২৯ মার্চ ২০১৭, বুধবার, ৮:১৪

বড় খেলাপিরা সুবিধা নিয়েও ঋণ পরিশোধ করছে না

বড় ঋণখেলাপিদের ঋণ পুনর্গঠন সুবিধা দিয়ে বিপাকে পড়েছে দেশের ব্যাংকগুলো। সুবিধা নেওয়া ব্যবসায়ীদের একটি অংশ এখন আর ঋণ পরিশোধ করছে না। বরং তারা নতুন করে ঋণ চাচ্ছে। আবার আগে সুযোগ না পাওয়া খেলাপিরা নতুন করে ঋণ পুনর্গঠনের দাবি জানাচ্ছে। পাশাপাশি একই সুযোগ পেতে আদালতের আশ্রয় নিয়েছেন ৮০ এর মতো ঋণ খেলাপি ব্যবসায়ী।
রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণ দেখিয়ে ২০১৫ সালে বড় ব্যবসায়ীদের ঋণ শোধে বিশেষ নীতিমালা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ সময় ১১ শিল্পগ্রুপের ১৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠন করা হয়।
ব্যাংক সূত্রগুলো বলছে, সুবিধা পাওয়ার এক বছর পর ঋণ পরিশোধের সময় এলে অনেকেই এখন নানা টালবাহানা শুরু করেছে। তারা পুনর্গঠন করা ঋণে আরও ছাড় চাইছে, নতুন করে আরও ঋণ চাইছে। এর মধ্যে চট্টগ্রামভিত্তিক এস এ গ্রুপ ও নারায়ণগঞ্জের বি আর স্পিনিং টাকাই পরিশোধ করেনি। আবার রতনপুর গ্রুপও পুরো কিস্তি পরিশোধ না করে নতুন করে সুবিধা চেয়েছে।
বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান এবং আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর বেসরকারি খাত উন্নয়নবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ২০১৪ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে গ্রুপের সব ঋণ পুনর্গঠন করার দাবি জানিয়েছিলেন। এরপর অন্য ব্যবসায়ীরাও একই দাবি জানালে ২০১৫ সালের ২৯ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণ পুনর্গঠনের নীতিমালা জারি করে। ৫০০ কোটি টাকার বেশি ঋণগ্রহীতাদের জন্য এ সুযোগ দেওয়া হয়। নীতিমালা অনুযায়ী, দুই কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হলে প্রচলিত নীতিমালা অনুযায়ী খেলাপি হয়ে যাবে। এসব ঋণ আদায়ে দেউলিয়া আইন, ১৯৯৭-এর আওতায় মামলা করতে পারবে ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, ২০টির মতো প্রতিষ্ঠান ঋণ পুনর্গঠনের আবেদন করলেও ১১ গ্রুপ এ সুবিধা পায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রায় ১৫ হাজার ২১৮ কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠনের অনুমোদন দেয়। এর মধ্যে বেক্সিমকো গ্রুপেরই ছিল প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা। সুবিধা পাওয়া অন্য গ্রুপগুলো হলো যমুনা, শিকদার, কেয়া, এননটেক্স, রতনপুর, এস এ, বি আর স্পিনিং, রাইজিং গ্রুপ ও অন্যান্য।
ব্যাংকগুলো জানায়, পুনর্গঠিত ঋণের প্রথম কিস্তি পরিশোধ শুরু হয়েছে গত ডিসেম্বর থেকে। কিন্তু চট্টগ্রামভিত্তিক এস এ গ্রুপ ও নারায়ণগঞ্জের বি আর স্পিনিং প্রথম কিস্তি শোধ করেনি। রতনপুর গ্রুপ কিস্তির অর্ধেক অংশ শোধ করেছে। এখন মার্চ মাসের কিস্তি পরিশোধে আগ্রহ দেখাচ্ছে না আরও অনেকে।
এর মধ্যে এস এ, রতনপুর, বি আর স্পিনিং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে এক আবেদনে বলেছে, পুনর্গঠিত মেয়াদি ঋণ পরিশোধে ১২ বছরের স্থানে তাদের ২০ বছর সময় দিতে হবে। নতুন করে সুদ আরোপ করা যাবে না। বিদ্যমান ঋণের প্রথম কিস্তি পরিশোধে আরও সময় দিতে হবে। নতুন করে চলতি মূলধন দিতে হবে। এই তিন গ্রুপের পুনর্গঠন করা ঋণের পরিমাণ ২ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ সামগ্রিক বিষয়টি নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, যাচাই-বাছাই করেই ঋণ পুনর্গঠন করা হয়েছিল। তাদের প্রতিশ্রুতি ছিল, পরিকল্পনা ছিল, কীভাবে ঋণ শোধ হবে। এখন তাদের ওপর চাপ দেওয়া উচিত। বারবার তো একই সুবিধা দেওয়া যায় না। নিয়ম মেনে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
সালেহউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, নির্দিষ্ট কয়েকজন ব্যবসায়ীকে বারবার সুবিধা দেওয়া হলে অন্যরাও ঋণ পরিশোধে আগ্রহ হারাবে। ফলে নতুন উদ্যোক্তারা ঋণ পেতে ভোগান্তিতে পড়বে। যার প্রভাব পড়বে পুরো অর্থনীতিতে।
ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, এস এ গ্রুপের এস এ ওয়েল রিফাইনারি ও সামান্নাজের পক্ষে ৯২৮ কোটি টাকা পুনর্গঠন করে ৬টি ব্যাংক। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ২৯৯ কোটি টাকা পুনর্গঠন করে ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংক।
ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ ওয়াসেক মো. আলী এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঋণ আদায় হবে এ আশায় এস এ গ্রুপের ঋণ পুনর্গঠন করা হয়েছিল। তবে গ্রুপটি কোনো টাকা পরিশোধ করেনি। এখন আইনি ব্যবস্থা ছাড়া আর কোনো পথ দেখছি না।’
এস এ গ্রুপের চেয়ারম্যান সাহাবুদ্দিন আলম একই সঙ্গে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের পরিচালক। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, পুনর্গঠন সুবিধার পরও ব্যাংকগুলো অর্থায়ন করছে না। এ কারণে বেশির ভাগ গ্রুপই ব্যবসা করতে পারছে না। ফলে কিস্তিও দেওয়া যাচ্ছে না। এখন নতুন করে ঋণসুবিধা চেয়েছি। সুবিধা পাওয়া বেশির ভাগ গ্রুপই নতুন করে সুবিধা চায় বলে দাবি করেন তিনি।
এম আর গ্রুপের প্রতিষ্ঠান বি আর স্পিনিং চার ব্যাংকের ৫৭২ কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠন সুবিধা নেয়। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৩৭৮ কোটি টাকা পুনর্গঠন করে জনতা ব্যাংক। গত ডিসেম্বরে গ্রুপটির জনতা ব্যাংকে ১৭ কোটি টাকা কিস্তি পরিশোধের শর্ত থাকলেও তা পরিশোধ করেনি। একই অবস্থা অন্য ব্যাংকেও। রতনপুর গ্রুপের পক্ষে তিন ব্যাংকে পুনর্গঠন হয় ৮১২ কোটি টাকার ঋণ। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৪৮০ কোটি টাকাই ছিল জনতা ব্যাংকের। গ্রুপটি গত ডিসেম্বরে কিস্তির অর্ধেক টাকা পরিশোধ করেছে।
জনতা ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. হেলাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুনর্গঠনের পর বি আর স্পিনিং এবং এস এ গ্রুপ কোনো টাকাই দেয়নি। আমরা শেষ সুযোগ দিয়েছি, মার্চের মধ্যে কিস্তি না দিলে আইনি ব্যবস্থা নিতে অঞ্চলপ্রধানদের চিঠি দেওয়া হয়েছে। রতনপুর গ্রুপ এক কিস্তির অর্ধেক টাকা দিয়েছে। তারা কিছু দাবি জানিয়েছে, আমরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে অনুমোদনের জন্য পাঠিয়েছি।’
রতনপুর স্টিল রি-রোলিং মিলের (আরএসআরএম) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের পরিচালক মাকসুদুর রহমান বলেন, ‘ঋণ পুনর্গঠনের নীতিমালা বাস্তবসম্মত না। আমরা নতুন করে পুনর্গঠন করার দাবি জানিয়েছি। তবে আমি কিছু টাকাও শোধ দিয়েছি, দাবিও করছি নতুন করে সুবিধা পাওয়ার।’
এদিকে, ৫০০ কোটি টাকার কম ঋণ রয়েছে এমন প্রায় ৮০ জন গ্রাহক ঋণ পুনর্গঠনের সুযোগ চেয়ে আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন। উচ্চ আদালতে তাঁদের দায়ের করা রিটের শুনানি চলছে। গাজীপুর পেপার বোর্ডের পক্ষে প্রথম রিটটি করা হয় গত বছরের ২২ মার্চ। এরপরে অন্য ব্যবসায়ীরা একই দাবিতে রিট করেন। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকেও আবেদন করা হয়।
সূত্র জানায়, ইব্রাহীম গ্রুপ ৩৪০ কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আবেদন করে। আবুল হোসেন গ্রুপের পক্ষে আবেদন আসে ৪৯৭ কোটি টাকার ঋণ পুনর্গঠনের জন্য। এ ধরনের অনেক প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আবেদন করলেও তারা এ সুবিধা না পেয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে আদালতে গেছে। এসব উদ্যোক্তা আবেদনে বলছে, যেসব ক্ষতির জন্য ঋণ পুনর্গঠনের সুবিধা দেওয়া হয়েছে, তারাও ওই ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছে। বড় উদ্যোক্তারা সুবিধা পেলে তাদেরও তা প্রাপ্য। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইতিমধ্যে হাইকোর্টের আইনজীবী নাহিদ মাহতাবকে বেশির ভাগ রিটের জবাব দিতে নিয়োগ দিয়েছে।
আইনজীবী নাহিদ মাহতাব গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ৫০০ কোটি বেশি ঋণ গ্রহীতাদের ঋণ পুনর্গঠন করেছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ সুবিধা দিতে পারে। যারা সুবিধা না পেয়ে রিট করেছিল, আমরা তার মোকাবিলা করছি। আদালত এসব রুল নিষ্পত্তি করে আইন অনুযায়ী তাদের ব্যাংকে যেতে বলছেন। ইতিমধ্যে ২৫ টির মতো রিট নিষ্পত্তি হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা বলেন, একটা নীতিমালার আওতায় ঋণ পুনর্গঠন সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। ৫০০ কোটি টাকার বেশি ঋণগ্রহীতারাই এ সুবিধা পেয়েছে। তাদের কেউ কিস্তি না দিলে নীতিমালা অনুযায়ী খেলাপি হয়ে পড়বে। নতুন করে কোনো সুবিধা দেওয়ার কিছু নেই।

 

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1125056/