ওয়াসার পানির জন্য ধনী-গরিব সবাই সমান টাকা গোনে। ধনীরা অপচয় করলেও গরিবেরা খরচ করে হিসাব কষে। তাও মেলে না বিশুদ্ধ খাওয়ার পানি। বছরের এ সময়টা রাজধানীতে পানির সংকট প্রকট হয়ে ওঠে। তখন খাওয়ার পানির জন্য স্বল্প আয়ের মানুষ ছোটে ওয়াসার গাড়ির পেছনে। ছবিটি গতকাল জুর
২২ মার্চ ২০১৭, বুধবার, ৯:১০

ধনীর পানির অপচয়, গরিবের টানাটানি

ঢাকায় সচ্ছল একটি পরিবার শুধু টয়লেটের কমোড ফ্ল্যাশ করে দিনে যতটা পানি খরচ করে, তা দিয়ে বস্তির একটি পরিবার খাবার-রান্না-গোসলসহ সব কাজ চালায়।
অথচ দুটি পরিবারকে একই দামে সরকারের কাছ থেকে পানি কিনতে হয়। ওয়াসার এই পানিতে ধনী ও নিম্নবিত্ত পরিবার ভেদে সরকারের ভর্তুকিতে কোনো বেশি-কম নেই। ধনী পরিবারটি ফেলে-ছড়িয়ে পানির অপচয় করার সুযোগ পায়। বস্তির পরিবারটি অনেক হিসাব করে প্রয়োজন মেটায়।
ঢাকার পানি সরবরাহকারী একমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠান ঢাকা ওয়াসার তথ্য এবং নগরবাসীর পানি ব্যবহারের মানদণ্ড বিশ্লেষণ করে এ চিত্র পাওয়া গেছে।
আজ ২২ মার্চ বিশ্ব পানি দিবস। এবারের দিবসের প্রতিপাদ্য বর্জ্য পানির পুনর্ব্যবহার। মানে অপচয় প্রতিরোধ।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক পানি বিশেষজ্ঞ মুজিবুর রহমান বলেন, আর্থিকভাবে সচ্ছল ব্যক্তির অপচয়ের পানি দিয়ে একটি পরিবারের সারা দিনের খরচ চলে। এটা অন্যায্য।
এই পানি বিশেষজ্ঞের মতে, সচরাচর ধনী পরিবারে একবার কমোড ফ্ল্যাশ করলে ১৫ লিটার পানি যায়। এটা অপচয়। সরকার যদি পাঁচ লিটার ক্ষমতার লোডাউন ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে, তাহলে পানির অপচয় অনেক কমে যাবে।
রাজধানীর মহাখালীর সাততলা বস্তির বাসিন্দা সেলিনা খাতুন। তিনি গৃহিণী। চারজনের পরিবার তাঁর। স্বামী মুদিদোকানি।
এ বস্তিতে প্রায় ১০ হাজার লোকের বাস। পানির সংযোগ আছে সাড়ে তিন শ। একটি সংযোগ থেকে ১৫ থেকে ৩০টি পরিবার পানি পায়। সেলিনা খাতুন গত নভেম্বর মাসে ভ্যাটসহ পানির বিল দিয়েছেন ৮০ টাকা। প্রতি হাজার লিটার পানির মূল্য ১০ টাকা হিসাবে সেলিনা খাতুনের পরিবার পুরো মাসে পানি খরচ করেছে ৬ হাজার ৮০০ লিটার। অর্থাৎ প্রতিদিন এ পরিবারের পানি খরচ হয়েছে ২২৬ লিটার।
মহাখালীর এই বস্তি থেকে কিছু দূরে বনানীর এইচ ব্লকের ৭ নম্বর রোডে আশরাফ হোসেনের বাড়ি। পাঁচ সদস্যের এই পরিবার গত নভেম্বরে পানির বিল দিয়েছে ৬০০ টাকা। পানি খরচ করেছে ৫১ হাজার লিটার। প্রতিদিনের খরচ ১৭০০ লিটার।
এই পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের কমোড (১৫ লিটারের লোডাউন বা পানি রাখার জায়গা) আছে। প্রতিবার ফ্ল্যাশে ১৫ লিটার পানি খরচ হয়। দিনের হিসাবে কমোডে ফ্ল্যাশের জন্য অন্তত ৩৭৫ লিটার পানি খরচ হয় বলে তাদের ধারণা।
তবে বাজারে ৫ থেকে ১২ লিটার ধারণক্ষমতার ফ্ল্যাশ ট্যাংকও রয়েছে।
আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়াটার এইডের বাংলাদেশের প্রধান কর্মসূচি কর্মকর্তা আফতাব ওপেল বলেন, ‘আমাদের শহরে সচ্ছল একটি পরিবারে পানি ব্যবহারের ধরনে দেখা গেছে, সরবরাহ করা পানির ৪১ শতাংশ ব্যয় হয় গোসলের কাজে। ২২ শতাংশ কমোড ফ্ল্যাশ ও কাপড়চোপড় পরিষ্কারে, ৭ শতাংশ ঘরদোর পরিষ্কারে আর ৪ শতাংশ করে রান্না ও খাওয়ার পানি হিসেবে। অথচ একটি নিম্ন আয়ের পরিবার এর চেয়ে অনেক কম পানি ব্যবহার করে।
এই পরিস্থিতিতে আয় ও পানির ব্যবহারের ভিত্তিতে পানির বিল নির্ধারণের জন্য দাবি তুলেছেন অধিকারকর্মীরা। পানি অধিকার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন বেসরকারি সংস্থা দুস্থ স্বাস্থ্য কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক দিবালোক সিংহ। তিনি বলেন, সরকারের ভর্তুকি দেওয়া পানি কেউ অপচয় করবে বা ইচ্ছেমতো ব্যবহার করবে, এটা অন্যায়। পানির ব্যবহার ও আয়ের ওপর ভিত্তি করে বিল নির্ধারণ করা এ জন্য জরুরি।
ঢাকা ওয়াসা সূত্র জানায়, ওয়াসা সাড়ে তিন লাখ সংযোগের মাধ্যমে পানি দেয়। এই গ্রাহকদের মধ্যে মাত্র ১ শতাংশ নিম্ন আয়ের বস্তিবাসীর মানুষ।
ওয়াসার বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপক উত্তম কুমার রায় বলেন, এখন যে মূল্যে পানি সরবরাহ করা হয়, তা গরিবের জন্য নির্ধারিত মূল্যে ধনীরা ব্যবহার করে বলা যায়। আয় ও ব্যবহারের ভিত্তিতে পানির দাম নির্ধারণের বিষয়টি এখনো শুধু ‘গবেষণার পর্যায়ে’ আছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, এভাবে বিল নির্ধারণের বিষয়টি বেশ কঠিন। এ ক্ষেত্রে সমস্যা হিসেবে তিনি ঢাকার বাড়িগুলোর নির্মাণ কাঠামোকে দায়ী করেন। আর কমোডের ধারণক্ষমতার দিকটি নীতিনির্ধারণী বিষয়।
পানির চাহিদা দিন দিন বাড়ছে উল্লেখ করে অধ্যাপক মুজিবুর রহমান বলেন, যত কঠিন কাজই হোক, আয় ও ব্যবহারের ভিত্তিতে পানির মূল্য নির্ধারণ করতেই হবে।

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1116001/