২৩ মার্চ ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৯:৫৩

সরকারি ব্যাংকের দুর্নীতির দায় চাপছে জনগণের ঘাড়ে

তিন বছরে ৬ ব্যাংকের মূলধন জোগান ৮ হাজার কোটি টাকা

রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের দুর্নীতি ও অনিয়মের দায় মেটানো হচ্ছে জনগণের অর্থ দিয়ে। গত তিন বছরে সরকারি ছয় ব্যাংকে ভর্তুকি দেয়া হয়েছে সাত হাজার ৭৮০ কোটি টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থের জোগান দেয়া হয়েছে সোনালী ব্যাংককে দুই হাজার ৭০৫ কোটি টাকা। আর বেসিক ব্যাংককে দেয়া হয়েছে দুই হাজার ৫৯০ কোটি টাকা।


বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, গত ডিসেম্বর শেষে পাঁচ ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা। এ ঘাটতি কিভাবে পূরণ করা যায়, তা নিয়ে পর্যালোচনা করছে সরকার।
তিন বছরে মূলধন জোগানের চিত্র : ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ছয়টি সরকারি ব্যাংকের চার হাজার ৩৫৫ কোটি টাকার মূলধন জোগান দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংককে দেয়া হয়েছে চার হাজার ১০০ কোটি টাকা। ২০১৩ সালের ২৬ ডিসেম্বর সোনালী ব্যাংককে মূলধন জোগান দেয়া হয়েছে এক হাজার ৯৯৫ কোটি টাকা, জনতা ব্যাংকের ৮১৪ কোটি টাকা, অগ্রণী ব্যাংকের এক হাজার ৮১ কোটি টাকা এবং রূপালী ব্যাংককে দেয়া হয়েছে ২১০ কোটি টাকা। এর বাইরে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংককে দেয়া হয়েছে ১৭৫ কোটি টাকা এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংককে দেয়া হয়েছে ৮০ কোটি টাকা।
২০১৪-১৫ অর্থবছরে চার ব্যাংককে মূলধন পূরণ করা হয়েছে দুই হাজার ২২৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে সোনালী ব্যাংককে ২০১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর জোগান দেয়া হয়েছে ৭১০ কোটি টাকা। একই বছরে বরাদ্দকৃত বেসিক ব্যাংককে জোগান দেয়া হয়েছে দুই দফায় এক হাজার ৩৯০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর ছাড় করা হয়েছে ৭৯০ কোটি টাকা এবং পরের বছর ১৫ জুন ছাড় করা হয়েছে আরো ৪০০ কোটি টাকা।
২০১৫-১৬ অর্থবছরে শুধু সমস্যাকবলিত বেসিক ব্যাংককে এক হাজার ২০০ কোটি টাকার মূলধন পূরণ করা হয়। ওই বছরের ৩০ ডিসেম্বর বেসিক ব্যাংকের অনুকূলে এ অর্থ ছাড় করা হয়।।


চলতি অর্থবছরে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি মেটানোর জন্য বাজেটে আরো দ্ইু হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। এ অর্থ বেসিক ব্যাংকের অনুকূলে ছাড় করার সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, হলমার্ক কেলেঙ্কারির মাধ্যমে চার হাজার কোটি টাকার ওপরে বের করে নেয়া হয় সোনালী ব্যাংক থেকে। এ অর্থের প্রকৃত সুবিধাভোগী কারা তা আজো বের হয়নি। অথচ কিছু ব্যাংক কর্মকর্তাকে এ জন্য শাস্তি দেয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে রয়েছে। ২০১২ থেকে শুরু করে মাত্র দুই বছরে বেসিক ব্যাংক থেকে বের করে নেয়া হয় প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। এসব ব্যাংকের ওই সময়ের পরিচালন পর্ষদের সদস্যরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে। জনতা ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংক থেকে বিসমিল্লাহ নামক একটি প্রতিষ্ঠান এক হাজার ২০০ কোটি টাকা নিয়ে উধাও হয়েছে। পানির মতো টাকা বের হয়ে গিয়েছে রূপালী ব্যাংক থেকে। বহুল আলোচিত বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও এমডি নির্বিঘেœ দেশ ছেড়েছে। এসব অনিয়মের কারণে ব্যাংকগুলোর বিশাল অঙ্কের মূলধন ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এ ঘাটতি মেটানো হচ্ছে জনগণের করের অর্থ দিয়ে।


নাম প্রকাশ না করার শর্তে সরকারি একটি ব্যাংকের এমডি জানিয়েছেন, নানা কারণে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ কমানো যাচ্ছে না। ওই কর্মকর্তা মনে করেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর অন্যতম সমস্যা হলো রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। কারণ, এক দিকে পরিচালনা পর্ষদে যাদেরকে নিয়োগ দেয়া হয় তাদের বেশির ভাগই সরকারি দলের সমর্থক, অপর দিকে ঋণ বিতরণে রাজনৈতিক চাপ। রাজনৈতিক তদবিরের মাধ্যমে ঋণের চাপ আসে। আবার ওই ঋণ অনুমোদন দেয়া হয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের দ্বারা পরিচালিত পরিচালনা পর্ষদের মাধ্যমে। ফলে যারা ঋণ নেন, তারাও কোনো না কোনোভাবে সরকারি আদর্শে বিশ্বাসী। এতে যে ঋণ দেয়া হয় তা আর ফেরত আসে না। এভাবেই সরকারি ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পাহাড় জমে যাচ্ছে। আবার ব্যাংক থেকে ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেয়া কঠিন। কোনো প্রকার ডাউন পেমেন্ট না দিয়েই অনেকেই ঋণ নবায়ন করছে। এটাও পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদনক্রমে। কিন্তু দিন শেষে সব দোষ চাপে ব্যাংকের এমডিসহ কর্মকর্তাদের ওপর। ওই এমডি মনে করেন, রাজনৈতিক চাপ না এলে ব্যাংকগুলোতে সুশাসন ফিরে আসত।


এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড, সালেহউদ্দিন আহমেদ গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, জনগণের অর্থ দিয়ে সরকারি ব্যাংকগুলোর মূলধন জোগান দিয়ে ব্যাংকগুলোর কোনো লাভ হচ্ছে না, বরং জনগণের অর্থ অপচয় হচ্ছে। তিনি বলেন, ব্যাংকগুলোতে যে দুর্নীতি হচ্ছে এটা কমানোর উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। এর জন্য খেলাপি ঋণ আদায় বাড়ানোর ওপর ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করা উচিত। কেননা দুর্নীতির মাধ্যমে যে ঋণ দেয়া হচ্ছে তা এক সময়ে খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। আর এ খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি হচ্ছে। সাবেক এ গভর্নর মনে করেন, জনগণের অর্থ দিয়ে ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি মেটানোর ফলে দুর্নীতি ও লুটপাটকেই উৎসাহিত করা হচ্ছে বলে তিনি মনে করেন।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান জানিয়েছেন, সরকারি ব্যাংকগুলোর মূলধনের জোগান দেয়া সম্পূর্ণই ব্যাংকিং খাতের আর্থিক শৃঙ্খলার পরিপন্থী। কেননা, প্রতিবছর জনগণের করের অর্থ দিয়ে ব্যাংকগুলোর দুর্নীতির দায় মেটানো হচ্ছে এতে জনগণের কোনো লাভ হচ্ছে না। তিনি মনে করেন, ব্যাংকগুলোর আর্থিক শৃঙ্খলা ফিরে আনার জন্য ব্যাংকগুলোতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। তা না হলে বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে সামনে আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা নষ্ট হবে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/205974