১৬ মার্চ ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৯:৫৫

বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগ সংকুচিত অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব

ব্যাংক ও খোলা বাজারে ডলারের দামের পার্থক্যই রেমিট্যান্স প্রবাহের নেতিবাচক ধারার অন্যতম কারণ। বিশ্লেষকরা মনে করেন, আইনের সংস্কার করে ডলার ক্রয় মুক্ত করা গেলেই রেমিট্যান্স প্রবাহ কিছুটা বাড়বে। বিদেশী বিনিয়োগের সুযোগ করে দিতে, ক্যাপিট্যাল একাউন্ট খুলে দেয়ারও পরামর্শ দেন তারা।
জানা গেছে, গত সাত মাস ধরে অব্যাহতভাবে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমছে। এতে করে দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এ অবস্থা কাটিয়ে উঠতে এখনই সরকারকে আইনের সংস্কার করে ব্যবস্থা নিতে হবে।
আর ডলারের ব্যাংক রেট কম হওয়ার নেপথ্যে অভ্যন্তরীণ চাহিদা না থাকা। অর্থাৎ বিদেশে বিনিয়োগ সংকুচিত হওয়ার কারণেই ডলারের দাম কমছে। এজন্য নির্বাচিত বিনিয়োগকারীদের বিদেশী বিনিয়োগের সুযোগ করে দিতে, ক্যাপিট্যাল একাউন্ট খুলে দেয়ারও পরামর্শ দেন তারা। এজন্য আইনের সংস্কার ও মনিটরিং সক্ষমতা বাড়ানোর পরামর্শও দেন তারা। তাদের মতে, দেশে কোন বড় ধরনের বিনিয়োগ নেই। অন্যদিকে বিদেশেও স্থানীয় উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করতে পারছে না।
গত কয়েক বছর ধরে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যে স্বস্তিতে ছিল তার বড়ো একটা অবদান রেমিটেন্সের। প্রবাসীদের শ্রম আর ঘামের বিনিময়ে অর্জিত এই রেমিটেন্সে এখন চলছে ভাটা। যার শুরুটা হয়েছিল ৭ মাস আগে। আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বরে রেমিটেন্স কমে ১০ দশমিক ৭ শতাংশ, সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবরে ৪ দশমিক ৩৫ এবং অক্টোবর থেকে নবেম্বরে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ। মাঝে ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে কিছুটা বাড়লেও গত মাসে রেমিটেন্স কমেছে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ। আর আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় তা ১৭ শতাংশেরও কম। বিশ্লেষকরা মনে করেন, ব্যাংক ও খোলাবাজারে ডলারের দরের মধ্যে বিস্তর ফারাকই এর কারণ। এ অবস্থা কাটিয়ে উঠতে হলে আইনে সংস্কার দরকার। তা না হলে রেমিট্যান্সে আরও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানে একটা সময় রেমিট্যান্স প্রবাহে ব্যাপক ধস নেমেছিল। ৮৩ সালে পাকিস্তানে মাসে রেমিটেন্স আসতো প্রায় সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলার। একদশক পর তা নেমে যায় মিলিয়ন ডলারের ঘরে। প্রায় একই অবস্থা হয়েছিল ’৯০ এর দশকে ভারতেও। দুটো দেশই অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়াতে নির্বাচিত বিনিয়োগকারীদের জন্য ক্যাপিট্যাল একাউন্ট খুলে দেয়। এতে ব্যাংক ও খোলাবাজারে ডলারের দরের পার্থক্য অনেকটাই কমে যায়। বিশ্লেষকদের পরামর্শ বাংলাদেশও এখন এই পন্থা অনুসরণ করতে পারে।
নির্বাচিত ব্যবসায়ীদের বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগ দিতে আইনের সংস্কার এবং মনিটরিং দক্ষতা বাড়ানোরও পরামর্শ দেন অর্থনীতিবিদরা। বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করে এসব পদক্ষেপ দীর্ঘমেয়াদী। তাই বিদ্যমান ব্যবস্থার মধ্যেই রেমিটেন্স কমার প্রবণতা ঠেকানোর চেষ্টা করছে প্রতিষ্ঠানটি। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, সাম্প্রতিক সময়ে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে কড়াকড়ি এবং নিরাপত্তার জন্য রেমিটেন্স সংগ্রহকারী গ্রাহকের তথ্য নেয়া অন্তর্ভুুক্তিমূলক ব্যাংকিং কার্যক্রমে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মুনসুর বলেন, ব্যাংক থেকে খোলা বাজারে ডলারের দাম অনেক বেশি। কিন্তু আইন না থাকার কারণে বাইরে থেকে ডলার ক্রয় করতে পারছে না ব্যবসায়ীরা। আইনের কারণেই বাধ্য হয়ে ব্যাংক থেকে কম দামে ডলার ক্রয় করছে উদ্যোক্তারা। এতে করে রেমিট্যান্সের প্রবাহ কমছে। অর্থাৎ ডলারের প্রকৃত মূল্য পাচ্ছে না সংশ্লিষ্টরা। যদি আইন সংস্কার করে মুক্ত ক্যাপিটাল একাউন্ট খোলা যায় তাহলেই রেমিট্যান্সের নেতিবাচক প্রভাব কমবে। এজন্য আইনের সংস্কার দরকার। তাহলেই আইনী বৈধতা পাবে এবং ইতিবাচক ধারায় ফিরতে পারে রেমিট্যান্স প্রবাহ।
বিশ^ ব্যাংকের ঢাকা অফিসের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, আইনের সংস্কার দরকার। তা না হলে অর্থনীতিতে আরও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে উদ্যোগ নিতে হবে। এতে কিছুটা ঝুঁকি থাকলেও আইনের সংস্কার করতে হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গবর্নর এসএম মনিরুজ্জামান বলেন, আইনের সংস্কার সময়ের ব্যাপার। বিদ্যমান আইনের মধ্যে কিভাবে অবস্থার উত্তরণ করা যায় তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ব্যাংকের সাথে খোলা বাজারে ডলারের দামের পার্থক্য কমিয়ে আনতে মনিটরিং আরও জোরদার করা হচ্ছে। চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের রেমিট্যান্স আয় অস্বাভাবিকভাবে কমে গেছে।
এদিকে রেমিট্যান্স প্রবাহ নানা কারণে কমছে বলে মনে করছে সরকার। সরকারি পর্যায়ে বলা হচ্ছে, রেমিট্যান্স আয় কমেনি, কিন্তু ব্যাংকিং চ্যানেলে আসছে না বলেই রেমিট্যান্স কম মনে হচ্ছে। কিন্তু এ বক্তব্য প্রশ্নাতীতভাবে মেনে নেয়া যায় না। কারণ ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে আগেও রেমিট্যান্স আসতো। তাই বলে রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি হ্রাস পায়নি। রেমিট্যান্স আয় হ্রাস পাওয়ার পেছনে অন্য কারণ রয়েছে। বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানির মূল গন্তব্য মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের দেশে দেশে বর্তমানে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। জনশক্তি আমদানি কমিয়ে দিয়েছে তারা। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম হ্রাস পেয়েছে। এ কারণে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অর্থনীতিতে সৃষ্টি হয়েছে একধরনের নেতিবাচক প্রভাব। সৌদি আরব বা এ ধরনের দেশ তাদের অনেক বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন বিলম্বিত করছে। তারা শ্রমিক ছাঁটাই করছে অথবা কমিয়ে দিচ্ছে বেতন-ভাতা। ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া প্রভৃতি দেশে এখন আর জনশক্তি রফতানি করা যাচ্ছে না। কারণ এসব দেশে যুদ্ধ চলছে অথবা বিরাজ করছে যুদ্ধাবস্থা। অনেক দিন ধরেই বিভিন্ন মহল থেকে জনশক্তি রফতানির নতুন গন্তব্য অনুসন্ধানের কথা বলা হচ্ছিল। কিন্তু এক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতি হচ্ছে না। আগামীতে আমরা যদি জনশক্তি রফতানি যৌক্তিকভাবে বাড়াতে চাই, তাহলে নতুন নতুন গন্তব্য খুঁজে বের করতে হবে। একই সঙ্গে প্রশিক্ষিত-দক্ষ ও পেশাজীবীদের বেশি করে বিদেশে পাঠাতে হবে। শুধু চটের ছালা রফতানি করে যেমন পাটশিল্প টিকিয়ে রাখা যায়নি, তেমনি অশিক্ষিত ও অদক্ষ শ্রমিক বিদেশে পাঠিয়ে এ খাতের অগ্রগতি ধরে রাখা যাবে না।
কিন্তু সরকারের এমন বক্তব্যের সাথে একমত নয় দেশের অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, এটি যেমন একটি কারণ তেমনি ডলারের দাম পার্থক্যও অন্যতম কারণ। একই সাথে বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগ সংকুচিত হওয়ার কারণেও ডলারের দাম করছে। আর এ কারণেই নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে রেমিট্যান্স প্রবাহে।

http://www.dailysangram.com/post/