২৬ মার্চ ২০১৭, রবিবার, ৭:২৮

প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে ৮ বছরে আড়াই হাজার পোশাক কারখানা বন্ধ

প্রতিবেশি দেশের সাথে প্রতিযোগিতা বাড়ছে দেশের পোশাক কারখানার। এই দৌড়ে অনেক কারখানা টিকতে না পেরে বন্ধ হয়ে গেছে। গত আট বছরের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে প্রতিযোগিতা আর লোকসানের কারণে আড়াই হাজারের বেশি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়েছে। উচ্চমূলে কাঁচামাল আমদানি করে বাংলাদেশ শুধু দর্জির কাজ করায় লাভের অংশ পায় না দেশের পোশাক মালিকরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অনেক পোশাক কারখানা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে কারখানা চালু করলেও প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে উৎপাদন বন্ধ করতে হয়। ব্যাংকের ঋণ শোধ করতে অনেককে বাধ্য হয়েই অন্য ব্যবসায় চলে যেতে হচ্ছে।
পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র ২০০৮ সালের পরিসংখ্যাণের তথ্য মতে, দেশে পোশাক কারখানা ছিল (২০০৮ সালে) ৫ হাজার ৬০৮টি। সম্প্রতি তাদের হালনাগাদ তালিকায় তা দাঁড়িয়েছে মাত্র ৩ হাজার ১১০টিতে। ২০০৮ থেকে ২০১৭ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত বন্ধ কারখানার সংখ্যা ২ হাজার ৪৯৮টি। এ খাতের অপর সংগঠন বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) তথ্যানুযায়ী ২০১৫ সালেই ২২০টি নিটওয়্যার কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। এর আগে গত এক দশকের বেশি সময়ে নানা কারণে বন্ধ হয় আরও আড়াই শতাধিক কারখানা। সব মিলিয়ে দেশে এ পর্যন্ত প্রায় তিন হাজার কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে।
এদিকে বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানার মালিকদের নেয়া বড় অংকের ব্যাংক ঋণ এখন অনাদায়ী হওয়ার আশংকা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের দেয়া তথ্যমতে পোশাক কারখানার মালিকদের নেয়া ঋণের মধ্যে ১৬ হাজার কোটি টাকা আদায় হওয়ার আর কোনো সম্ভাবনা নেই। তাই বাধ্য হয়ে ইতোমধ্যে ৭ হাজার কোটি টাকা অবলোপন করতে হয়েছে। বাকি টাকার ভবিষ্যৎও একই পথে এগোচ্ছে। এর ফলে বিপাকে পড়েছে সরকারি ও বেসরকারি খাতের কম-বেশি সব ক’টি ব্যাংক। বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩৫টি ব্যাংক।
সূত্র জানায়, অনেকে যে প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নিয়েছেন সেখানে ঋণের ১০ শতাংশ টাকাও বিনিয়োগ করেন নি। ঋণের টাকায় অন্যত্র ভিন্ন নামে শিল্প গড়ে তুলেছেন কিংবা বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। কিন্তু ব্যাংকের টাকা দিচ্ছেন না। এভাবে মুষ্টিমেয় কিছু দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তির কারণে ব্যাংক ও গার্মেন্ট খাতে ব্যাপক ক্ষতি বয়ে এনেছে। বিভিন্ন তথ্যানুসন্ধানে গার্মেন্ট খাতের এ রকম বেহালচিত্র বেরিয়ে এসেছে।
এই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকরা বলছেন, এমনিতে সরকারের ভুল পলিসির কারণে বাংলাদেশে গার্মেন্ট শুধু দর্জির ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। কেননা এ শিল্পে ৮০ থেকে ৯০ ভাগ কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। উপরন্তু ঋণ দুর্নীতি এ খাতকে একেবারে ধ্বংস করে দিচ্ছে। এর ফলে ব্যাংক ঋণের সুদের হার কমছে না। ব্যাংকগুলো এসব ক্ষতি পুষিয়ে নিচ্ছে উচ্চ সুদ আরোপ করে। আর উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে বেশিরভাগ শিল্প কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারছে না। যার বিরূপ প্রভাব পড়ছে পুরো অর্থনীতির ওপর।
সূত্র জানায়, ব্যাংকভেদে ১০ থেকে ২২ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ দেয়া হয় পোশাক খাতে। অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) দাবি অনুযায়ী এ খাতে গড় বিনিয়োগ ১৫ শতাংশ। এ হিসাবে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত গার্মেন্ট খাতে মোট ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ১ হাজার ৮৮ কোটি টাকা। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০১৫ সালের এক পরিসংখ্যানে পোশাক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১৬ দশমিক ৭১ শতাংশ বা প্রায় সাড়ে ১৭ হাজার ৪৬১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ঋণ ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা নেই ১৫ হাজার ৭১৪ কোটি টাকার। যে কারণে আদায় অযোগ্য ঋণ হিসেবে ৭ হাজার ৭২ কোটি টাকা অবলোপন করা হয়েছে। বাকি ১০ হাজার ৩৮৯ কোটি টাকাও আদায় হবে না ধরে নিয়ে নিকট-ভবিষ্যতে অবলোপন করা হবে।
এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, শুধু তৈরি পোশাক নয়, সব খাতেই ঋণ পরিশোধ না করার রীতি দেশে একটা সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যাংকগুলো যাচাই-বাছাই না করে ঋণ দেয়ার কারণেই এমনটি ঘটছে। রাজনৈতিক প্রভাবেও কিছু ঋণ যাচ্ছে। ফলে দিন দিন আদায় অযোগ্য ঋণও বাড়ছে, যা ঋণ অবলোপনের পথে ঠেলে দিচ্ছে। ব্যাংকিং খাতের চলমান এ পরিস্থিতিকে তিনি উদ্বেগজনক বলেও দাবি করেন।

http://www.dailysangram.com/post/277219-