২৪ মার্চ ২০১৭, শুক্রবার, ৮:৪০

উড়োজাহাজের তেলে ভেজাল

সাত বিমানবন্দরে ভেজাল জ্বালানির অস্তিত্ব * ফিল্টার মনিটর কাটা লালের ঘরে * যে কোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনার শংকা

পেট্রল অকটেনের পর এবার উড়োজাহাজের জ্বালানিতেও (জেট ফুয়েল) ভয়াবহ ভেজালের প্রমাণ মেলেছে। জেট ফুয়েলের সঙ্গে সুপার এবজরমেন্ট পলিমার (সেপ) মিশিয়ে ভেজাল জ্বালানি তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৬টি বিমানবন্দরে ভেজাল জ্বালানির প্রমাণ মিলেছে। এ ধরনের জ্বালানি ব্যবহার করায় যে কোনো সময় উড়োজাহাজে বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশংকা আছে। জেট ফুয়েলে ভেজাল থাকায় সম্প্রতি বিমানের বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর উড়োজাহাজের (বিজি ০৪৯) একটি ইঞ্জিন পুড়ে গেছে। এই ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি বিশ্বের ৭টি বিমানবন্দরের তেলের পাম্প, তেল সরবরাহকারী গাড়ি ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন টুলস পরীক্ষা করে ভেজালের বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে।


এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ আর এয়ারক্রাফটের ইঞ্জিন প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলো বলছে, বিমানের জ্বালানিতে এ ধরনের ভেজাল যে কোনো সময় একটি এয়ারক্রাফট ক্রাশ করতে পারে। তাদের মতে, জেট ফুয়েলের ভেজাল শনাক্ত করা খুবই কষ্টসাধ্য। সর্বাধুনিক ফুয়েল ফিল্টার ভেদ করে কখনও ফিল্টার অকেজো করে দিয়েও এ ধরনের ভেজাল তেল বিমানের ইঞ্জিনে প্রবেশ করে। এটি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে এক সময় এ খাতে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসতে পারে।

উড়োজাহাজের জ্বালানিতে ভেজাল হচ্ছে এর প্রমাণ পাওয়া গেছে বিমানের ইঞ্জিন পুড়ে যাওয়ার ঘটনায়। এ প্রসঙ্গে বিমান পরিচালনা পর্ষদ চেয়ারম্যান এয়ার মার্শাল (অব.) মো. ইনামুল বারী যুগান্তরকে বলেন, তদন্ত কমিটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, ফুয়েল সিস্টেমে ভেজাল থাকায় ইঞ্জিনটি বার্ন হয়েছিল। এ নিয়ে বিমানের পক্ষ থেকে দীর্ঘ সময় তদন্ত হয়েছে। ইঞ্জিন প্রস্তুতকারী কোম্পানি জিই, ইঞ্জিন মেরামতকারী কোম্পানি এমটিউ ও ইঞ্জিনের বীমা কোম্পানির সঙ্গে এখনও আলোচনা চলছে।

ভেজাল জ্বালানির বিষয়টি আরও নিশ্চিত করেছেন বিমানের পরিচালক প্রকৌশল উইং কমান্ডার আসাদুজ্জামান। তিনি বলেন, প্রাথমিক তদন্তে তারা জেনেছেন, জ্বালানি তেলের গাড়ি থেকে ওই ফুয়েল কন্টামিনেশন (সুপার এবজরমেন্ট পলিমার) বিমানের ইঞ্জিনে প্রবেশ করেছিল। এই ভেজালের কারণে ইঞ্জিনে আগুন ধরে। কিন্তু এই ভেজাল তেল কোন দেশের এয়ারপোর্ট থেকে নেয়া হয়েছিল তা এখনও শনাক্ত করা যায়নি। তিনি বলেন, এ ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারাই এখন এটা বের করবে কোন দেশের জ্বালানি তেলের ভেজালের কারণে এ ভয়াবহ পরিণতি হয়েছে।

তদন্ত কমিটির সদস্য ও বেবিচকের এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, জ্বালানি তেল নেয়া হয়, এমন ৬টি দেশের বিমানবন্দরে থাকা তেলের পাম্প, তেল সরবরাহকারী গাড়ি ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন টুলস পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। এর মধ্যে শাহজালালের পদ্মা অয়েলের পাম্প ও যানবাহনও ছিল। এসব পরীক্ষায় দেখা গেছে, অধিকাংশ পাম্পে তেল ফিল্টারের যেসব মনিটর আছে সেগুলো রেড লেভেলে চলে গেছে। সাধারণত এসব মনিটরে তিনটি ব্যারোমিটার থাকে। সবুজ, হলুদ এবং লাল। তেলে কোনো ধরনের ভেজাল না থাকলে ওই মনিটরের কাটা সবুজ দাগে থাকবে। সামান্য ভেজাল থাকলে হলুদ দাগে থাকবে। আর ভেজালের মাত্রা বেশি হলে মনিটরের কাটা লালের ঘরে চলে যাবে। তিনি বলেন, এক্ষেত্রে ৫টি দেশের ফিল্টার মনিটরের কাটা লালের ঘরে দেখেছেন, যা খুবই ভয়াবহ। প্রসঙ্গত, দেশে পদ্মা অয়েল কোম্পানির কাছ থেকে জ্বালানি তেল নেয়া হয়। এছাড়া লন্ডন, জেদ্দা, দাম্মাম, কুয়েত, আবুধাবি, থাইল্যান্ডসহ আরও ১৬টি দেশের বিমানবন্দর থেকেও জ্বালানি তেল সংগ্রহ করছে বিমান।

তদন্ত কমিটির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, ভেজালকারীরা সাধারণত বেশি লাভের আশায় জেট ফুয়েলের সঙ্গে তেলের অন্যান্য বাই প্রডাক্ট মিশিয়ে তারপর বিক্রি করছে। আর এসব বাই-প্রডাক্টের সঙ্গে ইঞ্জিনে যদি কোনো রাসায়নিক ফুয়েল কন্ডামিনেশন কিংবা সুপার এবজরমেন্ট পলিমার (এসএপি) জাতীয় পদার্থ ইঞ্জিনে প্রবেশ করে তাহলে ইঞ্জিন চালু করার সঙ্গে সঙ্গে আগুন ধরে যাওয়ার আশংকা থাকে। যেহেতু জ্বালানির মাধ্যমে ইঞ্জিনে আগুন তৈরি হয় কাজেই এটি দ্রুত টের পাওয়াও যায় না। যার কারণে পাইলটরা বুঝে ওঠার আগেই ইঞ্জিন পুড়ে যায়।

যে ঘটনায় উড়োজাহাজে ভেজাল জ্বালানির অস্তিত্ব প্রমাণিত : ২০১৬ সালের সাত জুনের ঘটনা। বিমানের বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর উড়োজাহাজ (বিজি ০৪৯) আকাশে ডানা মেলার আগ মুহূর্তে এর একটি ইঞ্জিনে আগুন ধরে। অল্প সময়ের মধ্যেই ইঞ্জনটি পুড়ে যায়। এ ঘটনায় দীর্ঘদিন ধরে তদন্ত চলে। আগুন লাগার হদিস বের করতে ওই ইঞ্জিনটি নেয়া হয় জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্রের অত্যাধুনিক ল্যাবরেটরিতে। দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষে জানা যায়, আগুন লাগার কারণ হল ভেজাল তেল। এর আগে জার্মানির ইঞ্জিন প্রস্তুতকারী কোম্পানি জিইর আরও দুটি ইঞ্জিন একইভাবে ভেজাল জ্বালানির কারণে পুড়ে গিয়েছিল। জার্মানির ইঞ্জিন প্রস্তুতকারী কোম্পানি ‘জিই’ তাদের সর্বশেষ রিপোর্টে বলেছে, বোয়িং-৭৭৭ এর ইঞ্জিনে জ্বালানি তেলের মধ্যে ভেজাল হিসেবে ভয়াবহ কন্ডামিনেশন সুপার এবজরমেন্ট পলিমার (এসএপি) ছিল। প্রতিটি ইঞ্জিনের একটি করে ফুয়েল ও অয়েল ফিল্টার থাকে। এছাড়া জ্বালানি তেলের পাম্প থেকে যে গাড়ির মাধ্যমে বিমানে তেল ঢুকানো হয় সে গাড়িতেও ফুয়েল ফিল্টার থাকে। তেলের ভেজাল কিংবা পানি বা অন্য কোনো ময়লাজাতীয় পদার্থ বা তেলের বাই-প্রডাক্ট যাতে ইঞ্জিনে প্রবেশ করতে না পারে সে কারণে এসব ফিল্টার ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বোয়িং চেকলিস্ট অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময় পরপর এই ফিল্টার পরিবর্তন করতে হয়। কিন্তু বিমানের ওই ইঞ্জিনটি পরীক্ষার পর দেখা গেছে ওই তেলের সঙ্গে যে সুপার এবজরমেন্ট পলিমার (এসএপি) ইঞ্জিনে প্রবেশ করেছিল। এই ‘সেপ’ এতটাই ভয়ঙ্কর ছিল ইঞ্জিন ও তেলবাহী গাড়ির ফিল্টারকে নষ্ট করে দিয়ে তারপর ইঞ্জিনে প্রবেশ করেছিল। এতে তেলের সঙ্গে বিকিরণ ঘটিয়ে ইঞ্জিনে আগুন লাগে।

ওই সময় উড়োজাহাজের ইঞ্জিনে যে জ্বালানি তেল ছিল তা কোন দেশের তা এখন পর্যন্ত শনাক্ত করতে পারেনি বিমান কর্তৃপক্ষ। এই ঘটনায় বিমানের উপ-মহাব্যবস্থাপক কর্পোরেট সেফটি অ্যান্ড কোয়ালিটি আবদুল ওয়াদুদকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এর আগে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) ও বাংলাদেশ বিমান এয়ারলাইন্স মিলে আরও দুটি তদন্ত কমিটির সদস্যরা এই ঘটনায় দীর্ঘ সময় ধরে তদন্ত করছেন।

http://www.jugantor.com/first-page/2017/03/24/111588/