হামলার শিকার পুলিশকে বাঁচাতে এমপি টোবিয়াসের প্রাণান্তকর চেষ্টা
২৪ মার্চ ২০১৭, শুক্রবার, ৮:১৯

গণতন্ত্রের হৃৎপিণ্ডে সন্ত্রাসের হানা

মধ্যাহ্ন বিরতি শেষে বৃটিশ পার্লামেন্ট তখন জমজমাট। উভয়কক্ষেই চলছিল অধিবেশন। ছিলেন প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে’ও। কিন্তু একদম হঠাৎই বদলে গেল সব। চারদিকে আতঙ্ক। রক্তপাত। প্রাণহানি। তিন মিনিটের তাণ্ডব। কয়েক ঘণ্টার জন্য বন্ধ হয়ে গেল বৃটিশ পার্লামেন্ট। গণতন্ত্রের বেদিতে আঘাত হানলো সন্ত্রাসের ভয়াল থাবা।
৩১০ বছরের পুরনো পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন এই বৃটিশ পার্লামেন্ট। দুনিয়ার গণতন্ত্রের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নাম। আজও নিজ ঐতিহ্য থেকে বিচ্যুত হয়নি এই ভবন। গণতন্ত্র আর মানবাধিকারের পক্ষে নিজের অবস্থান ঘোষণা করে গেছে বারবার। বুধবার সন্ত্রাসীরা তাদের টার্গেট হিসেবে বেছে নিলো সেই ভবনকেই। টেমস নদীর ওপর ওয়েস্টমিনস্টার ব্রিজ। এই ব্রিজ দিয়ে পার্লামেন্টে যাওয়ার পথে পথচারীদের ওপর গাড়ি তুলে দেয় এক সন্ত্রাসী। গাড়িটি আঘাত হানে পার্লামেন্টের বেষ্টনীতে। পরে ওই সন্ত্রাসী ছুরি হাতে পার্লামেন্ট ভবনের দিকে এগুতে থাকে। হামলা করে পুলিশের ওপর। পুরো হামলায় নিহত হয়েছেন এক পুলিশ সদস্যসহ ৩ জন। আর পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছে ওই হামলাকারী। হামলায় আহত হয়েছেন ৪০ জন। বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে জানিয়েছেন, হামলাকারীর জন্ম বৃটেনেই। জঙ্গিদের সঙ্গে যোগাযোগের কারণে নিরাপত্তা বাহিনী একবার তার ব্যাপারে তদন্তও করেছে। হামলাকারীকে নিজেদের ‘যোদ্ধা’ বলে দাবি করেছে জঙ্গি সংগঠন আইএস। হামলায় জড়িত সন্দেহে এ পর্যন্ত ৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মেট্রোপলিটন পুলিশের সন্ত্রাস-দমন বিভাগের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা মার্ক রাওলি বলেছেন, কয়েক শ’ গোয়েন্দা পুলিশ রাতভর অভিযান চালিয়েছে।
আগেই আশঙ্কা ছিলো। ইউরোপের দেশে দেশে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটছিলো। অনেকদিন ধরেই সন্ত্রাসীদের টার্গেট ছিলো বৃটেন। হামলার হুঁশিয়ারিও দেয়া হয়েছিলো বারবার। বৃটিশ পুলিশ একের পর এক নস্যাৎ করে দিয়েছিলো সন্ত্রাসী হানার ছক। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্রের হৃৎপিণ্ডতেই যে সন্ত্রাসীরা আঘাত হানবে তা হয়তো ভাবা যায়নি। এ হামলায় নিন্দার ঝড় উঠেছে বিশ্বব্যাপী। হামলায় ফরাসি শিক্ষার্থী আহত হওয়ার ঘটনায় তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আইফেল টাওয়ারের সব আলো মধ্যরাতে নিভিয়ে দেয়া হয়।
হামলার নিন্দা জানিয়ে বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মে একে অসুস্থ এবং বিকৃত রুচির কাজ বলে অভিহিত করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীদের নিয়ে জরুরি মিটিং শেষে তিনি বলেন, বৃটিশ পার্লামেন্ট গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, মানবাধিকার ও আইনের শাসনের মতো মূল্যবোধ চর্চা করে বিশ্বের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা অর্জন করেছে। যারা এই মূল্যবোধ প্রত্যাখ্যান করেছে, তাদের কাছে বৃটিশ পার্লামেন্ট অবশ্যই একটি টার্গেটে পরিণত হয়েছে। কিন্তু সন্ত্রাসের কাছে বৃটেন হার মানবে না বলে প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তেরেসা মে। তিনি বলেন, ঘৃণা এবং অশুভ শক্তি বৃটেনকে বিভক্ত করতে পারবে না।
বুধবার বিকাল পৌনে তিনটার কিছু আগে শুরু হয় এই তাণ্ডব। হামলাকারী গাড়িটি পথচারীদের ওপর তুলে দিলে নিহত হন দুই জন। আহত হন আরো অনেকে। গাড়িটি পার্লামেন্টের রেলিংয়ে আঘাত হানার পর হামলাকারী ছুরি হাতে পার্লামেন্ট ভবনের দিকে এগুতে থাকে। সেখানে পুলিশ তাকে বাধা দেয়। তখন একজন নিরস্ত্র পুলিশ অফিসার কিথ পালমারকে ছুরিকাঘাত করে হামলাকারী। কিথ পালমার নিহত হন। হামলাকারীকে লক্ষ্য করে গুলি করে পুলিশ। নিহত হয় হামলাকারী।
নিহত পুলিশ কর্মকর্তার নাম কিথ পালমার। তার বয়স ৪৮। তিনি ছিলেন পুলিশের পার্লামেন্টারি ও ডিপ্লোমেটিক প্রটেকশন কমান্ডের সদস্য। তিনি ১৫ বছর ধরে পুলিশে কর্মরত ছিলেন। নিহত এক পথচারীর নাম আয়শা ফ্রেড। তিনি লন্ডনের ডিএলডি কলেজে কাজ করতেন। নিহত আরেক ৫০ বছর বয়সী পুরুষ। আহতদের মধ্যে ৭ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। আহতদের মধ্যে আছে তিন জন পুলিশ কর্মকর্তা। তারা একটি অনুষ্ঠান থেকে পায়ে হেঁটে ফিরছিলেন। একদল ফরাসি স্কুলছাত্রও ঐ সময় ওয়েস্টমিনস্টার ব্রিজের ওপর ছিলেন। তাদের একজন আহত হয়েছেন।
লন্ডনের দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্টের রাজনীতি বিষয়ক সম্পাদক টিম পিক ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে টুইটে বলেছেন, তীব্র বিস্ফোরণের শব্দ। তারপর আর্তনাদ। গুলির শব্দ। সর্বত্রই সশস্ত্র পুলিশ। প্রেস এসোসিয়েশনের রাজনীতি বিষয়ক সম্পাদক অ্যান্ড্রু উডকক এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। তিনি নিজের অফিসের জানালা দিয়ে পুরো ঘটনা দেখেছেন। তিনি বলেছেন, বাইরের দিক থেকে তীব্র চিৎকার ও আর্তনাদ শুনতে পাই। তারপর বাইরে তাকাই। দেখতে পাই ব্রিজ স্ট্রিট থেকে পার্লামেন্ট স্কয়ারের দিকে দৌড়ে যাচ্ছে ৪০ থেকে ৫০ জন মানুষ। দেখে মনে হচ্ছিল কোনো কিছু দেখে তারা দৌড়ে পালাচ্ছিল। তারা ক্যারিজ গেটস এলাকায় নিরাপত্তা প্রবেশপথে নিয়োজিত পুলিশ সদস্যদের কাছে পৌঁছে। এ সময় অকস্মাৎ ভিড়ের ভেতর থেকে দৌড়ে বেরিয়ে আসে একজন। সে খোলা প্রাঙ্গণে চলে যায়। দেখে মনে হচ্ছিল সে রান্নাঘরে ব্যবহারের লম্বা একটি ছুরি ধরে ছিল। শুনতে পাই শব্দ, সেটা গুলির শব্দের মতো। এরপরেই দেখতে পাই মাটিতে পড়ে আছে দু’জন। অন্যরা দৌড়ে তাদেরকে সাহায্য করতে এগিয়ে যাচ্ছে। দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে আসে সশস্ত্র পুলিশ। আমি শুনতে পাই তারা লোকজনকে খোলা প্রাঙ্গণে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছে। হার্ভার্ডস সেন্টার ফর ইউরোপিয়ান স্টাডিজের সিনিয়র ফেলো র্যাডোস্লাউ সিকোরস্কি এ ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন। তিনি এর একটি ভিডিও পোস্ট করেছেন টুইটারে। তাতে দেখা যায়, ওয়েস্টমিনস্টার ব্রিজের ওপর রাস্তায় পড়ে আছে আহত মানুষ। তিনি লিখেছেন, ওয়েস্টমিনস্টার ব্রিজের ওপর একটি গাড়ি কমপক্ষে ৫ জন মানুষকে যেন মই দেয়ার মতো ডলে রেখে গেছে।
হামলার সময় স্কটল্যান্ড পার্লামেন্টে স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতা প্রশ্নে দ্বিতীয় গণভোট নিয়ে বিতর্ক হচ্ছিল। সঙ্গে সঙ্গে স্থগিত করে দেয়া হয়েছে তা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প এই হামলার পর বৃটেনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ণ সমর্থনের কথা জানিয়েছেন। ব্রাসেলসে সন্ত্রাসী হামলার শিকার ব্যক্তিদের স্মরণে এক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যাওয়া ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট জ্যঁ ক্লদ জাঙ্কার জানিয়েছেন, লন্ডনে এই হামলা তাকে ‘ভীষণ আবেগপ্রবণ’ করেছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগান বলেছেন, তুরস্ক বৃটেনের কষ্টে সমব্যথী।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=58607&cat=2/