২১ মার্চ ২০১৭, মঙ্গলবার, ৮:৫৪

শতফুল ফুটতে দাও

ঝড় হয়তো থামবে এবং তখন সেটা নতুন পত্র-পল্লবের সময়

অর্থই অনর্থের মূল বলে আমাদের সমাজে একটি নীতিকথা প্রচলিত আছে। এই নীতিকথার প্রতি সমাজের কত অংশ মানুষের আস্থা আছে তা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। যারা সমাজ পর্যবেক্ষণ করেন তারা বলে থাকেন, এদেশের আমজনতার অবৈধ অর্থের প্রতি ঝোঁক রয়েছে বলে অভিযুক্ত করা যাবে না। তাদের মতে, সমাজের বেশির ভাগ মানুষই দুর্নীতি, দুরাচার ও দুষ্কর্ম থেকে মুক্ত। সমাজের ক্ষমতাবান ব্যক্তিরাই নানারকম দুষ্কর্মের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। কারণ ক্ষমতার জোরেই দুষ্কর্ম সাধন করা সম্ভব। অর্থাৎ খুব মুষ্টিমেয়সংখ্যক মানুষ অবৈধ ও অন্যায় কাজের সঙ্গে যুক্ত। বাংলাদেশের সমাজকে জ্ঞানবুদ্ধি হওয়ার পর থেকে দেখে আসছি। সমাজবিজ্ঞানের একজন সংবেদনশীল ছাত্র হিসেবে সাধারণের তুলনায় আমার উপলব্ধি উল্লেখযোগ্যভাবে গভীরতর বলে আমি দাবি করতে পারি। অর্থকে অনর্থের মূল বলে এই লেখার সূচনা করলেও এখন মনে হয় আমরা যারা অর্থবিত্ত করার ফন্দি-ফিকির বের করতে পারিনি, তাদের জীবনটা অর্থহীন হয়ে পড়েছে। সমাজে যারা বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছে, তারা আমাদের দিকে আড় চোখে তাকায়। তারা মনে করে এই লোকগুলো অকর্মা, তাই তারা কিছু করতে পারেনি। আজ থেকে ৭০-৮০ বছর আগে যে সমাজে পরোপকারী নিঃস্বার্থ মানুষকে শ্রদ্ধার চোখে দেখা হতো, আজ সেই ধরনের মানুষের সংখ্যা খুব কমে গেছে। যারাও বা আছেন, তাদের জীবনযুদ্ধে ব্যর্থ মানুষ বলেই গণ্য করা হয়। সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি কথাও বলা হয়। বলা হয়ে থাকে, এই মানুষগুলোর কিছু করার যোগ্যতা ছিল না বলেই এদের আজ এই হাল হয়েছে।


ছোটবেলায় আমাদের একটি কবিতাংশের ভাবসম্প্রসারণ করতে হতো। ওই কবিতাংশে ছিল- বহু মূল্য পরিচ্ছদ, রতন ভূষণ/নরের মহত্ত্ব নারে করিতে বর্ধন/জ্ঞান পরিচ্ছদ আর ধর্মালংকার/নরের মহত্ত্ব করে বিস্তার। এই কবিতাংশের মধ্যে একটি জীবন-দর্শন ও মূল্যবোধের অভিব্যক্তি ঘটেছে। দামি পোশাক-আশাকে কোনো মানুষের যথার্থ মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। মানুষের মূল্য তার জ্ঞানে ও বিদ্যায় এবং তার ধর্মপ্রাণতায়। এই ধর্ম আনুষ্ঠানিক কোনো ধর্ম নয়। এই ধর্ম হল সৎ চিন্তা, সৎ ধ্যান, সৎ কর্ম তথা সৎ জীবনযাপনের প্রতিচ্ছবি। এ রকম মানুষ আদর্শ মানুষ। এরা অনুকরণীয় বলেও গুরুজনরা বলে থাকেন। ছোটবেলায় আমাদের কাছে একটি গল্প বিশেষভাবে আলোচিত হতো। গল্পটি ছিল ইরানি কবি শেখ সাদীকে কেন্দ্র করে। একবার এই বিখ্যাত কবি রাজদরবারে ভোজের জন্য নিমন্ত্রিত হয়েছিলেন। তিনি খুব মামুলি পোশাকে ভোজসভায় হাজির হয়েছিলেন; কিন্তু দরবারের প্রহরী তাকে অনুষ্ঠানে প্রবেশে বাধা দিল। কারণ তার পোশাক রাজদরবারের উপযোগী নয়। শেখ সাদী কোনো ধরনের প্রতিবাদ না করে অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করেন। বাড়ি ফিরে গিয়ে তার জাঁকজমকপূর্ণ পোশাকটি পরলেন। এমন পোশাকে রাজার ভোজসভায় হাজির হওয়ার পর প্রহরীরা তাকে সম্মানের সঙ্গে আসন পেতে দিল এবং যথারীতি খাবার-দাবারও পরিবেশন করল। শেখ সাদী সেই খাবার থেকে একদানা খাবারও মুখে পুরলেন না। খাবারগুলো তিনি আলখেল্লার পকেটে গুঁজতে শুরু করলেন। খাবার পরিবেশনকারী তার অমন আচরণের কারণ জানতে চাইলে তিনি বললেন, এই খাবার আমার পোশাকেরই প্রাপ্য। এই পোশাকের জন্যই আমি খাবার গ্রহণের আসন পেয়েছি। শেখ সাদী সম্পর্কিত এই কাহিনীটি আমাদের জন্য দারুণ শিক্ষণীয় ছিল। গুণের জন্য কদর নয়, কদর করা হয়েছিল ঐশ্বর্যময় পোশাককে।

সত্যি বলতে কী, আমাদের সমাজ থেকে গুণের কদর চলে গেছে। আমার এই বক্তব্য শুনে অনেকে হয়তো আপত্তি করবেন। কারণ রাজধানী ঢাকায় এবং বাংলাদেশের অন্যান্য শহরে গুণীজন সংবর্ধনার নামে হরহামেশা অনেক অনুষ্ঠান হয়। এসব গুণীজনের মধ্যে সত্যিকার অর্থে কতজন প্রকৃত গুণী সে ব্যাপারে সংশয়ের অবকাশ আছে। প্রতি বছর রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে একুশে ও স্বাধীনতা পদক প্রদানের অনুষ্ঠান হয়। এসব গুরুত্বপূর্ণ পদকের জন্য যাদের নির্বাচিত করা হয় তাদের মধ্যে সবাই এসব পদকের জন্য যোগ্য কিনা সে ব্যাপারেও সংশয়ের অবকাশ আছে। আমার এই বিচার ভুল হতে পারে; কিন্তু তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়ার মতো নয়। রাষ্ট্রীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ এসব পদক বিতরণে সত্যিকারের গুণ ও মেধার চেয়ে ক্ষমতাসীনদের নৈকট্যের বিষয়টি অধিকতর গুরুত্ব পায়। আবার পদক নিয়েও দুর্নীতির অভিযোগ আছে। আমার শিক্ষক এবং প্রখ্যাত লেখক অধ্যাপক শওকত ওসমানকে একবার রাষ্ট্রীয় পদক দেয়া হয়েছিল। তার আসল নাম ছিল আজিজুর রহমান। লেখালেখির জন্য তিনি শওকত ওসমান নামটি বেছে নিয়েছিলেন। শওকত ওসমান ছিলেন নিঃসন্দেহে একজন উঁচু মানের লেখক। তাকে যথার্থভাবেই পদকের জন্য নির্বাচিত করা হয়েছিল। তার লেখা উপন্যাস ‘কৃতদাসের হাসি’ একটি কালোত্তীর্ণ উপন্যাস। ছোটদের জন্য তার লেখা ‘ওটেন সাহেবের বাংলো’ শিশু-কিশোরদের জন্য খুবই সুখপাঠ্য লেখা ছিল। তার পদক পাওয়ার কিছুদিন পর সংবাদপত্রে ছবি প্রকাশিত হতে দেখলাম। ছবিতে দেখা গেল তার পাওয়া স্বর্ণপদকটি দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেছে। সত্যিকারের স্বর্ণপদক হলে এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। রাষ্ট্রীয় পদক নিয়ে যারা জল-জুয়া চুরির আশ্রয় নেয় তারা যে কত হীন মনের মানুষ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই ঘটনার কয়েক বছর পর বর্তমান ক্ষমতাসীনদের আমলে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাদানকারী সম্মানিত বিদেশী ব্যক্তিদের সম্মানিত করার জন্য বিশেষ পদক দেয়া হল। উদ্যোগটি খুবই প্রশংসনীয় ছিল; কিন্তু দেখা গেল এসব পদকেও স্বর্ণে ভেজাল দেয়া হয়েছিল। এর ফলে জাতি হিসেবে আমাদের মাথা হেঁট হয়ে গিয়েছিল। অমন নিচ পর্যায়ের কাজ যেসব কর্মকর্তা করল তাদের জন্ম পরিচয় নির্ণয় করা সত্যিই কঠিন। এরা আসলে ১৬ কোটি মানুষকে অপমানিত করেছে। অতি উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত কিছু সরকারি কর্মকর্তা কারচুপির আশ্রয় নিয়ে নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে হাজির করেছিল। পরে দেখা গেল এদের দাবি সঠিক নয়। কর্মজীবন কিছুটা প্রলম্বিত করার লোভে এরা এই কারচুপির আশ্রয় নিয়েছিল। এ ধরনের মানুষরা যখন রাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ে নিয়োজিত থাকে, তখন তাদের হাতে রাষ্ট্র কতটা নিরাপদ সে প্রশ্ন সঙ্গতভাবেই তোলা যায়।

বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানীরা বলে থাকেন, ১৯৭১-এর পর বাংলাদেশের Human Personality-তে পরিবর্তন এসেছে। খুবই হক কথা। বাংলাদেশীরা এখন পাকিস্তানি আমলের তুলনায় অনেক বেশি উদ্যমী ও উদ্যোগী। স্বাধীন বাংলাদেশে শত-সহস্র উদ্যোক্তার উদ্ভব ঘটেছে। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর সমাজে এই ধরনের পরিবর্তন ঘটাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। একটি যুদ্ধ গোটা জাতির মনস্তত্ত্বকে বদলে দিতে পারে। ইদানীংকালে যারা ভিয়েতনাম সফরে গেছে তাদের মুখেও ভিয়েতনামের সমাজ ও জনজীবনে বিশাল পরিবর্তনের গল্প শুনেছি। ভিয়েতনামবাসীরা তাদের জাতীয় মুক্তির জন্য ১৯৪৫ সাল থেকে সশস্ত্র লড়াই করেছে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত। প্রথমে তারা ফরাসি উপনিবেশবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। দ্বিতীয় ধাপে করেছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। এখন তারা মার্কিনিদের সঙ্গেও সুসম্পর্ক স্থাপন করেছে। অথচ এই মার্কিনিরা নাপাম বোমাসহ নানা মারণাস্ত্র দিয়ে ভিয়েতনামকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছিল। শত-সহস্র ভিয়েতনামিকে শত্রুর অস্ত্রের আঘাতে জীবন দিতে হয়েছে। পাশ্চাত্যের সাংবাদিক উহল ফ্রেড বার্চেতের লেখা থেকে জেনেছি, ভিয়েতনামের মুক্তিযুদ্ধে সে দেশের বারাঙ্গনারাও অংশগ্রহণ করেছিল। মার্কিন সৈন্যদের মনোরঞ্জনের জন্য আয়োজিত রাতের অনুষ্ঠানে মার্কিন সৈন্যরা ঘুমিয়ে পড়ার পর ওদের কোমরে গোঁজা পিস্তলগুলো ওরা খুলে নিত মুক্তিসেনাদের ব্যবহারের জন্য। দেশপ্রেম এমন এক চেতনা যা দেহপসারিণীকেও স্পর্শ করেছিল। আজকের ভিয়েতনামে চলছে দেশ গঠনের মহাযজ্ঞ।

খুব কম লোকই বিচ্যুত কিংবা বিপথগামী হয়েছে। সে দেশেও সমাজতান্ত্রিক কাঠামো বজায় রেখে বাজার অর্থনীতির সুফল ব্যবহারের চেষ্টা চলছে। এতে তারা সাফল্যও অর্জন করেছে। ভিয়েতনাম দ্রুত গতিতে উন্নয়ন সাধন করছে। ভিয়েতনামের পাশাপাশি বাংলাদেশের চেহারাটি তত উজ্জ্বল নয় বলে দুঃখ পাই। বাংলাদেশে Human Personality-র যে পরিবর্তন হয়েছে সে ব্যাপারে বেশকিছু ইতিবাচক দৃষ্টান্ত দেয়া যেতে পারে। বাংলাদেশ রাষ্ট্র সৃষ্টির প্রথম দিকে মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৭০ ডলার। আজ তা প্রায় ১৫০০ ডলার হয়ে গেছে। এটি অত্যন্ত আনন্দের বিষয়; কিন্তু ইতিবাচক পরিবর্তনের পাশাপাশি নেতিবাচক পরিবর্তনের দৃষ্টান্তও কোনো অংশে কম নয়। ছোটবেলায় বাবার কাছে শুনেছিলাম, লক্ষ্মীকে চাইলে সরস্বতীকে পাওয়া যায় না। আবার সরস্বতীকে চাইলে লক্ষ্মীকে পাওয়া যায় না। লক্ষ্মী ধনের দেবী, সরস্বতী বিদ্যার দেবী। এই উক্তিটি এখন খুব বেমানান এবং সেকেলে মনে হবে। অর্থনীতিবিদরা তো জোরালোভাবে যুক্তি হাজির করবেন এই দুয়ের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। যে জাতি জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নত, সে জাতি ধন-সম্পদেও উন্নত। হয়তো লক্ষ্মী ও সরস্বতীর দৃষ্টান্তটি এসেছে প্রাচীন ভারতীয় দর্শন থেকে। প্রাচীন ভারতীয় দর্শনে ধর্ম বা ধর্মবোধের মর্যাদা ছিল সবচেয়ে উঁচুতে।

আমার তুলনায় বয়োজ্যেষ্ঠ একজন জ্ঞানী মানুষ আমাকে এই তো সেদিন বললেন, বাংলাদেশের মানুষ টাকাকে খুব চিনেছে। হয়তো এটি আমাদের সমাজের আংশিক চিত্র। তার মতে হাজারও উপায়ে অর্থবিত্ত গড়ার হিকমত বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশী মানুষ আয়ত্ত করেছে। টাকার কুমির হওয়ার জন্য হেন কাজ নেই যা এদেশে হয় না।

সরকারি চাকরিতে বদলি, পদায়ন, পদোন্নতি এবং নিয়োগে বছরে শত শত কোটি টাকার লেনদেন হয়। একটি পিয়নের চাকরি কিংবা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার চাকরির জন্য চাকরি প্রার্থীর ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা ব্যয়ের কাহিনী শোনা যায়। ঢাকার মতো শহরে ফুটপাতে যারা হকারির ব্যবসা করে, তাদের লাইনম্যানের জন্য প্রতিদিন নিয়মিত চাঁদার টাকা গুনতে হয়। ঈদ বা অন্যান্য সময়ে সড়ক-মহাসড়কে চাঁদাবাজির মচ্ছব সৃষ্টি হয়। রাজনৈতিক দলগুলোতে নির্বাচনে মনোনয়ন এবং দলীয় পদ পেতে লক্ষ কোটি টাকা ব্যয় করতে হয়। স্কুলে ভর্তির জন্য বিশাল অংকের টাকা গুনতে হয়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যেসব দালাল চক্র গড়ে উঠেছে সেসব প্রতিষ্ঠান, হতে পারে তা পাসপোর্ট অফিস কিংবা হাসপাতাল, তারা প্রতিদিন কত লক্ষ কোটি টাকার লেনদেন করে তার শুমার করা কঠিন। বিচারপ্রার্থীদের হয়রানি করে প্রতিদিন বিভিন্ন মহল কত টাকা হাতিয়ে নেয় তার কোনো পরিসংখ্যান কারও জানা নেই। এছাড়া বন উজাড় করে, নদী দখল করে, বস্তি দখল করে, জমি দখল করে একশ্রেণীর মানুষ বিত্ত গড়ে তুলছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ক্ষমতাসীনরা মানুষের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে থাকে। গোটা সমাজে অনৈতিকতা ও অসৎ উপায়ের পথ ধরে বিত্ত গড়ার কৌশল অনেকেই রপ্ত করে ফেলেছে।

পাশ্চাত্যের মূল ধারার অর্থনীতিবিদরা এসব কর্মকাণ্ডকে Rent Seeking বলে আখ্যায়িত করেছেন। Rent হল এমন এক ধরনের আয়, যাকে ন্যায়সঙ্গত বলা মুশকিল। ইংরেজ অর্থনীতিবিদ ডেভিড রিকার্ডো Rent বা খাজনা তত্ত্বের ওপর বিশ্লেষণ করেছেন। সামাজিক আয়ে মুনাফার তুলনায় খাজনার হিস্যা বেড়ে গেলে অর্থনীতি অধোগতির পথে যায়। কারণ Rent আয়কারীরা হয় অলস ও বিলাসী। যে কোনো ধরনের একচেটিয়া মালিকানা বা কর্তৃত্বকে ব্যবহার করে Rent আদায় করা সম্ভব হয়। অন্যদিকে মুনাফা অর্জন করার জন্য উদ্যোগ নিতে হয়, ঝক্কিঝামেলা পোহাতে হয় এবং ঝুঁকিতে পড়তে হয়। এ কারণে Rent বা খাজনা বিত্তবান হওয়ার সহজ উপায়। অবশ্য এর জন্য ক্ষমতা থাকা প্রয়োজন। বাংলাদেশে বিশাল ক্ষমতাধর ব্যক্তি থেকে অতি ক্ষুদ্র ক্ষমতার মানুষের সৃষ্টি হয়েছে। এখানে ফ্রান্সের লুইদের মতো একক ক্ষমতার কোনো মানুষ নেই। সেজন্য বলা যায় ক্ষমতা এই সমাজে বিকেন্দ্রীয়ায়িত। সে কারণে Rent Seekingও রাজধানী ঢাকা থেকে মফস্বলের গণ্ডগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত। মজার ব্যাপার হচ্ছে, Rent Seeking-এর শত-সহস্র উপায় থাকলেও বাংলাদেশে উদ্যোগ ও ঝুঁকি নিয়ে মুনাফা করার প্রবণতাও ক্রমে ক্রমে শক্তিশালী হচ্ছে। আর যাই হোক মুনাফা করে বিত্ত গড়া খাজনার আয় দিয়ে বিত্ত গড়ার চেয়ে শ্রেয়। আগেই বলা হয়েছে খাজনা ও মুনাফার মধ্যে দ্বন্দ্ব বিদ্যমান। সর্বগ্রাসী খাজনা আহরণের পরিবেশে বাংলাদেশে দৃশ্যমানভাবে মুনাফা আহরণের যে প্রবণতা আমরা দেখছি, সেটাই হল বাংলাদেশের উন্নয়নের প্যারাডক্স।

বাংলাদেশে এখন যেভাবে টাকা চেনার কালচার আমরা লক্ষ করছি, সেটাকেই কার্ল মার্কস Primitive Accumulation নামে আখ্যায়িত করেছেন। একেক দেশে একেকভাবে এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ইংল্যান্ডে Primitive Accumulation-এর পর্বটি ঘটেছিল শিল্প বিপ্লবের পূর্বক্ষণে, কৃষকদের জমি থেকে উচ্ছেদ করে। বাংলাদেশেও এক ধরনের উচ্ছেদ কর্ম চলছে যা হুবহু ইংল্যান্ডের মতো নয়। Rent Seeking-এর Primitive Accumulation-এর ধারা এদেশে যতদিন প্রবল থাকবে ততদিন এদেশে গণতন্ত্র সত্যিকার অর্থে দিনের আলোর মুখ দেখতে পারবে না। এই পর্বের ঝড় থেমে গেলে গণতন্ত্র ও সুশাসন কিছুটা হলেও আশা করা যায়। চীনের নেতা দেং শিয়াও পিং একদা বলেছিলেন, ধনী হওয়া খারাপ নয়, তবে Rent Seeking কিংবা Primitive Accumulation-এর সময় যারা ধনী হয় তারা সমাজকে কিছু দেয় না, বরং সমাজ থেকে লুণ্ঠন করে। আমরা অপেক্ষায় থাকব লুণ্ঠন ও দুর্বৃত্তায়নের অবসানের দিনটির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে। সময়ের ঝড় থেমে গেলে নিশ্চয়ই নতুন পত্র-পল্লবের জন্ম হবে।

ড. মাহবুব উল্লাহ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ

http://www.jugantor.com/sub-editorial/2017/03/21/110827/