২২ মার্চ ২০১৭, বুধবার, ৯:২৩

আজ বিশ্ব পানি দিবস

ঢাকা ওয়াসার পানির মানও প্রশ্নবিদ্ধ

ঢাকা ওয়াসার সরবরাহ করা পানির মান নিয়ে অনেক অভিযোগ। পানির মান যাচাইয়ের জন্য সংস্থাটির একটি আলাদা বিভাগ থাকলেও এর ভূমিকা দৃশ্যমান নয়। এমনকি পানির গুণাগুণ পরীক্ষার পর তা প্রকাশও করছে না সংস্থাটি। ঢাকা ওয়াসার পানি পরীক্ষা করে মাঝেমধ্যে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা যে তথ্য উপস্থাপন করে, তা উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো। কিন্তু বাধ্য হয়ে নগরবাসী পান করছে দূষিত পানি। মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত স্তরের নাগরিকরা ঢাকা ওয়াসার সরবরাহ করা পানি আবার নানাভাবে শোধন করার পর ব্যবহার করলেও নিম্নবিত্ত পরিবারের পক্ষে সেটা সম্ভব হয়ে ওঠে না। রাজধানীর মিরপুর, সবুজবাগ, খিলগাঁও, মালিবাগ, বাড্ডা ও পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকার পানিতে মাঝেমধ্যেই প্রকট দুর্গন্ধ থাকে। যদিও এসব অভিযোগ বরাবরই উড়িয়ে দেয় ঢাকা ওয়াসা।


জানা যায়, ঢাকা মহানগরীতে এখন পানির চাহিদা দৈনিক প্রায় ২৩০ কোটি লিটার। এর মধ্যে ১৭০ কোটি লিটার পানি তোলা হয় গভীর নলকূপ দিয়ে। অবশিষ্ট প্রায় ৬০ কোটি লিটার সরবরাহ করা হয় বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যা থেকে, যা ঢাকা ওয়াসার পাঁচটি শোধনাগারের মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়।


পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা ও বালু নদের পানির মান পরীক্ষা করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছি। এতে দেখা যায়, বর্ষা মৌসুমে পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা কিছুটা বাড়লেও শুকনো মৌসুম এলে তা খুব কমে যায়। পানিতে ক্ষারের মাত্রা বর্ষা মৌসুমে কম থাকলেও শুকনো মৌসুমে ভয়াবহ আকার ধারণ করে। বুড়িগঙ্গার পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ পাওয়া যায় মাত্র ০.৩০ শতাংশ। ক্ষার পাওয়া যায় ৯.১৬ শতাংশ। এ রকম পানিতে মাছ-শুশুকের মতো জলজ প্রাণীর পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। ২০১৪ সালের মার্চে শীতলক্ষ্যার কাঁচপুর খাল পয়েন্ট থেকে সংগৃহীত পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ পাওয়া গিয়েছিল ০.১৮ শতাংশ। ২০১৬ সালের মার্চে পাওয়া গেছে ০.১৯ শতাংশ। একইভাবে পানিতে ক্ষারের পরিমাণ ৮.৩৪ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৯.১১ শতাংশ। পানিতে আরো পাওয়া গেছে অ্যামোক্সিসিলিন, পেনিসিলিন, সিপ্রোফ্লোক্সাসিন, অ্যাজিথ্রোমাইসিন, সিসা ও নিকেলের মতো ৬২টি ক্ষতিকর উপাদান। ফলে এই পানি শোধন করলেও তা পানযোগ্য হচ্ছে কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে। ’


জানা যায়, এর আগে ২০১০ সালে সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) পরীক্ষায় ওয়াসার পানিতে ব্যাকটেরিয়া ও দ্রবীভূত কঠিন পদার্থ পাওয়া গিয়েছিল। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুসারে ওই পরীক্ষা চালানো হয়েছিল। পরীক্ষার প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজধানীর ২২টি স্থান থেকে পানির নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে ১১টি সংগ্রহ করা হয়েছে ওয়াসার গভীর নলকূপ থেকে। বাকি ১১টি নেওয়া হয়েছে ওয়াসার পানির সরবরাহ লাইন থেকে। এই ২২টি নমুনার মধ্যে মাত্র সাতটি স্থানের পানি বিশুদ্ধ ও নিরাপদ বলে দেখা গেছে। এই সাতটির মধ্যে পাঁচটি স্থানের পানি গভীর নলকূপ ও দুটি স্থানের পানি ওয়াসার পাইপলাইন থেকে নেওয়া হয়েছে। তবে নমুনার বাকি ১৫টি স্থানের পানি বিএসটিআইয়ের মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হয়নি। এমনকি চারটি স্থানের পানিতে টোটাল ডিজলভড সলিডস (সম্পূর্ণ দ্রবীভূত কঠিন পদার্থ) পাওয়া যায়। আটটি স্থানের পানিতে ব্যাকটেরিয়া ও অন্যান্য উপাদান পাওয়া গেছে, যা গ্রহণযোগ্যতার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হয়নি।


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. দিদার-উল-আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ঢাকা ওয়াসা যে পানি সরবরাহ করে থাকে তাকে পুরোপুরি সুপেয় পানি বলা যাবে না। এর প্রধান কারণ, ওয়াসা যেসব জায়গাকে পানির উৎস হিসেবে ব্যবহার করে তা এতটাই দূষিত যে পরিশোধনের পরও স্বাভাবিক অবস্থায় আসে না। এ ছাড়া ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্টেও (পানি শোধনাগার) সঠিকভাবে পরিশোধন হয় না। পানি দুর্গন্ধমুক্ত করতে যে কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় তা নিয়েও আরেক সমস্যা। পরিমাণে বেশি ব্যবহার করলে পানিতে কেমিক্যালের গন্ধ থাকে। আর পরিমাণে কম দিলে পানিতে দুর্গন্ধ থাকে। সব কিছু মিলিয়ে পানি সরবরাহের বিষয়টি নিয়ে ওয়াসাকে আরো যুগোপযোগী চিন্তাভাবনা করতে হবে। ’


বিশেষজ্ঞরা জানান, বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যার বিষাক্ত হয়ে পড়া পানি শোধন করতে মেশানো হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত ক্লোরিন, লাইম (চুন) ও অ্যালাম (ফিটকিরি)। ফলে শোধনের পর অনেক সময় পানিতে ক্লোরিনের গন্ধ পাওয়া যায়। আবার পুরনো পাইপের মাধ্যমে পানি সরবরাহ করায় পানিতে অনেক সময় দুর্গন্ধ পাওয়া যায়। কিছু এলাকায় পাইপলাইনে ফুটা করে অবৈধভাবে পানির লাইন দেওয়া হয়েছে। সেসব ফুটা দিয়ে ময়লা-আবর্জনা প্রবেশ করে পানিতে ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে ফোটানোর পরও সেই পানি পান করা যাচ্ছে না।


যদিও ওয়াসা কর্তৃপক্ষ বরাবরই তাদের সরবরাহ করা পানির মান নিয়ে সব আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী তাকসিম এ খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বুড়িগঙ্গা-শীতলক্ষ্যা থেকে যে পানি সরবরাহ করা হয় তার উেস দূষণ থাকায় শোধন করতে মাত্রাতিরিক্ত কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়। ফলে ওই পানিতে কেমিক্যালের কিছু গন্ধ থাকে, তবে তা ব্যবহারের অনুপযোগী নয়। ’ তিনি জানান, মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলায় পদ্মা (জশলদিয়া) পানি শোধনাগার প্রকল্পের কাজ শেষ হলে সমস্যা থাকবে না।


আন্তর্জাতিক উদরাময় রোগ গবেষণাকেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) গবেষকরা জানান, রাজধানীতে ডায়রিয়া সংক্রমণের অন্যতম প্রধান কারণ বিশুদ্ধ পানির অভাব। পানিতে জীবাণু থাকে বলেই আইসিডিডিআরবি হাসপাতালে সারা বছর ডায়রিয়ার রোগী আসে।


রাজধানীর বেশ কিছু এলাকার পানিতে সম্প্রতি ময়লা ও দুর্গন্ধ পাওয়ার কথা জানা গেছে। আজিমপুর সরকারি কলোনিতে সরবরাহ করা পানি দুর্গন্ধযুক্ত ও নোংরা থাকার অভিযোগ মিলেছে। এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা জানায়, এখানকার ওয়াসার পাইপলাইনগুলো অনেক পুরনো। পাইপে মরিচা পড়ে অনেক স্থানে ফুটা হয়ে গেছে। এসব ফুটা দিয়ে ড্রেনের ময়লাযুক্ত পানি পাইপলাইনে মিশে একাকার হয়ে যায়। এ ছাড়া পুরান ঢাকার কয়েকটি এলাকার পানিতেও দুর্গন্ধ ও ময়লা-আবর্জনা পাওয়া যাচ্ছে।


ঢাকার পার্শ্ববতী শহর নারায়ণগঞ্জেও সরবরাহ করা পানিতে ময়লা-আবর্জনা, কেঁচোসহ বিভিন্ন ধরনের পোকামাকড় পাওয়া যায় বলে অভিযোগ রয়েছে। শহরের ইকবাল রোড, গলাচিপা, খানপুর, আমলাপাড়া, চাষাঢ়া, জামতলা, মাসদাইর উকিলপাড়া, পাইকপাড়া, নন্দীপাড়া, গোয়ালপাড়া, দেওভোগ, বাবুরাইল এলাকায় দুর্গন্ধযুক্ত কালো রঙের পানি প্রায়ই পাইপে আসছে। ডন চেম্বার, গলাচিপা, কলেজ রোড, চাষাঢ়া এলাকায় ওয়াসার পানিতে মাঝেমধ্যে কেঁচো আসতেও দেখা যায়।

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2017/03/22/477487