২৪ মার্চ ২০১৭, শুক্রবার, ৮:৩৪

তিস্তা চুক্তি ও গঙ্গা ব্যারাজ নিয়ে সুস্পষ্ট অগ্রগতি নেই

প্রতিরক্ষা নিয়ে আলোচনায় আসছেন ভারতের সেনাপ্রধান

প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন দিল্লি সফরে প্রায় অর্ধশত চুক্তি বা সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) নিয়ে আলোচনা চললেও বাংলাদেশের অগ্রাধিকারে থাকা তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি সই এবং গঙ্গা ব্যারাজে ভারতের সহযোগিতা নিয়ে সুস্পষ্ট অগ্রগতি নেই। তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তিটি এখন উচ্চপর্যায়ের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির অনাপত্তি পাওয়ার ওপর নির্ভর করছে। ভারতের ওপর গঙ্গা ব্যারাজের কী প্রভাব পড়বেÑ এই সমীক্ষা ছাড়া গঙ্গা ব্যারাজ নিয়ে বাংলাদেশকে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিতে নারাজ দিল্লি। তবে অববাহিকাভিত্তিক পানি ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে ভারতের কাছ থেকে একটি ইতিবাচক ঘোষণা আসতে পারে।
এ দিকে ভারতের সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল বিপিন রাওয়াত দ্ইু দিনের সফরে আগামী ৩০ মার্চ ঢাকা আসছেন। আনুষ্ঠানিকভাবে এই সফরকে বাংলাদেশের সেনাপ্রধানের ফিরতি সফর হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের সেনাপ্রধান জেনারেল আবু বেলাল মুহাম্মদ শফিউল হক দিল্লি সফর করেছিলেন। এবার জেনারেল রাওয়াত আসছেন তারই আমন্ত্রণে। তবে প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফরের প্রাক্কালে ভারতীয় সেনাপ্রধানের সফরে সরকারের উচ্চপর্যায়ের সাথে প্রস্তাবিত বাংলাদেশ-ভারত প্রতিরক্ষা সহযোগিতা রূপরেখার এমওই স্বাভাবিকভাবেই আলোচনায় আসবে।
সফরকালে জেনারেল রাওয়াত রাষ্ট্রপতি মো: আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন। সেনাপ্রধানের সাথে তিনি দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন। সামরিক বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের সাথেও তার আলোচনা হবে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন ভারত সফরে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি সইয়ের প্রস্তুতি রাখছে ঢাকা ও দিল্লি। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির সম্মতি পেলেই চুক্তিতে সই করবে দুই দেশ। সম্প্রতি ভারতে অনুষ্ঠিত বিধানসভা নির্বাচনে বিশেষ করে উত্তর প্রদেশে ক্ষমতাসীন বিজেপি অপ্রত্যাশিতভাবে ভালো করায় আগের চেয়েও শক্তিশালী অবস্থানে চলে এসেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। আর এ অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে রাজ্য সরকারের সাথে দরকষাকষিতে সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার।
তবে গঙ্গা ব্যারাজ নিয়ে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি জটিল হয়ে উঠেছে। ফারাক্কা বাঁধের কারণে গঙ্গায় পলি পড়ছে, আর এজন্য উজানে বন্যা দেখা দিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠছে। তাই ফারাক্কা বাঁধ ভেঙে ফেলার দাবি ভারতে প্রবল হচ্ছে। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নিনেশ কুমার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে সাক্ষাৎ করে ফারাক্কা বাঁধের কারণে সৃষ্ট সমস্যার কথা আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছেন। মমতা ব্যানার্জিও সম্প্রতি একই দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন।
তিস্তা চুক্তি নিয়ে মমতার অবস্থানে পরিবর্তন আনতে দিল্লিতে রাষ্ট্রপতি ভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে তার সরাসরি বৈঠক আয়োজনের পরিকল্পনা করছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। প্রধানমন্ত্রী দিল্লি সফরকালে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সরকারি বাসভবনে অতিথি হিসেবে থাকবেন। শেখ হাসিনার সাথে মমতার বৈঠকের সময় বাঙালি এই রাষ্ট্রপ্রধান উপস্থিত থাকতে পারেন।
২০১১ সালে তিস্তার অন্তর্বর্তী চুক্তির জন্য করা খসড়ার আলোকেই বাংলাদেশ বিষয়টির নিষ্পত্তি চায়। সে বছরই ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরকালে তিস্তা চুক্তি সই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মমতা ব্যানার্জির আপত্তির কারণে শেষ মুহূর্তে এই চুক্তি সইয়ের সিদ্ধান্ত থেকে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার সরে আসে। এর প্রতিক্রিয়ায় চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহারে সম্মতিপত্র সইয়ে অপারগতা প্রকাশ করে বাংলাদেশ। পরবর্তী সময়ে তিস্তা চুক্তি সইয়ে মমতাকে নানাভাবে সম্মত করার চেষ্টা করেছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ও বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে তাকে ঢাকায় আমন্ত্রণ জানিয়ে ব্যাপক আপ্যায়নও করা হয়। এ ছাড়া ২০১৫ সালের জুনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরসঙ্গী হিসেবে তিনি বাংলাদেশে আসেন। এ সময় দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী ও মমতার মধ্যে একান্তে আলাপ হয়। তবে মমতা আশ্বাস দেয়া ছাড়া তিস্তা চুক্তি সইয়ে কোনো ধরনের নিশ্চয়তা দেননি।
পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনের পর তিস্তা নিয়ে মমতার অবস্থান পরিবর্তন হবে বলে ধারণা করা হয়েছিল। এই নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে দ্বিতীয়বারের মতো সরকার গঠন করেন মমতা। তবে এরপর বিভিন্ন ইস্যুতে কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে তার সম্পর্কের অবনতি হয়। সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির বিপুল বিজয়, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোদির অবস্থান আরো সুসংহত হওয়া বা বিশেষ আর্থিক প্যাকেজের আশ্বাসÑ যাই হোক না কেন, জাতীয় স্বার্থে তিস্তা চুক্তি নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে পশ্চিমবঙ্গের সমঝোতায় পৌঁছানোর একটি সম্ভাবনা রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
কিন্তু গঙ্গা ব্যারাজ নিয়ে কোনো সুখবর পাওয়া যাচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রীর সফরের প্রস্তুতি নিয়ে সম্প্রতি পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হকের সাথে সাক্ষাৎ শেষে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে ভারতের হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা বলেছেন, গঙ্গা ব্যারাজ সম্পর্কিত প্রথম বৈঠকে একটি যৌথ কারিগরি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির কার্যপরিধি, গঠনপ্রণালী নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এই ব্যারাজ থেকে বাংলাদেশ কিভাবে লাভবান হবেÑ তা নিয়ে সমীক্ষা হয়েছে। কিন্তু এতে ভারতের ওপর কী প্রভাব পড়বে তার ওপর সমীক্ষা করতে হবে। বিষয়টি এগিয়ে চলছে।
প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফরের আগে গঙ্গা ব্যারাজ সংক্রান্ত যৌথ কারিগরি কমিটির একটি বৈঠক হওয়ার কথা শোনা গেলেও গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত এ ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি নেই।
বিশ্ব পানি দিবস উপলক্ষে গত বুধবার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠান শেষে পানিসম্পদ মন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল হক বলেছেন, তিস্তা চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। তবে তা ঠিক কবে সই হবে তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফরের সময় উচ্চপর্যায়ে যেকোনো ধরনের সিদ্ধান্ত হতে পারে। পানিবণ্টন নিয়ে ভারতের সাথে বিভিন্ন চুক্তি নিয়ে আলোচনা চলছে।
একই দিন দিল্লিতে এক সেমিনারে ভারতের পানিসম্পদ মন্ত্রী উমা ভারতী বলেছেন, বাংলাদেশ ও নেপালের মতো প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক শক্তিশালী করতে নদী ও পানি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/206271