করছি।
: আমাদের লোকদের সুযোগ করে দেন।
: এখানে স্যার, সুন্দর ব্যবস্থা আছে। যাঁরা আসছেন তাঁরা সবাই ভোট দিয়ে যাচ্ছেন, কোনো সমস্যা হচ্ছে না।
: আমি যা বলেছি, তা শোনেন। এখানে নৌকার কর্মী আছেন, তাঁদের সুযোগ দেবেন।
: আমি নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করছি, স্যার। এখানে সব দলের পোলিং এজেন্ট আছেন। তাঁরা সুন্দরভাবে দায়িত্ব পালন করছেন।
: আমার লোকেরা যা বলেন, তা-ই শোনেন।
কিন্তু ওই প্রিসাইডিং কর্মকর্তার মতো নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী বেশির ভাগ কর্মকর্তা ওপরের গায়েবি আওয়াজে কান দেননি বলেই কুমিল্লার মানুষ পছন্দের প্রার্থীকে বেছে নিতে পেরেছেন। এ জন্য তাঁরা ধন্যবাদ এবং কুমিল্লাবাসী অভিনন্দন পেতেই পারেন।

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1129041/