২০ মার্চ ২০১৭, সোমবার, ৮:০৮

বিশুদ্ধ নামে দূষিত পানি সরবরাহ

নানাবিধ জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ * উদাসীন মান নিয়ন্ত্রণে দায়িত্বপ্রাপ্তরা

বিশুদ্ধ নামে বাজারজাত বা সরবরাহ করা পানির বেশির ভাগই দূষিত। কোনো পানি কেমিক্যাল মিশ্রিত আবার কোনো পানি বিভিন্ন ক্ষতিকর জীবাণুযুক্ত। সরকারি বা বেসরকারি উৎস থেকে পাওয়া সব পানির একই অবস্থা। এসব পানি পান করে মানুষ হেপাটাইটিস, টাইফয়েড, ডায়রিয়া, কলেরা, আমাশয়, জণ্ডিসসহ বহুবিধ জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। কিন্তু পানির মান নিয়ন্ত্রণে দায়িত্বপ্রাপ্তদের কোনো খেয়াল নেই।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞ আবু নাছের খান যুগান্তরকে বলেন, দূষিত ও নিন্মমানের পানি পানের কারণে মানুষ মরণ ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। মারা যাচ্ছে। বিষয়গুলো দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর কাছে পরিষ্কার হলেও কর্তৃপক্ষ রহস্যজনক কারণে নীরব। অনেক ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো মানহীন দূষিত পানি সরবরাহ ও বাজারজাতকরণে ভূমিকা রাখছে। এটা নিয়ন্ত্রণে রাজনৈতিক পদক্ষেপ জরুরি।
ব্যর্থ ঢাকা ওয়াসা : রাজধানীবাসীর জন্য বিশুদ্ধ পানির চাহিদা পূরণের দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার। এ জন্য এই সংস্থাটিকে পর্যাপ্ত আইনি ক্ষমতা ও অর্থ বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। কিন্তু এর পরও সংস্থাটি নগরবাসীকে কাক্সিক্ষত পানীয় সেবা দিতে চরমভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। যদিও সংস্থার কর্তাব্যক্তিরা এটা মানতে নারাজ। ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী তাকসিম এ খান বলেন, ঢাকা ওয়াসা বিশুদ্ধ পানি সরবরাহে এখন যথেষ্ট সফল। ২০২১ সালের মধ্যে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের ক্ষেত্রে টেকসই উন্নতি করবে ঢাকা ওয়াসা। সে লক্ষ্যে কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ঢাকা ওয়াসা আওতাভুক্ত এলাকার দৈনিক পানির চাহিদা ২২০ থেকে ২৩০ কোটি লিটার। যদিও ঢাকা ওয়াসার উৎপাদন এখন চাহিদার তুলনায় বেশি। ঢাকা ওয়াসা নগরবাসীর চাহিদার আলোকে পানি সরবরাহ করতে সক্ষম হচ্ছে। তবে নগরবাসীর দীর্ঘদিনের অভিযোগ- ওয়াসার পানিতে মাত্রাতিরিক্ত দুর্গন্ধ ও ময়লা থাকে। দীর্ঘ সময় ধরে ফোটানো হলেও কিছু এলাকায় সরবরাহ করা পানি থেকে দুর্গন্ধ যাচ্ছে না। এর কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরবরাহ করা পানির ১৫ শতাংশ আসে সায়েদাবাদ পানি শোধনাগার থেকে। শীতলক্ষ্যা থেকে পানি এনে শোধন করে তা নগরবাসীর জন্য সরবরাহ করা হয়। কিন্তু ওই নদীর পানি এতটাই দূষিত যে, তা শোধন করেও পানযোগ্য করা যাচ্ছে না।
জেরিক্যান কোম্পানিগুলোর অসাধুতা : এদিকে রাজধানী ঢাকাসহ আশপাশের এলাকায় পানি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর পানি সরাসরি পান করা চরম ঝুঁকিপূর্ণ। কোম্পানিগুলোর সরবরাহ করা পানি ফুটিয়ে, ফিল্টার করেও গন্ধমুক্ত ও পানের উপযোগী করা যায় না। আর বিশুদ্ধ খাবার পানির এই সংকটের সুযোগ নিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা রমরমা পানি বাণিজ্য করছেন। জানা যায়, পানি সরবরাহকারী ঢাকার অনেক প্রতিষ্ঠানেরই বিএসটিআইয়ের লাইসেন্স নেই। আবার অনেক প্রতিষ্ঠান লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও সরবরাহ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। যাদের লাইসেন্স রয়েছে তাদের অনেকেই পানির গুণগত মান ঠিক রাখছেন না।
পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে : পানি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. এম আশরাফ আলী জানান, ভূ-গর্ভস্থ পানির যে অংশটুকু খালি হয়, পরে স্বাভাবিক নিয়মে তা পূরণ হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু ঢাকাসহ আরও কিছু এলাকায় তা হচ্ছে না। এসব এলাকায় ভূ-গর্ভস্থ পানি শুধু কমছে, বাড়ছে না। পূর্ব থেকে অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিতভাবে অতিমাত্রায় নলকূপ বসিয়ে ইচ্ছেমতো পানি তুলে ফেলায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এখন পানি নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। সরকারিভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করে ভূ-উপরিস্থ উৎস থেকে পানির চাহিদা মিটিয়ে ভূ-গর্ভস্থ উৎসের পানির স্তর স্বাভাবিক করতে হবে।
তথাকথিত বিশুদ্ধ পানি : বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইন্সটিটিউশন (বিএসটিআই) সূত্রে জানা যায়, পানিতে ক্ষারের গ্রহণযোগ্য মাত্রা ৬ দশমিক ৪ থেকে ৭ দশমিক ৪। কিন্তু মোবাইল কোর্টের পরীক্ষায় ঢাকায় সরবরাহ করা বেশির ভাগ জারের পানিতে ক্ষারের পরিমাণ বেশি পাওয়া গেছে। তা ছাড়া অনেক প্রতিষ্ঠান পরিশোধন ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই প্লাস্টিকের জারে পানি সরবরাহ করছে। শুধু জারের মুখ কর্কবন্দি করে নাম দেয়া হয়েছে ‘ফিল্টার পানি’। বিশুদ্ধ দাবি করে সেই পানি পৌঁছে দেয়া হচ্ছে বাসাবাড়ি, দোকানপাট ও অফিস-আদালতে। তথাকথিত বিশুদ্ধ পানিভর্তি জারটির গায়ে নেই কোনো লেবেল। এমনকি উৎপাদন ও মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখও থাকে না।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, কতগুলো নিয়ম মেনে জারে পানিভর্তি করে বিক্রি করতে হয়। সে জন্য প্রথমত বিএসটিআইয়ের অনুমোদন থাকতে হবে। একজন রসায়নবিদ ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী থাকতে হবে। যেসব কর্মী জারে পানি ভর্তি করবেন, তাদের সুস্বাস্থ্যের সনদ থাকতে হবে। লেবেলে উৎপাদন ও মেয়াদোত্তীর্ণ তারিখ উল্লেখ করতে হবে। কিন্তু অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান এসব নিয়ম মানছে না।

http://www.jugantor.com/last-page/2017/03/20/110490/