১৬ মার্চ ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ৯:৫০

তোশিবার আর্থিক সঙ্কটে বিদ্যুৎ বিভাগে উদ্বেগ!

 

তোশিবার আর্থিক সঙ্কটে বিদ্যুৎ বিভাগে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। ১২শ’ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ পাওয়ার জন্য এই কোম্পানিটি দরপত্র দাখিল করেছে। প্রকল্পটি প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকারমূলক হওয়ার কারণে যথাসময়ে এর কাজ শুরু করা যাবে কি না তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। একই সাথে অধিকতর সতর্কতা অবলম্বন না করে লোকসানের কবলে পড়া কোনো কোম্পানিকে কাজ দেয়া হলে মাতারবাড়ী প্রকল্পটির ভবিষ্যতও কী ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিবিয়ানা সাউথ ও ৩৩৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন সিদ্ধিরগঞ্জ প্রকল্পের মতো হবে কি না সে দিকটিও বিদ্যুৎ বিভাগ খতিয়ে দেখছে বলে জানা গেছে।
মাতারবাড়ী প্রকল্প নিয়ে দরপত্র জমা দেয়া দু’টি কোম্পানি- মারুবিনি এবং অপর কোম্পানিটি হচ্ছে তোশিবা ও সুমিটোসো জেভি। তোশিবার আর্থিক দুরবস্থার ব্যাপারে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় খোঁজ নিয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পিডিবির এক কর্মকর্তা জানান, জাপানি কোম্পানি তোশিবার আর্থিক অবস্থা শোচনীয় পর্যায়ে রয়েছে। টোকিও স্টক এক্সচেঞ্জ মার্কেটে কোম্পানিটির অবস্থা একেবারেই খারাপ। এই কোম্পানির শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে এ নিয়ে রীতিমতো উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।
গতকাল (বুধবার) বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, টোকিও স্টক এক্সচেঞ্জ তোশিবাকে এখনও সতর্কতার তালিকায় রেখেছে। কোম্পানিটিকে ১ মাস সময় দেয়া হয়েছিল লোকসান কাটিয়ে তোলার জন্য। কিন্তু কোম্পানিটি লোকসান কাটিয়ে তুলতে না পারায় তাদের আয়-ব্যয়ের প্রতিবেদন দাখিল না করে আরো সময় চেয়েছে। এ ধরনের সময় চাওয়া জাপানি কোনো কোম্পানির জন্য খারাপ একটি দৃষ্টান্ত।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, তোশিবা গত ডিসেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসের আর্থিক বিবরণী দাখিলের জন্য সময় নিয়েছিল। পরবর্তীতে ফেব্রæয়ারিতে এসে আরো এক মাস সময় বৃদ্ধির আবেদন করে। এই আবেদন টোকিও স্টক এক্সচেঞ্জ এখন পর্যন্ত গ্রহণ করেনি। তবে কোম্পানিটির পক্ষ থেকে জোর তদবির চলছেÑ যাতে করে তারা সতর্কতার তালিকা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে।
সময় বৃদ্ধির আবেদনে তোসিবা উল্লেখ করেÑ ইউএসএ সাবসিডারি ওয়াশিংটন হাউজ ইলেকট্রিকের অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণের ওপর তদন্তের কারণে তাদের প্রতিবেদন দাখিল করতে দেরি হচ্ছে। তোশিবা জানায়, এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতি মাসে ইউএস নিউক্লিয়ারের জন্য তাদেরকে ৭০০ বিলিয়ন ইউয়েন লোকসান দিতে হয়েছে। এই লোকসান কমিয়ে আনতে ওয়াশিংটন হাউজের চেয়ারম্যান ডেনি রডরিক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নির্দেশ দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, ওয়াশিংটন হাউজের অডিট ফার্ম তদন্ত করে দেখছে যে, অতীতে এমন ঘটনা আর ঘটেছে কি না?
এছাড়াও তোশিবা ২০১৭ সালে মধ্য মেয়াদি যে পরিকল্পনা নিয়েছে সেখানে চিপ ব্যবসার উল্লেখযোগ্য অংশ বিক্রি করে দেয়া এবং ওয়াশিংটন হাউজকে তোশিবা থেকে বাদ দেয়া। তোশিবার ওয়েব সাইটে উল্লেখ করা হয়, এই ব্যবসা বাদ দিলে ৪ ট্রিলিয়ন ইয়েন মার যাবে; যা ২০০৭ অর্থবছরের প্যাক-এর অর্ধেক। এছাড়াও কোম্পানিটির আরো যেসব সমস্যা রয়েছেÑ এসব সমস্যার সমাধান করে অর্থনৈতিক সক্ষমতা ফিরিয়ে আনতে অনেক সময় লাগবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
তোশিবার এমন আর্থিক দুরবস্থার কারণে মিয়ানমার সরকারও প্রতিষ্ঠানটির ব্যাপারে নতুন করে চিন্তাভাবনা করছে। জানা গেছে, মিয়ানমারের মোন প্রদেশে ১২৬০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য তোশিবার সাথে আলোচনা করছিল ওই দেশটির সরকার। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক দুরবস্থার কথা জানতে পেরে মিয়ানমার এখন তাদের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণের জন্য অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সাথেও আলোচনা চালাচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে মাতারবাড়ী প্রকল্পের দরপত্র নিয়ে সরকার কোন দিকে এগোবে তার ওপর নির্ভর করছে এর ভবিষ্যৎ।
উল্লেখ্য, ঠিকাদার নিয়োগে কোল পাওয়ার জেনারেশন অব বাংলাদেশ লিমিটেড (সিপিজিসিবিএল) ২০১৫ সালের ৪ জুন এ প্রকল্পের জন্য প্রি-কোয়ালিফিকেশন (পিকিউ) আহŸান করে। তাতে দু’টি কোম্পানি চূড়ান্ত হয়। প্রি-কোয়ালিফিকেশন মূল্যায়ন কমিটি পরে ওই দু’টি কোম্পানিকে মূল দরপ্রস্তাব দাখিলের আহŸান জানায়। জানা গেছে, ৩১ জানুয়ারি কোম্পানি দু’টি দরপ্রস্তাব জমা দেয়। তবে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।
‘অত্যাধুনিক’ এ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ৩৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। এই প্রকল্পের মোট বিনিয়োগের ২৯ হাজার কোটি টাকা দেবে জাপানের উন্নয়ন সাহায্য সংস্থা জাইকা।
এদিকে জাইকার ক্রয় নীতিমালার প্রাক-যোগ্যতাসম্পন্ন দরদাতাদের দরপত্র মূল্যায়ন পদ্ধতির সেকশন ৩.২-এর ৫ নম্বর ধারায় বলা আছেÑ ‘প্রাক-যোগ্যতাকালীন সময়ে দরতাদাদের দেয়া তথ্য দরপত্র মূল্যায়নকালে যাচাই-বাছাই করতে হবে এবং কোনো দরদাতার যোগ্যতা বা সম্পদ সন্তোষজনকভাবে চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য যথেষ্ট না থাকলে সেই দরদাতাকে কাজ দেয়া হবে না।’ কাজেই জাইকার ক্রয় নীতিমালা অনুযায়ী যে কোনো প্রতিষ্ঠানকে কাজ পেতে হলে আর্থিকভাবে শক্তিশালী থাকতে হবে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সিপিজিসিবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কাশেম বলেন, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রটির নির্মাণকাজ যথাসময়ে শেষ করা হবে। এ নিয়ে সরকার কোনো ধরনের আপস করবে না। সরকারের বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাস্টার প্লান অনুযায়ী মাতাবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকেও জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ দেয়া হবে।
সিপিজিসিবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরো বলেন, যে কোনো কোম্পানিরই বছর শেষে লাভ-লোকসান থাকতে পারে। কিন্তু ওই কোম্পানির যদি নিট সম্পদ আর বাৎসরিক টার্নওভার ঠিক থাকে, তবে কোনো সমস্যা থাকার কথা নয়। এরপরও আমরা তোশিবার আর্থিক লোকসানের সব খোঁজই নিচ্ছি। যাতে করে ভবিষ্যতে সরকারকে বড় ধরনের কোনো সমস্যায় পড়তে না হয়।

- See more at: https://www.dailyinqilab.com/article/