দীর্ঘদিন সড়ক কেটে রাখায় শেওড়াপাড়ায় পথচারীদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে l প্রথম আলো
১৬ মার্চ ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৯:৫১

শর্ত না মেনে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়িতে দুর্ভোগ

 

দুই সিটি করপোরেশন ও বিভিন্ন সেবা সংস্থা ঢাকা শহরের মূল সড়ক এবং অলিগলির কম-বেশি পাঁচ শতাধিক স্থানে খোঁড়াখুঁড়ি চালাচ্ছে। তবে এসব কাজে স্বাভাবিক চলাচল যাতে ব্যাহত না হয়, সেই শর্তগুলো মানা হচ্ছে না। এর ফলে দুর্ভোগ এখন রাজধানীবাসীর নিত্যসঙ্গী। এই পরিস্থিতি চলছে কমবেশি তিন মাস ধরে।
এসব খোঁড়াখুঁড়ির উদ্দেশ্য সড়ক ও নালা নির্মাণ, উন্নয়ন ও সৌন্দর্যবর্ধন। আর রয়েছে সেবা সংস্থার লাইন অপসারণ। চলমান আছে মগবাজার উড়ালসড়ক ও মেট্রোরেলের মতো দুটি বড় প্রকল্পেরও কাজ।
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন সূত্র বলছে, চলতি শুকনো মৌসুমে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন বিভিন্ন সংস্থাকে ৮৮টি স্থানে সড়ক খোঁড়াখুঁড়ির অনুমতি দিয়েছে। এর মধ্যে মেট্রোরেলের পথে থাকা বিদ্যুতের লাইন অপসারণের কাজও রয়েছে।
দুই সিটি করপোরেশনের নিজস্ব খোঁড়াখুঁড়ির কাজ চলছে চার শতাধিক স্থানে। দুই সিটি করপোরেশন ছাড়াও খোঁড়াখুঁড়ি করা অন্য সংস্থাগুলো হচ্ছে বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্বে নিয়োজিত ডেসা, ডেসকো ও ডিপিডিসি; পানি সরবরাহের দায়িত্বে থাকা ওয়াসা; গ্যাস কোম্পানি তিতাস; টেলিফোন কোম্পানি টিঅ্যান্ডটি। এর বাইরে কিছু বেসরকারি ইন্টারনেট সেবা সংস্থাও রয়েছে। অন্য সংস্থাকে খোঁড়াখুঁড়ির অনুমতি দেওয়ার জন্য দুই সিটিরই ‘সড়ক খনন ও পুনর্নির্মাণ’ শীর্ষক ওয়ানস্টপ সমন্বয় সেল রয়েছে। সেলটি ২০০৩ সালে প্রণীত ‘সড়ক খনন নিয়ন্ত্রণ ও পুনর্নির্মাণ’ নীতিমালা অনুযায়ী অনুমতি দেয়।
খোঁড়াখুঁড়ির পূর্বশর্ত হলো প্রতিদিনের খনন করা অংশ বালু দিয়ে ভরাট করা, পর্যাপ্ত নিরাপত্তাবেষ্টনী থাকা, আড়াআড়ি খননের ক্ষেত্রে স্টিলের পাত দিয়ে গর্ত ঢেকে রাখা, সাইনবোর্ড টাঙিয়ে খননের উদ্দেশ্য, কাজ শুরু ও সমাপ্তির তারিখ প্রদর্শন করতে হবে। অনিবার্য না হলে খননকাজ শুধু রাতেই করতে হবে এবং সকাল হওয়ার আগে খনন করা মাটি বা পরিত্যক্ত নির্মাণসামগ্রী (রাবিশ) সরিয়ে নিতে হবে।
প্রথম আলোর দুজন প্রতিবেদক এবং দুজন ফটোসাংবাদিক গত মঙ্গল ও গতকাল বুধবার রাজধানীর মিরপুর, কল্যাণপুর, গাবতলী, গুলশান, রামপুরা, মগবাজার, মালিবাগ ও যাত্রাবাড়ী এলাকা ঘুরেছেন। এসব এলাকায় শর্ত পালন করার কোনো দৃশ্য দেখা যায়নি। এমনকি সিটি করপোরেশন নিজে যেসব স্থানে নির্মাণকাজ চালাচ্ছে, সেসব স্থানেও শর্ত পূরণ হচ্ছে না। ফলে অন্তত তিন মাস ধরে রাজধানীর মানুষ যানজট আর ধুলার রাজ্যে বসবাস করছে। গত সপ্তাহে মৌসুমের প্রথম বৃষ্টির কারণে কিছু স্থানে সড়কে পানি জমে আছে।
দুই সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, অনুমতি পাওয়া সংস্থা বা ঠিকাদারের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে খনন করা অংশ ভরাট করার কথা। এরপর সড়ক পিচ ঢালাই করে আগের অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তরের মেয়র আনিসুল হক প্রথম আলোকে বলেন, সিটি করপোরেশন বাদে যারা সড়ক খুঁড়ছে, তারাও সরকারি সংস্থা। প্রত্যেক সংস্থার নিজস্ব দায়িত্ব আছে। যাদের অনুমতি দেওয়া হয়েছে, তারা নিজেদের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করছে না। আর উত্তর সিটির অধীন কাজের ঠিকাদারেরা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি নিয়ম মেনে কাজ করছেন। খুঁড়ে তোলা মাটি সব সময় দিনেরটা দিনে সরানো সম্ভব হয় না।
মগবাজার উড়ালসড়কের নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১২ সালে, তিন বছরে শেষ হওয়ার কথা ছিল। শর্ত ছিল নির্মাণকাজ চলার সময় জনগণের ব্যবহারের সড়কটি উপযোগী রাখা হবে। কিন্তু প্রকল্প এলাকার প্রায় পাঁচ কিলোমিটারজুড়ে জল-কাদায় মাখামাখি দেখা গেল। বৃষ্টির পরই খানাখন্দে ভরা সড়কের এই অবস্থা হয়েছে। এর আগে পুরো শুকনো মৌসুম কেটেছে ধুলার রাজ্যে।
এই প্রকল্প এলাকার আশপাশে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, আবুজর গিফারী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, সিদ্ধেশ্বরী কলেজসহ বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। মৌচাক, আনারকলি, আয়েশা শপিং মল, ফরচুন শপিং মল, হোসাফ টাওয়ারসহ অসংখ্য বিপণিবিতানের অবস্থান ওই এলাকায়।
মালিবাগ চৌধুরীপাড়ার খুরশিদা হকের মতে, এই এলাকা একাধারে চলাচলের অনুপযোগী ও বিপজ্জনক। দুর্ভোগের চেয়ে কখন রিকশা উল্টে দুর্ঘটনার শিকার হন—এটাই খুরশিদার শঙ্কা। তিনি তাঁর মেয়েকে নিয়ে প্রতিদিন ভিকারুননিসা নূন স্কুলে আসেন।
মেট্রোরেল প্রকল্পের আওতায় গত ২ নভেম্বর আগারগাঁও থেকে মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর পর্যন্ত প্রায় সোয়া তিন কিলোমিটার সড়কের দুপাশে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) রাস্তা খননের কাজ শুরু করে।
গতকাল দুপুরে দেখা যায়, মেট্রোরেল প্রকল্পের শেওড়াপাড়া থেকে কাজীপাড়া বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত সড়কের দুই পাশেই গর্ত খোঁড়া। নিরাপত্তাবেষ্টনী নেই। কোথাও কোথাও একটা করে বাঁশের খুঁটি দিয়ে সীমানা চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। মানুষের এপার-ওপার হওয়ার জন্য বাঁশ-স্টিলের পাত ফেলা হয়েছে। গর্তের মাটি সড়কেই পড়ে আছে। যানবাহনের চাকার সঙ্গে ঘর্ষণের ফলে ধুলা হয়ে চারদিকে উড়ছে। আশপাশের ভবন-দোকানগুলো ধুলার রঙে ধূসর।
পূর্ব কাজীপাড়ার রুহুল আমিন বলেন, সড়ক খোঁড়া হয়েছে ৫ ফুট কিন্তু যন্ত্রপাতি, মাটি, রাবিশ ফেলে সড়কের ১৫-২০ ফুট বন্ধ করে রাখা হয়েছে। উন্নয়ন হবে ভালো কথা, জনগণের চলাচল বন্ধ করা তো ঠিক নয়। দুর্ভোগের তো একটা সীমা আছে।
মেট্রোরেল ও উড়ালসড়ক প্রকল্পের শুরুতেই পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নিতে হয়েছে। ওই ছাড়পত্রে নির্মাণকালীন পরিবেশ ও শব্দদূষণ না করা, মানুষের যাতায়াত বাধাগ্রস্ত না করা, নির্মাণসামগ্রী দিয়ে সড়ক দখল না করাসহ বেশ কিছু শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়। সম্প্রতি পরিবেশ অধিদপ্তর উড়ালসড়ক ও মেট্রোরেল নির্মাণকারী সংস্থাকে শব্দ ও ধুলাদূষণ কমানোর বিষয়ে চিঠি দিয়েছে।
মেট্রোরেলের বাস্তবায়নকারী সংস্থা ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানির নির্বাহী পরিচালক মোফাজ্জল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা টাকা দিয়েছেন। কাজ করছে সরকারি-বেসরকারি পাঁচ-ছয়টি সংস্থা। কাজটা জটিল। মানুষের ভোগান্তি কমাতে সংস্থাগুলোর ওপর তাঁরা চাপ রাখছেন।
সিটি করপোরেশনের হিসাবে, ঢাকার মূল সড়কগুলো ৯০ থেকে ১০০ ফুট পর্যন্ত চওড়া। ৪৮ থেকে ৭০ ফুটের সড়কও বেশ কিছু। এই সড়কের একটা বড় অংশ যানবাহনের পার্কিং, হকার ও নির্মাণসামগ্রী রেখে দখল করে রাখা হয়। বাকি সড়কের একটা অংশ চলে যাচ্ছে খোঁড়াখুঁড়ির কারণে। এতে যানজট আরও তীব্র হচ্ছে।
গত বছর সরকারের ক্লিন এয়ার অ্যান্ড সাসটেইনেবল এনভায়রনমেন্ট প্রকল্পের অধীনে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকার বাতাসে ক্ষতিকর যেসব সূক্ষ্ম বস্তুকণা (পিএম ২.৫ ও পিএম ১০) বিদ্যমান, এর ৬০ শতাংশ আসে ইটভাটা থেকে। আর ১৭ শতাংশের উৎপত্তি যানবাহন ও ধুলা থেকে। যানবাহনের সৃষ্ট বস্তুকণার উৎস মূলত সড়কের সঙ্গে চাকার ঘর্ষণের ফলে সৃষ্ট ধুলা।
প্রকল্পটির পরিচালক মনজুরুল হান্নান খান প্রথম আলোকে বলেন, বাতাসে সূক্ষ্ম বস্তুকণা বৃদ্ধি পেলে কাশি ও হাঁপানি বেড়ে যায়। ডিসেম্বরের আগে-পরের শুকনো মৌসুমে চার-পাঁচ মাস নির্মাণসামগ্রী ঢেকে রাখা, পানি ছিটানো এবং খোঁড়াখুঁড়ির স্থান বেষ্টনীর ভেতর রাখলে ক্ষতি কমে যেত। কিন্তু এটা কেউ মানে না।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক প্রথম আলোকে বলেন, অন্য দেশে বারবার সড়ক কাটে না। একটা এলাকার মানুষের চাহিদা কী হতে পারে, তা আগেই তারা ঠিক করে। কিন্তু ঢাকায় এটা করা হয়নি। যেহেতু সমস্যা সৃষ্টি হয়ে গেছে, এখন দায়িত্ব নিয়ে শর্তগুলো পালন করলে ভোগান্তি কিছুটা কমে। প্রয়োজন হলে মানুষের ভোগান্তি নিরসনে প্রতিটি প্রকল্পে বাড়তি বরাদ্দ রাখতে হবে।
http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/