১৯ মার্চ ২০১৭, রবিবার, ৮:৩২

নর-নারীর শ্রমবিভাজন

আত্মপক্ষ

|| এবনে গোলাম সামাদ ||

মানুষকে বাদ দিয়ে মানুষের সমাজ জীবনের কথা বিশ্লেষণ করা যায় না। মানুষ স্তন্যপায়ী প্রাণী। মানবশিশু মাতৃস্তন্য পান করে বাঁচে। মাতার সাথে সন্তানের আছে খাদ্য স¤পর্ক, পিতার সাথে যা নেই। পিতা তাই অনেক সহজেই বাইরের কাজ করতে পারেন। মাতা-পিতার কাজের এলাকায়, আর এক কথায়Ñ শ্রমবিভাজনে হতে পেরেছে পার্থক্য। বামপন্থী চিন্তকেরা বলেন, নারীর গৃহকর্মে আটকা পড়ার কারণ হলো, পুরুষের ষড়যন্ত্র। কেননা, পুরুষ চেয়েছে নারীর শ্রমের ওপর নির্ভর করে বাঁচতে।’ কিন্তু এটা সত্য নয়। কারণ অনেক আদিম সমাজে দেখা যায়, স্বামী গৃহকর্মে স্ত্রীর সহযোগিতা করতে। নারীরা পুরুষের চেয়ে পেশিশক্তিতে দুর্বল। এ কারণেও সৃষ্টি হতে পেরেছে শ্রমবিভাজন। নারী করেছেন সন্তান প্রতিপালন; করেছেন রন্ধন কর্ম। পুরুষ করেছেন বনে বনে পশু শিকার। নৌকা করে গিয়েছেন নদী ও সমুদ্রে মাছ ধরতে। করেছেন মাঠে লাঙল দিয়ে চাষাবাদ। অন্য দিকে, নারীরা করেছেন বসতবাটির চার দিকে শাকসবজির আবাদ। নারী-পুরুষের মধ্যে এই যে শ্রম বিভাজন, এর মূলে আছে নারী-পুরুষের পেশিশক্তির পার্থক্য; অন্য কোনো কারণ নয়। নারী-পুরুষের মধ্যে পার্থক্য কেবল লিঙ্গগত নয়, আরো অনেক বিষয়েও পার্থক্য থাকতে দেখা যায়। সেটা সাধারণত এড়িয়ে যায় আমাদের দৃষ্টি। পুরুষের দেহ থেকে অনেক সহজে তাপ ছড়িয়ে যেতে পারে। এর জন্য পুরুষকে নারীর চেয়ে অধিক খাদ্য খেয়ে বাঁচতে হয়। নারী পুরুষের তুলনায় অনেক কম খেয়ে তুলনামূলক বেশি কাজ করতে পারে। অন্য দিকে, মেয়েদের বার্ধক্য আসে পুরুষের তুলনায় অনেক তাড়াতাড়ি।

মেয়েরা পুরুষের তুলনায় গড়পড়তায় বেশি দিন বাঁচেন। কিন্তু বাঁচেন বৃদ্ধা হয়ে। তাই পুরুষ ও মহিলাকে নানা দিক থেকেই এক ছকে ফেলে বিচার করা যায় না। যেমন এখন করার চেষ্টা চলেছে। ‘নারীর ক্ষমতায়ন’ একটা বাজে কথা। নারী চিরকালই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকেছে। কোনো সমাজই পুরুষকে নারীর সাথে যথেচ্ছ ব্যবহার করতে অনুমোদন দেয় না। দিলে পরে সমাজজীবন সম্ভব হতো না। কেননা, নারী-পুরুষের সহযোগিতায় গড়ে ওঠে পরিবার আর পরিবার হলো সমাজজীবনের প্রাথমিক ভিত্তি। আর কোনো প্রাণীর মধ্যে ঠিক এ ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে পারেনি; যদিও অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, সন্তান প্রতিপালনে জনক-জননীর থাকছে সহজাত প্রচেষ্টা। কিন্তু মানুষের মধ্যে যে রকম অপত্যস্নেহ পরিলক্ষিত হয়, অন্য প্রাণীর মধ্যে তা দেখা যায় না। প্রাণিজগতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অপত্যস্নেহ থাকতে দেখা যায় জননীর মধ্যে; জনকের মধ্যে নয়। সন্তান প্রতিপালনে মাতাই পালন করেন সমগ্র ভূমিকা। এর ব্যতিক্রম অবশ্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয়। যেমন মারমোজেট নামক মর্কটের মধ্যে দেখা যায়, তাদের স্ত্রী প্রাণীরা কেবল গর্ভধারণ ছাড়া আর বিশেষ কিছুই করে না। কিন্তু তাদের পুরুষ প্রাণীরা পালন করে সন্তান প্রতিপালনের আর সব ভূমিকা। তবে এ ধরনের দৃষ্টান্ত প্রাণিজগতে খুবই বিরল। মানুষ এবং অন্য স্তন্যপায়ী প্রাণীর মধ্যে লিঙ্গ পরিবর্তনের দৃষ্টান্ত মেলে না। কিন্তু বিহঙ্গদের মধ্যে পাওয়া যায়। যেমন কোনো মুরগির দেহের গর্ভাশয় কোনো কারণে নষ্ট হয়ে গেলে, তার দেহের সুপ্ত শুক্রাশয় সক্রিয় হয়ে ওঠে। মুরগিটি তখন মোরগে পরিণত হয়। মুরগি মোরগে পরিণত হতে পারে। কিন্তু মোরগ কখনো মুরগিতে পরিণত হতে পারে না। অবয়বগত কারণেই হতে পারে না, যদিও বিহঙ্গদের রক্ত মানুষের মতোই থাকে গরম। পরিবেশের প্রভাবে তাতে তাপমাত্রার কোনো পরিবর্তন আসে না। এ ছাড়া বিহঙ্গদের হৃৎপিণ্ড মানুষেরই মতো চার প্রকোষ্ঠবিশিষ্ট এবং তারা দ্বিপদি। কিন্তু তাদের হাত নেই। মানুষ হস্ত দিয়ে কাজ করতে পারে। গড়তে পারে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। করতে পারে চাষাবাদ। তাই মানুষই একমাত্র প্রাণী, যার ক্ষেত্রে গড়ে উঠেছে একটা অর্থনৈতিক জীবন। তার ক্ষেত্রে আরো একটি বড় ঘটনা ঘটেছে। তা হলোÑ সেই হলো একমাত্র প্রাণী, যে আগুনের ব্যবহার করতে পারে। আগুন তার জীবনে পালন করেছে এবং করছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এসব কিছুকে মিলিয়ে বিচার করতে হয় মানুষকে। কিন্তু সেটা এখন যেন আর করার চেষ্টা হচ্ছে না। এখানে থাকছে তার সমাজচিন্তার একটা বড় দুর্বলতা।


৮ মার্চ ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ পালিত হলো। জাতিসঙ্ঘ ১৯৮৪ সাল থেকে ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে। ১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরে এক সুঁচ তৈরির কারখানায় নারী শ্রমিকেরা (শ্বেতাঙ্গ) করেছিলেন ধর্মঘট। তাদের দাবি ছিল, পুরুষের সমান মজুরি; কর্মপরিবেশের উন্নয়ন এবং ১২ ঘণ্টার কম প্রতিদিন শ্রমের সময়। তাদের ধর্মঘট একপর্যায়ে হয়ে ওঠে সহিংস। ফলে ধর্মঘটী নারীশ্রমিকদের যেতে হয় কারাগারে। এ হলো আন্তর্জাতিক নারী দিবসের ঐতিহাসিক পটভূমি। কিন্তু কিছু নারী শ্রমিকের স্মৃতিবহ ৮ মার্চকে কেন নারী দিবস হিসেবে পালন করতে হবে, সেটা পরিষ্কার নয়। কেননা সে সময় খুব বেশি নারী কলকারখানায় শ্রমজীবী হিসেবে কাজ করতেন না। অর্থাৎ তারা ছিলেন না মার্কিন নারীসমাজের প্রতিনিধি। ওই সময় বেশির ভাগ শ্বেতকায় নারী করতেন গৃহকর্ম। তারা তাদের জীবিকার জন্য হতেন না বাইরের কর্মে নিয়োজিত। অন্য দিকে, সে সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ছিল নিগ্রো ক্রীতদাস প্রথা। নিগ্রো ক্রীতদাস ও ক্রীতদাসীদের এ সময় কাজ করানো হতো চাবুক মেরে। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ অঞ্চলের তুলার ক্ষেতে বর্তমান আমেরিকার বিপুল বৈষম্যের মূলে আছে নিগ্রোদের অমানুষিক শ্রম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে নিগ্রো ক্রীতদাসপ্রথা তুলে দিতে গিয়ে হয়েছিল ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ (১৮৬১-১৮৬৫)। এই যুদ্ধে দাসপ্রথার সমর্থকেরা হেরে যায়। ফলে দাসপ্রথা তুয়ে দেয়া সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু এখনো নিগ্রোরা ভোগ করছে নানা সামাজিক অসুবিধা। এখনো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিরাজ করছে সাদা কালোর বিরোধ, যদিওবা ঠিক আগের মতো নয়।
সাধারণত মনে করা হয় শ্রমজীবী শ্রেণী হলো বিপ্লবী শ্রেণী, আর মালিক শ্রেণী তা নয়। কিন্তু অর্থনীতির ইতিহাস অনুসরণ করলে তা মনে হয় না। একসময় (১৮১২-১৮১৮) উত্তর ইংল্যান্ডে হয়ে ছিল লুডাইট (Luddite) আন্দোলন। লুডাইটরা চাইতেন না শ্রমশিল্পে নতুন যন্ত্রপাতির প্রয়োগ। কেননা নতুন যন্ত্রের ব্যবহারের ফলে প্রয়োজন হয় অনেক স্বল্পসংখ্যক মজুরের। ফলে অনেক মজুর হারান তাদের কর্মসংস্থান। লুডাইটরা বিদ্রোহ করে ভাঙতে থাকে নতুন যন্ত্রপাতি। তাদের দমন করার জন্য প্রয়োজন হয় বল প্রয়োগের। তাদের দমন করা না গেলে সম্ভব হতো না কলকারখানার অর্থনীতিতে অগ্রসর হওয়া। নতুন কলকব্জার প্রয়োগে আপাতত কিছু শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়লেও সামগ্রিকভাবে বেকার সমস্যা দেখা দেয় না। কেননা, নতুন কলকব্জা তৈরির জন্য প্রয়োজন হয় শ্রমিকের; ঘটে কর্মসংস্থান। অর্থাৎ শ্রমজীবী জনগণ নয়, ব্যবসাবাণিজ্যের নেতৃত্ব দিয়েছে মালিক শ্রেণী। আর তাদের ঝুঁকি নেয়ার ফলেই অগ্রগতি ঘটেছে অর্থনৈতিক জীবনে। তারাই ঘটিয়েছেন দেশে দেশে শিল্পবিপ্লব। আমরা আমাদের দেশেও এটা হতে দেখছি। একসময় উঠেছিল রাষ্ট্র কর্তৃক অর্থনৈতিক বিপ্লব ঘটানোর প্রচেষ্টা। কিন্তু এখন সে প্রচেষ্টায় ভাটা পড়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়েছে। ভেঙে পড়েছে রাষ্ট্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের চিন্তাচেতনা। এখন রাশিয়া এবং সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের আরো ১৪টি রিপাবলিকে অনুসরণ করা হচ্ছে ব্যক্তিমালিকানায় পরিচালিত অর্থনীতি। চীনে কমিউনিস্ট পার্টি এখনো ক্ষমতায় আছে। কিন্তু চীনা কমিউনিস্টরাও আর রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনায় পরিচালিত অর্থনীতিকে অনুসরণ করছেন না। তারাও অনুসরণ করছেন ব্যক্তি মালিকানার অর্থনীতির পথ।


পত্রিকার খবরে প্রকাশ আমাদের দেশে এখন প্রায় ৪০ লাখ লোক নিয়োজিত আছেন তৈরী পোশাক শিল্পে। এই শিল্পে নিয়োজিত শ্রমজীবীরা বেশির ভাগই হলেন নারী। বলা হচ্ছে, এই নারী শ্রমিকরা বিশেষভাবেই হচ্ছেন শোষিত। কিন্তু যদি তৈরী পোশাক শিল্পে শ্রমজীবীরা নিয়ন্ত্রণবিহীনভাবে তাদের মজুরি বৃদ্ধি করতে চান, তবে তৈরী পোশাক শিল্প উঠে যেতেই পারে। কেননা, তৈরী পোশাকের চাহিদা খুবই নমনীয়। মজুরি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তৈরী পোশাকের মূল্যবৃদ্ধি ঘটবে। ফলে ক্রেতার পক্ষে তা থাকবে না ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে। অন্যান্য দেশে শিল্প বিপ্লবের প্রথম পর্যায়ে শ্রমজীবীদের কিছু কষ্ট পোহাতে হয়েছে। মনে হয়, আমাদের দেশেও তাদের কিছু কষ্টে পড়তেই হবে। না হলে আমাদের দেশে শিল্পবিপ্লব ঘটতে পারবে না।


আমাদের দেশ, এখনো কৃষিজীবী মানুষের দেশ। এখনো আমাদের অর্থনীতি হয়ে আছে মওসুমি বায়ুনির্ভর। খরা হলে আমাদের ফসল হয় না। খরার কারণে যদি শতকরা ১০ ভাগের কাছাকাছি খাদ্য ফসল মার খায়, তবে দেশে সৃষ্টি হয় দুর্ভিক্ষের অবস্থা। গ্রামীণ দারিদ্র্য ঘোচানোর জন্য একসময় বলা হতো সমৃদ্ধ কুটির শিল্প গড়ে তোলার কথা। বলা হতো এমন যন্ত্রপাতি উদ্ভাবনের কথা, যা কম টাকায় কেনা সম্ভব। এসব যন্ত্রপাতি কিনে গ্রামের মানুষ পারবে নানা প্রয়োজনীয় জিনিস তৈরি করতে। ফলে বাড়বে গ্রামের মানুষের আয়। গ্রাম ছেড়ে মানুষকে শহরে আসতে হবে না কাজের খোঁজে। কিন্তু এখন গ্রাম থেকে কেবল পুরুষ শ্রমিক নয়, অনেক নারী শ্রমিককেও আসতে দেখা যাচ্ছে শহরে কাজের খোঁজে। তাদের পড়তে হচ্ছে নানা বিপদে। হতে হচ্ছে ধর্ষণের শিকার। তাদের রক্ষা করতে হলে বাড়াতে হবে এদের চিরচেনা গ্রামের পরিবেশেই কর্মসংস্থান।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/204677