২০ মার্চ ২০১৭, সোমবার, ৭:৫৯

বিশুদ্ধ পানির সঙ্কটে দেশ

নেমে যাচ্ছে ভূগর্ভের পানির স্তর

রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার ভূগর্ভের পানির স্তর ক্রমেই নেমে যাচ্ছে। ফলে দিনকে দিন বিশুদ্ধ খাবার পানির সঙ্কট বেড়ে চলেছে। নদীর দূষিত পানি শোধন করে ঢাকা ওয়াসা রাজধানীতে পাইপের মাধ্যমে বাসাবাড়িতে পানি সরবরাহ করলেও সে পানিতে দুর্গন্ধ ও চর্মজাতীয় রোগের সৃষ্টি হচ্ছে। এতে স্বাস্থ্যঝুঁকিও বেড়েছে অনেক গুন। এ অবস্থায় বিশুদ্ধ পানি পেতে বিকল্প চিন্তা করতে হচ্ছে। রাজধানীতে নিজেদের উদ্যোগে নলকূপ স্থাপনের সুযোগ না থাকায় বিশুদ্ধ পানি পেতে বাজার থেকে উন্নতমানের পরিশোধন যন্ত্র কিনে নিচ্ছেন নগরবাসী।
নদীমাতৃক বাংলাদেশে এক সময় নদী-নালা, পুকুর বা জলাধারের পানি কৃষি আবাদ ও সুপেয় পানি হিসেবে ব্যবহৃত হলেও এখন সে পরিস্থিতি পাল্টেছে। দেশের উজানে পদ্মা ও তিস্তাসহ অভিন্ন ৫৪টি নদীতে ভারত বাঁধ নির্মাণসহ নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির কারণে নদী-খাল-বিল-পুকুর শুকিয়ে যাচ্ছে। এতে বিকল্প হিসেবে ভূগর্ভের পানির ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। এ কারণে গত চার দশকে দেশে ভূগর্ভের পানির ব্যবহার বেড়েছে ব্যাপক। খাবার পানি, রান্না, গোসল, সেচ, এমনকি দৈনন্দিন কাজেও ভূগর্ভের পানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে মানুষ। সত্তরের দশকের শুরুতে কৃষিকাজের জন্য দেশে প্রথম ভূগর্ভের পানির ব্যবহার শুরু হয়। আশির দশকে তা ব্যাপকতা পায়। সেই যে শুরু এরপর আর বিকল্প পাওয়া যায়নি। এখন সুপেয় ও চাষাবাদের জন্য চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশ পানিই মেটাতে হচ্ছে ভূগর্ভের থেকে। অপরিকল্পিতভাবে গভীর ও অগভীর নলকূপ দ্বারা পানি উত্তোলনের ফলে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশেই ভূগর্ভের পানির স্তর আশঙ্কাজনকহারে নিচে নেমে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পানিসম্পদ প্রকৌশল বিভাগের এক গবেষণায় বলা হয়, প্রতি বছর ভূগর্ভের পানির স্তর দুই থেকে তিন মিটার করে নিচে নামছে। ভূগর্ভের পানির ওপর মানুষের নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনা না হলে পাঁচ বছর পর আরো আশঙ্কাজনকহারে পানির স্তর নিচে নেমে যাবে। আর্সেনিকের পরিমাণও বাড়বে। তখন নানা ধরনের দুর্ঘটনারও আশঙ্কা করা হয়েছে ওই গবেষণায়।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) এক গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে বর্তমানে সাগরের চেয়ে ঢাকার পানির স্তর ১৭০ ফুট এবং রাজশাহীর পানির স্তর ১৮ থেকে ২৯ ফুট নিচে নেমে গেছে। ফলে সাগরের নোনা পানি দক্ষিণাঞ্চল পার হয়ে এখন ঢাকা মহানগরীসহ দেশের মধ্যাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলের দিকে আসছে। অপরিকল্পিতভাবে পানি উত্তোলনের কারণে ঢাকার পানিও লবণাক্ত হবে। ভূগর্ভ স্তরের পানির ওপর বিভিন্ন জরিপে দেখানো হয়েছে প্রতি বছর যে পরিমাণ পানি ভূগর্ভ থেকে উত্তোলন করা হচ্ছে, পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাতের অভাবে সে পরিমাণ পানি রিচার্জ হচ্ছে না।
ভূগর্ভের পানিও এখন ক্রমেই অনিরাপদ হয়ে উঠছে। ঢাকাসহ দেশের বড় কয়েকটি শহরের আশপাশের নদীতে শিল্পকলকারখানার বর্জ্য পড়ে অতিমাত্রায় পানি দূষিত হচ্ছে। এ পানি যেমন পান করা ও ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে উঠেছে, তেমনি দূষিত এ পানি মাটির নিচে ঢুকে ভূগর্ভের পানির স্তরকেও দূষিত করে তুলছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ও অ্যাটমিক এনার্জি রিসার্চ এস্টাবলিশমেন্টের গবেষণা অনুযায়ী ঢাকার আশপাশে শিল্পাঞ্চলে পানিতে পাওয়া গেছে দ্রবীভূত চুন, ক্রমিয়াম সালফেট, অ্যালকালি, হাইড্রোজেন সালফাইড, সালফিউরিক এসিড, ব্লিøচ, রঙ, ফরমিক এসিড, নিঃসরিত ভারী ধাতু, কীটনাশকের মতো নানা ধরনের বিষাক্ত পদার্থের অস্তিত্ব। সাভারের শিমুলিয়া, আশুলিয়া, পাঠালিয়া, বিরলিয়া, বনগ্রাম, কউন্দিয়া, আমিনবাজার, ভাকুর্তা, তেঁতুলজোড়া এলাকার নদী, টিউবওয়েলের পানি, ভূ-উপরিস্থ পানির নমুনা নিয়ে গবেষণাটি করা হয়েছে। গবেষণায় বলা হয়েছে, জনস্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর এসব ভারী ধাতু ও রাসায়নিক চলে যাচ্ছে মানব দেহে। ফলে মানুষের মধ্যে দেখা যাচ্ছে নানা ধরনের অসংক্রমিত রোগ (নন কমিউনিকেবল ডিজিজ-এনসিডি)।
অপর এক গবেষণায় বুড়িগঙ্গার পানিতে ক্ষতিকর ভারী ধাতুর উপস্থিতি পাওয়া গেছে। সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নের আরএমটিআই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব অ্যাপ্লায়েড সায়েন্সেসের পরিবেশ গবেষক বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ড. গোলাম কিবরিয়ার নেতৃত্বে পরিচালিত এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে।
এনজিও ফোরাম ফর পাবলিক হেলথ পরিচালিত ওয়াটার কোয়ালিটি টেস্টিং ল্যাবরেটরির (ডব্লিউকিউটিএল) এক গবেষণায় বাংলাদেশের অধিকাংশ নলকূপের পানিতে ব্যাকটেরিয়া ছাড়াও ম্যাঙ্গানিজ নামে একটি ভারী ধাতুর উপস্থিতিও পাওয়া গেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ভারী এ ধাতুটি স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
এ দিকে পানির স্তর নেমে যাওয়ায় ঢাকা ওয়াসা তাদের পানি উত্তোলনে বিকল্প উদ্যোগ নিয়েছে। আগে ৭০ ভাগ পানি ভূগর্ভের উৎস থেকে উত্তোলন করলেও এর পরিমাণ ধীরে ধীরে কমিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী তাকসীম এ খান। এ জন্য বিভিন্ন নদী থেকে পানি সংগ্রহ করে শোধনের পর তা বাসাবাড়িতে সরবরাহ করা হচ্ছে। কিন্তু নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ না থাকায় ক্রমেই পানি দূষিত হয়ে উঠছে। এ দূষিত পানি ব্লিচিং পাউডারসহ বিভিন্ন ওষুধের মাধ্যমে শোধন করায় দুর্গন্ধ থেকেই যাচ্ছে। তা ছাড়া এ পানি দিয়ে গোসলের ফলে চর্মজাতীয় নানা রোগেরও সৃষ্টি হচ্ছে। দেখা দিচ্ছে ডায়রিয়া, টাইফয়েডসহ নানা রকম পেটের পীড়া।
পানি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. এম আশরাফ আলী নয়া দিগন্তকে বলেন, স্বাভাবিক নিয়মে ভূগর্ভের পানির যে স্তরটুকু খালি হয়, তা পরবর্তী সময়ে প্রাকৃতিকভাবেই পূরণ হয়ে যাওয়ার কথা; কিন্তু ঢাকাসহ কিছু এলাকায় তা হচ্ছে না। ভূগর্ভের পানি শুধু কমছেই, বাড়ছে না। আগে থেকেই অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিতভাবে অতিমাত্রায় নলকূপ বসিয়ে ইচ্ছামতো পানি তুলে ফেলায় অবস্থা এমন হয়েছে যে, এখন আর পানি নাগালে পাওয়া যাচ্ছে না। সরকার বিভিন্নভাবে চেষ্টা করলেও ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট দিয়ে পানি সঠিক মাত্রায় নিরাপদ করা যাচ্ছে না মারাত্মকভাবে নদী দূষণের কারণে। এ ছাড়াও বিভিন্ন দূষিত পদার্থের প্রকট উপস্থিতির কারণে গভীর নলকূপের পানিও আর নিরাপদ নেই। এতে ঢুকে পড়েছে পানিবাহিত রোগের উপাদান ব্যাকটেরিয়া, সেটাও ভয়াবহ মাত্রায়।
চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, এভাবে পানি দূষিত হয়ে যাওয়ায় ২০ বছর আগে যে হারে হৃদরোগ, কিডনি জটিলতা, ক্যান্সার, ডায়াবেটিসের প্রকোপ ছিল এখন তার চেয়ে অনেক বেশি। খাবারের সাথে নানা ধরনের ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ দেহে চলে যাওয়ার কারণেই এ ধরনের রোগের প্রকোপ বেড়েছে। গবেষণায় প্রমাণ হয়েছে, পানির এসব পদার্থ শুধু যে পানের মাধ্যমে দেহে চলে যাচ্ছে তা নয় এগুলো ফুড চেইনের মধ্যেও ঢুকে যাচ্ছে।
পানি নিয়ে গবেষণা করেন বিজ্ঞানী ড. আবদুল করিম। তিনি জানিয়েছেন, পানিতে যে ধরনের ভারী ধাতু ও রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে তা কেবল ফোটানোর মাধ্যমে দূর করা সম্ভব নয়। পানি থেকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় ধাতু ও রাসায়নিক দূর করতে পারলে পানি নিরাপদ হতে পারে। পানি ফোটালে পানির মধ্যে বিভিন্ন ধরনের জীবাণু যেমন ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে জীবাণু সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যেতে পারে। বিশেষ ধরনের ছাকনি ব্যবহার করা হলে জীবাণু ও ভারী ধাতুসহ নানা ধরনের রাসায়নিক পদার্থ আটকাতে পারবে।
ড. আবদুল করিম বলেন, বিশেষ ধরনের ছাকনি ব্যবহার করতে না পারলেও বালুর কয়েকটি স্তরের ভেতর দিয়ে পানি প্রবাহিত করা হলেও পানি থেকে ভারী ধাতু, ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার মতো ক্ষতিকর পদার্থ ও জীবাণু দূর করা সম্ভব। তা ছাড়া উন্নতমানের পরিশোধন যন্ত্রও পাওয়া যাচ্ছে বাজারে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/205082