২৭ মার্চ ২০১৭, সোমবার, ১:৩২

বাজেট কাটছাঁটে কমেছে বিভিন্ন খাতের ভর্তুকিও

চলতি বছরের বাজেট কাটছাঁটের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কমানো হয়েছে বিভিন্ন খাতের ভর্তুকিও। কমানো হয়েছে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রাও। সরকারের রাজস্ব আদায়ে বড় ধরনের ঘাটতির কারণে বাজেটের আকার ছোট করা হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে চলতি ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে বাজেটের ভর্তুকি খাত থেকে দুই হাজার ৯০৩ কোটি টাকা কমানো হয়েছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি খাতে বরাদ্দ ছিল ২৬ হাজার ৭২৯ কোটি টাকা।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সংশোধিত বাজেট থেকে ভর্তুকি কমিয়ে ২৩ হাজার ৮২৬ কোটি টাকা করা হয়েছে। শতকরা হিসেবে যা ১১ শতাংশ। কৃষি খাতে ভর্তুকি কমানোর কারণে ভর্তুকির পরিমাণ কমেছে।
সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরের বাজেটে খাদ্য খাতে ভর্তুকির পরিমাণ ছিল ৯ হাজার কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে ছয় হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে। একইভাবে পিডিবির খাত থেকে কমানো হয়েছে ৫০০ কোটি টাকা। এ খাতে ভর্তুকি ছিল ছয় হাজার কোটি টাকা। এখন তা কমিয়ে করা হয়েছে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। তবে কিছু খাতে ভর্তুকির পরিমাণ কিছুটা বেড়েছেও। যেমন মূল বাজেটে খাদ্য খাতে ভর্তুকি রয়েছে দুই হাজার ৮২০ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে তা বাড়িয়ে করা হয়েছে তিন হাজার ৭১৭ কোটি টাকা।
সংশোধিত বাজেটে পাট ও আর্থিক সহায়তা খাতে ভর্তুকি নির্ধারণ করা হয়েছে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা। গ্যাস খাতে রাখা হয়েছে এক হাজার কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে বিবিধ খাতে ভর্তুকি রাখা হয়েছে ১১ শ’ কোটি টাকা। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) খাতে এবার কোনো ভর্তুকি রাখা হয়নি। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে কম দামে জ্বালানি তেল কিনে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে বেশি দামে বিক্রি করার কারণে বিপিসির কোনো ভর্তুকির প্রয়োজন হচ্ছে না। গত দুই অর্থবছর থেকে সরকারি এই প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে কোনো ভর্তুকির অর্থ বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে না বলে অর্থ বিভাগ সূত্র জানায়।

অর্থ বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, সংশোধিত বাজেটে গ্যাস খাতে ভর্তুকি দেয়া হয়েছে এক হাজার কোটি টাকা। তবে আগামী অর্থবছর তা বাড়বে। এখানে আরো দেড় হাজার কোটি টাকা ভর্তুকির প্রয়োজন হতে পারে।
সূত্র জানায়, ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন খাতে ভর্তুকির পরিমাণ কমিয়ে আনছে সরকার। ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকির পরিমাণ ছিল ২৭ হাজার ৪১৬ কোটি টাকা। পরের অর্থবছর, অর্থাৎ ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে তা কমিয়ে করা হয় ২৫ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা এবং ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে তা আরো কমিয়ে ২৩ হাজার ৮২৬ কোটি টাকা করা হয়েছে।
পরিসংখ্যানে দেখা যায়, তিন বছরের ব্যবধানে ভর্তুকির পরিমাণ কমানো হয়েছে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা। শতকরা হিসেবে যা ১৬ শতাংশ। আগামী অর্থবছরেও ভর্তুকির পরিমাণ কমবে। কারণ, বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে আগামী অর্থবছরে পিডিবি খাতে ভর্তুকির পরিমাণ কমে যাবে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংক সব সময় ভর্তুকি কমানোর জন্য সরকারকে পরামর্শ দেয়। বিশেষ করে বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে অনেক দিন ধরেই বলা হচ্ছে, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে যেন ভর্তুকি কমিয়ে আনা হয়। কারণ, এ খাতে ভর্তুকির অর্থে গরিবদের পাশাপাশি ধনীরাও সুবিধা পাচ্ছে। তাই সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করে ভর্তুকি দেয়া উচিত, যাতে সমাজের সুবিধাবঞ্চিতরাই যেন এর উপকার পান।

চলতি বছরের বাজেট থেকে ৩০ হাজার ৫৩৬ কোটি টাকা কাটছাঁট করা হয়েছে। একই সঙ্গে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা কমানো হয়েছে ৩১ হাজার ৪৩ কোটি টাকা। সরকারের রাজস্ব আদায়ে বড় ধরনের ঘাটতির কারণে বাজেটের আকার ছোট করা হয়েছে। কাটছাঁটের পর চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের আকার দাঁড়াচ্ছে ২ লাখ ৬৪ হাজার ৫৬৫ কোটি টাকা। যেখানে মূল বাজেটের আকার ছিল ২ লাখ ৯১ হাজার ১শ’ কোটি টাকা। আগামী ৩০ জুন সংশোধিত এ বাজেট পাসের জন্য জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এ লক্ষ্যে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চলছে সংশোধিত বাজেট প্রস্তুত প্রক্রিয়া। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এ তথ্য।
চলতি অর্থবছরের বাজেট কাটছাঁট প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, বাজেট ঘোষণার শুরু থেকে বলা হয়েছে, রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে উচ্চাভিলাষী, বাস্তবভিত্তিক নয়। এখন রাজস্ব আদায় না হওয়ার কারণেই বাজেটের আকার কমানো হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, বাজেট কিছুটা উচ্চাভিলাষী থাকতে হবে। তবে বাস্তবতার সঙ্গে মিল থাকতে হবে। কিন্তু বর্তমান বাজেটে এর প্রতিফলন নেই।

জানা গেছে, সংশোধিত বাজেটে ভর্তুকি খাতে বড় ধরনের বরাদ্দ কমানো হচ্ছে। বিশেষ করে বরাদ্দ কমছে বিদ্যুৎ, কৃষি ও জ্বালানি খাতের ভর্তুকিতে। এছাড়া বরাদ্দ কমছে সরকারি বিনিয়োগ বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) খাতেও। অনুন্নয়নসহ অন্যান্য ব্যয়ও কমানো হয়েছে। মূল বাজেটে বৈদেশিক সহায়তার লক্ষ্যমাত্রাও কমানো হয়। অবশ্য এসব ব্যয় কমানোর ফলে ঘাটতি বাজেটের পরিমাণ বেড়ে গেছে। তবে ঘাটতি বাজেটের পরিমাণ জিডিপির ৫ শতাংশের মধ্যে রাখা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনা সচিব তারিক-উল-ইসলাম বলেন, সংশোধিত বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) খাতে বরাদ্দ কমানো হয়েছে। এরপরও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে চলতি এডিপি বাস্তবায়নে আরও ৩ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত রাখা হয়েছে। প্রয়োজন হলে তা ব্যয় করা হবে। তিনি আরও বলেন, টাকা দিতে সমস্যা নেই। তবে নিয়মমাফিক ব্যয় করতে হবে মন্ত্রণালয়গুলোকে।

মূল বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ৮ হাজার ৪৪৩ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে কাটছাঁট করে এ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ১ লাখ ৭৭ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে মোট রাজস্ব আয় কমানো হয়েছে ৩১ হাজার ৪৩ কোটি টাকা। এছাড়া এনবিআরের কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৭৬ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে ব্যাপক রাজস্ব ঘাটতির মুখে ২৬ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা কমিয়ে রাজস্ব বাজেট সংশোধন করে চূড়ান্ত করা হয় ১ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ সংশোধিত বাজেটে এনবিআর কর কমেছে। পাশাপাশি এনবিআরবহির্ভূত করের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫ হাজার ৮৭৪ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে ৪৭৪ কোটি টাকা কমিয়ে নতুনভাবে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। কর ছাড়া প্রাপ্তির আকার মূল বাজেটে ধরা হয় ২৬ হাজার ১৯৯ কোটি টাকা। এ খাতে ৪ হাজার ১৯৯ কোটি টাকা কাটছাঁট করা হয়েছে। সংশোধিত বাজেটে কর ছাড়া প্রাপ্তির আকার হচ্ছে ২২ হাজার কোটি টাকা।

http://www.dailysangram.com/post/277347