উজানে ভারত পানিপ্রবাহে বাধা দেয়ায় মরে যাচ্ছে তিস্তা। ছবিটি রংপুরের গঙ্গাচড়া এলাকার :নয়া দিগন্ত
২৫ মার্চ ২০১৭, শনিবার, ৯:২২

উচ্ছল তিস্তা এখন এক মরা নদীর উপাখ্যান

ভারতের মহাপরিকল্পনায় চলছে সেচ ও জলবিদ্যুৎ প্রকল্প ; বহ্মপুত্র ও যমুনাও মারা যাবে ; ধ্বংস হবে জীবন ও জীববৈচিত্র্য

প্রতিবেশী দেশের প্রতিহিংসার বলি ‘তিস্তা নদী’ এখন এক মরা নদীর উপাখ্যান। এক সময়ের স্রোতস্বিনী এই নদীর তিস্তার বুকে এখন শুধুই বালুর স্তূপ। আন্তর্জাতিক অভিন্ন নদী নীতিমালাকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে অভিন্ন আন্তর্জাতিক নদী তিস্তার ভারত অংশে বাঁধ দিয়ে সেচ এবং বিদ্যুৎ প্রকল্প চালু করে তিস্তার বাংলাদেশ অংশকে টুঁটি চেপে মেরে ফেলার সব বন্দোবস্ত ইতোমধ্যে সম্পন্ন করা হয়েছে। আগামী ১০ বছরের মধ্যে ভারতের এই ‘মহাপরিকল্পনা’ বাস্তবায়িত হলে তিস্তা নদী হয়ে যাবে কেবলই স্মৃতির মঞ্চয়। এতে তিস্তার সাথে লিংক থাকার কারণে মরে যাবে বাংলাদেশের অপর দুই বৃহৎ নদ-নদী ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা। আর বাংলাদেশের ১২৪ কিলোমিটার তিস্তা অববাহিকায় জীবনযাত্রা, জীববৈচিত্র্য ধংস হয়ে গেছে। গলাকাটা মুরগির মতো ছটফট করে মরে যাচ্ছে দেশের বৃহত্তম তিস্তা সেচ প্রকল্প। অর্ধলাখ জেলে পরিবারে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে উপোস থাকার দিন। এমন পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগামী ৭ ও ৮ এপ্রিল ভারত সফরের সময় চুক্তির মাধ্যমে যখন তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা পাওয়ার স্বপ্ন বুনছিলেন তিস্তা পারের অগণিত মানুষ, তখন পানিসম্পদ মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ স্পষ্ট জানিয়েছেন এই যাত্রায়ও তিস্তা চুক্তি হচ্ছে না। অবশ্য এটা নতুন কিছু নয়। ২০১১ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফর এবং ২০১৫ সালে নরেন্দ্র মোদির সফরের সময়ও ভারত একই কথা জানিয়েছিল। ২০১৪ সালেও মমতার বাধা এবং লোকসভা নির্বাচনকে তিস্তা চুক্তির বাধা হিসেবে দেখিয়েছিল ভারত। ভুক্তভোগী মানুষ, পানি, ভূতত্ত্ব ও পরিবেশবিদরা বলছেন, তিস্তা অববাহিকার বাসিন্দা, জীববৈচিত্র্য এবং পরিবেশের মহাবিপর্যয়ের সীমা ছাড়িয়ে গেলেও সরকার কার্যকর উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হচ্ছে বারবার। তারা সরকারকে জাতিসঙ্ঘের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। দুই দেশের মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন পত্রপত্রিকা, ইন্টারনেট এবং সংশ্লিষ্ট নানা সূত্রে এসব তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে।
অনুসন্ধানে প্রকাশ, বাংলাদেশ ভারত যৌথ নদী কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ এখন তিস্তার মোট পানিপ্রবাহের সাড়ে ৬ শতাংশ ভারত থেকে পাচ্ছে, যা স্মরণকালের ইতিহাসে সবচেয়ে কম। ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজার রহমান জানান, এখন তিস্তায় কোনো ‘প্রবাহমান’ পানি নেই। এই সময়ে তিস্তার ন্যাব্যতা ধরে রাখার জন্য আট হাজার কিউসেক এবং ব্যারাজ চালু রাখার জন্য সাড়ে তিন হাজার কিউসেক পানির প্রয়োজন থাকলেও তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে এখন যে পানি আছে তা ভুগর্ভস্থ পানি। বৃষ্টি হওয়ার কারণে বৃহস্পতিবার পানি ছিল ৮০০ কিউসেক। অন্য সময়ে থাকে ৩০০ থেকে ৩৫০ কিউসেক। এবার আট হাজার হেক্টর জমিতে কোনোমতে রেশনিং করে সেচ দেয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশ অংশে যখন তিস্তার এমন পরিস্থিতি তখন আন্তর্জাতিক পানি দিবসের আলোচনা সভায় গত বুধবার পানিসম্পদ মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন ভারত সফরকালে তিস্তাচুক্তি সই হচ্ছে না। তিনি বলেন, ‘হয়তো এবার হবে না, তবে এ বিষয়ে ভারত নিজেও খুবই আন্তরিক। দেশটির সাবেক ও বর্তমান দুই প্রধানমন্ত্রীও এ নিয়ে কথা দিয়েছেন, তারা আন্তরিক। তাই আমরা আশাবাদী। তবে ভারতের অভ্যন্তরীণ কিছু সমস্যা রয়েছে। ওই সমস্যা সমাধানের পর আমরা চুক্তির বিষয়ে আশা করতে পারি। সূত্র জানায়, এর আগে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুব্রাহ্মনিয়াম জয়শঙ্কর ২৩ ও ২৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা সফর করে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব শহিদুল হকের সাথে বৈঠক করে অন্যান্য তিস্তাচুক্তিসহ বিভিন্ন বিষয়ে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা করেছিলেন। কিন্তু রাজ্য সরকারের বাধায় চুক্তি এবারো হচ্ছে না। এই চুক্তির ভবিষ্যৎ গাঢ় অন্ধকারে নিমজ্জিত।
বাংলাদেশের তিস্তার ন্যায্য হিস্যার বঞ্ছনা : তিস্তাচুক্তি নিয়ে এ ধরনের টালবাহানার বিষয়টি নতুন কিছু নয়। ২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের সময়ও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছিল। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের দেয়া বাধাকে সামনে এনে তিস্তাচুক্তি থেকে সরে গিয়েছিল ভারত। ২০১৪ সালের মার্চ মাসেও নয়াদিল্লিতে দুই দেশের অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের মধ্যে আলোচনায় ভারতপক্ষ সাফ জানিয়ে দিয়েছিল লোকসভা নির্বাচনের আগে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির অগ্রগতি সম্ভব নয়। ২০১১ সালের ৬ সেপ্টেম্বরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি সই হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি।
উজানের মহাপরিকল্পনা : শুধু তাই নয়, ভারত আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে শুষ্ক মওসুমে উজানে থাকা গজলডোবার সব ক’টি গেট বন্ধ করে তিস্তাকে পানিশূন্য করে ফেলে। গজলডোবার ব্যারাজ ছাড়াও ভারতের প্রস্তাবিত আরো প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে : ভাসমি, বিমকং, চাকুং, চুজাচেন, ডিক চু, জোরথাং লোপ, লাচিন, লিংজা, পানান, রালাং, রামমাম-১, রামমাম-৪, রণজিৎ-২, রনজিৎ-৪, রাংইয়ং, রাতিচু-বাকচা চু, রিংপি, রংনি, রুকেল, সাদা মাংদের, সুনতালি তার, তালিম, তাশিডিং, তিস্তা-১, তিস্তা-২, তিস্তা-৩, তিস্তা-৪, তিস্তা-৬, থাংচি, টিং টিং, প্রভৃতি। এ ছাড়াও বর্তমানে চলমান প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে, লোয়ার লাগিয়াপ, রামমাম-২, রণজিৎ-৩, তিস্তা-৫ ও রঙ্গিচু। এগুলো সবই পানিবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। এগুলোর জন্য অবশ্যই তিস্তার পানি প্রত্যাহার ও সংরক্ষণ করা প্রয়োজন হবে। সে ক্ষেত্রে তিস্তার বাংলাদেশ অংশে কিভাবে প্রার্থিত পরিমাণ পানি আসবে তার কোনো হিসাব মেলাতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা।
নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তিস্তার উজানে এসব প্রকল্পের পানির চাহিদা মেটাতে গিয়ে তিস্তার ভাটিতে এসে মোট পানির পরিমাণ ১০ ভাগও থাকবে কি না সে বিষয়েও সন্দেহ রয়েছে। আর এই প্রবাহের হিসাব হবে কিসের ভিত্তিতে তাও নির্দিষ্ট নয়। পানিপ্রবাহ ভারত নিয়ন্ত্রণ করবে, তারাই পানি ছাড়বে এবং হিসাবও রাখবে তারাই। ফলে এ নিয়ে ভারতীয় কুটচালের শিকারে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। ফলে বাংলাদেশের বৃহত্তম তিস্তা সেচ প্রকল্প পুরোপুরি বৃষ্টির পানিনির্ভর হয়ে পড়ছে। জানা গেছে, ভারত তার অংশের তিস্তার পুরো অংশকে কাজে লাগিয়ে আগামী ১০ বছরের মধ্যে ৫০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিশাল প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এই প্রকল্পের আওতায় পানির বৃহৎ রিজার্ভার গড়ে তোলা হবে এবং এগুলোর শক্তিশালী প্রবাহ থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সিকিমে তিস্তা নদীর ওপর তিনটি বাঁধ ইতোমধ্যে তৈরি হয়ে গেছে, আরো দশটি বাস্তবায়নের পথে রয়েছে। এভাবে ৩৫টি প্রকল্পের পরিকল্পনা রয়েছে ভারতের।
ভারত ইতোমধ্যে গজলডোবায় বাঁধ দিয়ে দুই হাজার ৯১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ খালের মাধ্যমে এক হাজার ৫০০ কিউসেক পানি মহানন্দা নদীতে নিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া তিস্তা থেকে পানি সরিয়ে ভারত বর্তমানে কুচবিহার, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, উত্তর দিনাজপুর, দণি দিনাজপুর ও মালদা জেলার তিন লাখ ৪০ হাজার একর জমিতে সেচ দিচ্ছে। অন্য দিকে ভারতের সিকিম এলাকায় তিস্তা নদীর অববাহিকায় বাঁধ দিয়ে চারটি পয়েন্টে জলবিদ্যুৎ স্থাপন করেছে ভারত। অন্য দিকে তিস্তার একেবারে ভাটিতে বাংলাদেশের কাছেও ভারত ব্যারাজ নির্মাণ করে ও ডাইভারশন খাল কেটে মহানন্দা নদীতে পানি সরিয়ে নিচ্ছে। তিস্তার বাংলাদেশ অংশ সম্পূর্ণ পানিশূন্য হয়ে যাবে।
তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্প এলাকায় দীর্ঘ দিন নদী নিয়ে কাজ করছে সাংবাদিক সরদার ফজলুল হক। তিনি নয়া দিগন্তকে জানান, গজলডোবায় তিস্তার পানি বাঁধ দিয়ে ভারত মহানন্দাসহ ১৫-১৬টি জায়গায় পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক নদীবিষয়ক আইন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডমেনজেইম বলেন, কোনো রাষ্ট্রকে নিজ ভূখণ্ডে প্রবাহিত নদীর প্রাকৃতিক অবস্থা এমনভাবে পরিবর্তন করতে দেয়া যাবে না যার ফলে প্রতিবেশী কোনো রাষ্ট্রের ভূখণ্ডের প্রাকৃতিক অবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটে অথবা কোনো অসুবিধার সৃষ্টি করতে পারে। ১৯৪৯ সালের বিখ্যাত কুরফু ক্যানেল মামলায় (ব্রিটিশ বনাম আলবেনীয়া) আদালত তার সিদ্ধান্তে উল্লেখ করে, একটি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের বহিঃপ্রকাশ কখনো এমনভাবে হতে পারে না যার বিরূপ প্রভাব সেই রাষ্ট্রের বাইরে অনুভূত হতে পারে। বিশ্বে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক মামলা ও চুক্তি রয়েছে যেখানে পানির হিস্যার প্রশ্নে ভাটির দেশের নদীকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে এবং পানির একচেটিয়া ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ১৯৬০ সালে ভারত ও পাকিস্তানের স্বারিত সিন্ধু অববাহিকা চুক্তিতেও উল্লেখ ছিল, প্রতিবেশী রাষ্ট্র এমন কোনো ব্যবস্থা নেবে না যাতে অপর রাষ্ট্রে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বিঘিœত হতে পারে।
তিস্তা মরলে মারা যাবে ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা : তিস্তা নদীর উৎপত্তি ভারতের উত্তর সিকিমের সো লামো হ্রদ থেকে। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত ৫৪টি নদীর অন্যতম এই তিস্তা। ৩১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ও খরস্রোতা তিস্তা নদী ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং-জলপাইগুড়ি হয়ে পশ্চিমবঙ্গের ডুয়ারের সমভূমি দিয়ে চিলাহাটি থেকে চার-পাঁচ কিলোমিটার পূর্বে বাংলাদেশের নীলফামারী জেলার উত্তর খড়িবাড়ির অদূরে ডিমলা উপজেলার ছাতনাই নামক স্থানে প্রবেশ করেছে ঐতিহাসিক তিস্তা। তিস্তার প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়া মানেই ভাটিতে বাংলাদেশের তিস্তার অপমৃত্যু এবং সেই সাথে ব্রহ্মপুত্র তথা যমুনার প্রবাহ ব্যাপকভাবে তিগ্রস্ত হওয়া। এই নদীর অস্তিত্বের সাথে বিস্তীর্ণ এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশ নির্ভরশীল।
তিস্তার পানির ব্যাপারে ভারত আন্তর্জাতিক আইন ও মামলার উদাহরণ মানছে না। ফলে বাংলাদেশ অংশে তিস্তা মরে গেছে। পানি বণ্টনের ব্যাপারে ভারতের একগুঁয়েমি, অনৈতিক ঢিলেমি ও হটকারীতায় তিস্তা তীরবর্তী ও আশপাশের প্রকৃতি রুক্ষ হয়ে উঠেছে। তলদেশে অজস্র পাথর, নুড়ি, বাড়– আর পলি পড়ে তিস্তার বুকে শুষ্ক মসুমে উত্তপ্ত বালুর স্তূপ। অন্য দিকে বর্ষাকালে মূল গতিপথ বদলিয়ে তিস্তা প্রচণ্ডভাবে আছড়ে পড়ে দুই তীরে। ফলে নদীর ভাঙনে প্রতি বছর ২০ হাজার মানুষ বাড়িঘর হারিয়ে পথের ভিখেরিতে পরিণত হন।
পরিবেশবিদ পানি বিশেষজ্ঞ ও ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য মতে, রু আবহাওয়ায় ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে তিস্তা অববাহিকা এবং রংপুর অঞ্চলের হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ, প্রকৃতি।
অনুসন্ধান বলছে, তিস্তায় পানি না থাকার কারণে এই অঞ্চলের ধরলা, ঘাঘট, যমুনেশ্বরী, আখিরা, দুধকুমর, বুড়ি তিস্তাসহ প্রায় ৩৩টি ছোট-বড় নদ-নদী ভরাট হয়ে গেছে। রংপুর অঞ্চলে ভুগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে গেছে মাত্রাতিরিক্তভাবে। অন্য দিকে এই অঞ্চলে চিরচেনা প্রায় অর্ধশতাধিক প্রজাতির মৎস্য উধাও হয়ে গেছে। ৫৫ প্রকার পাখপাখালিসহ গাছপালার বহু প্রজাতি ধ্বংস হয়েছে।
এ দিকে পানি না থাকার কারণে তিস্তা অববাহিকার প্রায় অর্ধলাখ পেশাজীবী মাঝি পরিবারে নেমে এসেছে চরম দুর্দিন। তারা এখন উপোস করে মরছেন। জাল আছে জল নেই। তাই মাছও নেই। আয়ও নেই। তিস্তাসহ এই অঞ্চলের ৫০টি শাখা ও উপনদী এবং খাল, বিল, প্রাকৃতিক জলাশয়ে মাছ ধরেই চলতো তাদের জীবন। পানির অভাবে জাল ফেলতে না পারায় তারা বেকার হয়ে পড়েছেন। পরিবার পরিজন থাকছে অর্ধাহারে-অনাহারে। কেউবা শহরে ছুটছেন রিকশা চালিয়ে জীবন ধারণ করতে বা অন্য কাজে। কেউবা ভিার ঝুলি হাতে নিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। তিস্তার ডালিয়া ব্যারাজের পাশে কথা হয় পেশাজীবী মাঝি বিমল চন্দ্রের সাথে। তিনি জানালেন, তিস্তায় পানি নেই। বাপ দাদার পেশা ছাড়তে পারছি না আবার নদীতে পানি না থাকায় জালও ফেলতে পারছি না। মাছ না ধরতে না পারায় খেতেও পারছি না।
রংপুর আঞ্চলিক কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক মো: শাহ আলম জলিল জানান, ব্যারাজ প্রকল্পে পানি পাওয়া না যাওয়ায় ব্যারাজ সেটনির্ভর জমিগুলোতে ঠিকঠাক আবাদ হয় না ১৫ বছর ধরে।
রিভারাইন পিপলস নামে একটি পানি নিয়ে কাজ করা সংগঠনের সিনেটর রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ নয়া দিগন্তকে জানান, আন্তর্জাতিক নদী অনুযায়ী অভিন্ন নদী তিস্তার পানি নিজের ইচ্ছামত কেউ ব্যবহার করতে পারবে না। নি¤œাঞ্চলের দেশকে উক্ত নদীর পানি থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। আন্তর্জাতিক নদীর একতরফা পরিবর্তন বা পরিবর্ধন অথবা পানি প্রত্যাহার করা সম্পূর্ণরূপে অগ্রহণযোগ্য ও বেআইনি। কিন্তু ভারত সেই আইন ও মানবতার প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখাচ্ছে। তিস্তাকে তারা মেরে ফেলেছে। তিনি বলেন, মমতা ব্যানার্জি বাধা না দিলেই ভারত তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা দেবে, এমনটা ভাবার কোনো সুযোগ নেই। এ জন্য বাংলাদেশ সরকারকে দ্বি-দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চাপ তৈরি করতে হবে।

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/206545