১৫ মার্চ ২০১৭, বুধবার, ৩:৩৭

অস্তিত্ব রক্ষার পরীক্ষায় ইউরোপ

বর্তমানে অস্তিত্বের সংকটে ভুগছে ইউরোপ। প্রশ্ন উঠেছে তারা ঐক্য ধরে রাখতে পারবে তো? চলতি সপ্তাহে ইউরোপের ভাঙনের ঝুঁকি আরও তাৎপর্যপূর্ণভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বহুমুখী সংকটে মহাদেশটির গভীরতম সমস্যাগুলোর ভয়াবহ লক্ষণ ও কারণ দ্রুতই প্রকাশ পাচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে বের হয়ে যাওয়ার পদক্ষেপ আগেই নিয়েছে ব্রিটেন। ব্রিটেনের ইইউ থেকে বের হয়ে যাওয়া এখন সময়ের ব্যাপার। ঠিক একই সময়ে ব্রিটেন থেকে বের হয়ে নিজেদের স্বাধীনতার কথা ভাবছে স্কটল্যান্ড। এদিকে নেদারল্যান্ডসের জাতীয় নির্বাচনে উগ্র ডানপন্থীদের উত্থানের আশংকা দেখা দিচ্ছে। এছাড়া জার্মানি ও নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে তুরস্ক সরকারের বাগযুদ্ধ বেড়েই চলেছে। এমন পরিস্থিতিতে ইউরোপের অভ্যন্তরে এমন শক্তির উত্থান ও চাপের সৃষ্টি হচ্ছে যার ফলে মহাদেশটির ঐক্য ধরে রাখা কষ্টসাধ্য, এমনকি যে কোনো মুহূর্তে তা ভেঙে পড়তে পারে। চলতি সপ্তাহের বেশ কয়েকটি ঘটনা দ্বিতীয় যুদ্ধোত্তর ইউরোপীয় ঐক্য ও শৃংখলার জন্য একটা পরীক্ষা হিসেবে হাজির হয়েছে। সংকটগুলোর একটা পর্যালোচনা এখানে দেখান হল-

ডাচ নির্বাচনে উগ্র ডানপন্থীদের উত্থানের সম্ভাবনা : আজ বুধবার নেদারল্যান্ডসের জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এই নির্বাচনে উগ্র ডানপন্থী দল পার্টি ফর ফ্রিডমের উত্থানের আশংকা করা হচ্ছে। পার্লামেন্টের ১৫০টি আসনের মধ্যে বর্তমানে দলটির ১৫টি আসন রয়েছে। একাধিক জনমত জরিপ বলছে এ নির্বাচনে ৫ থেকে ১৫টি অতিরিক্ত আসন পাবে দলটি। আর তা যদি হয়, দলটি দেশের বৃহত্তম বা দ্বিতীয় বৃহত্তম দলে পরিণত হবে। দলটির নেতৃত্বে রয়েছেন গিয়ার্ট উইল্ডার্স। তিনি একজন সস্তা জনপ্রিয় এবং প্রচণ্ড ইসলাম বিদ্বেষী হিসেবে পরিচিত। নেদারল্যান্ডস ছাড়াও ইউরোপের আরও দুটি দেশ ফ্রান্স ও জার্মানিতে চলতি বছর জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ দেশগুলোতে সস্তা জনপ্রিয়তার উত্থান ইউরোপীয় ঐক্যের জন্য হুমকি তৈরি করছে। নেদারল্যান্ডসের নির্বাচন তাই ইউরোপের জন্য একটা পরীক্ষা। উগ্র ডানপন্থীরা হয়তো নেদারল্যান্ডসের ক্ষমতা নিতে পারবে না। তবে সস্তা জনপ্রিয় নীতির বাস্তবায়নে একটা চাপ অবশ্যই থাকবে। এ কারণে ইউরোপের অভিবাসী ইস্যু ও ইউরোপীয় ঐক্য সস্তা জনপ্রিয়দের টার্গেটের শিকার হতে পারে।

তুরস্ক ও ইউরোপের চলমান সংকট : ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর সরকার ও তুরস্কের মধ্যকার চলমান সংকট ইউরোপের অস্তিত্বের জন্য একটা বড় ধরনের পরীক্ষা। সংবিধান পরিবর্তনের লক্ষ্যে আগামী মাসে অনুষ্ঠেয় গণভোটের সমর্থনে প্রবাসী তুর্কি নাগরিকদের মধ্যে প্রচারণার জন্য ইউরোপ ভ্রমণ করছেন তুর্কি কর্মকর্তারা। কিন্তু জার্মানি ও নেদারল্যান্ডস তাদের দেশে অনুষ্ঠেয় সমাবেশ বাতিল করে। নেদারল্যান্ডস তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ফ্লাইট বাতিল করে এবং পরিবার মন্ত্রীকে বহিষ্কার করে। উভয় ঘটনার ক্ষেত্রে দেশটির উদ্দেশ্য গণভোটের পক্ষে কোনো সমাবেশে তুর্কি কর্মকর্তাদের যোগ দিতে না দেয়া। প্রতিক্রিয়ায় তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোগান দেশ দুটির ব্যাপক সমালোচনা করেন। এমনকি জার্মানি ও নেদারল্যান্ডসকে নাৎসিদের প্রেতাত্মা বলে মন্তব্য করেন। এরপর তুরস্ক ও নেদারল্যান্ডসের মধ্যে কূটনৈতিক টানাপোড়েন শুরু হয়।

ব্রিটেনের ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগ : ব্রিটিশ পার্লামেন্টে অনুমোদনের মাধ্যমে ব্রেক্সিট পরিকল্পনা এখন বাস্তবায়িত হওয়ার পথে। ইইউ চুক্তির আর্টিকেল ৫০ বাস্তবায়নের খুব কাছে চলে এসেছে প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মের সরকার। আর আর্টিকেল ৫০ একবার বাস্তবায়িত হলে ইইউ থেকে কার্যকরভাবে বের হয়ে যাবে ব্রিটেন। ফলে ইউরোপীয় ঐক্য আরও ভঙ্গুর হয়ে পড়বে। আশংকা করা হচ্ছে ব্রিটেনকে অনুসরণ করে অন্য সদস্য রাষ্ট্রগুলো ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে যেতে পারে।

ব্রিটেন থেকে স্কটল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতা : ব্রিটেন যখন ইউরোপ থেকে বের হয়ে যাওয়ার পথে, তখন ব্রিটেন থেকেই নিজেদের আলাদা করার তোড়জোড় শুরু করেছে স্কটল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ড। ব্রিটেনের গুরুত্বপূর্ণ দুটো অংশ স্কটল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ড এখন নিজেদের স্বাধীনতা দাবি করছে। স্কটল্যান্ডের ফার্স্ট মিনিস্টার নিকোলা স্টারজিওন ইতিমধ্যে নতুন করে গণভোটের আহ্বান জানিয়েছেন। স্কটল্যান্ডের ইচ্ছা স্বাধীন দেশ হিসেবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে যোগ দেয়া। তবে স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতাকামী নেতা স্টারজিওন ব্রিটিশ সরকারের অনুমতি ছাড়া কোনো গণভোট করতে চান না। তবে তার এ দাবির পক্ষে সাড়া মিলবে কিনা তা এখনও স্পষ্ট নয়। নিজেদের স্বাধীনতার লক্ষ্যে ২০১৪ সালে একটি গণভোটে অংশ নিয়েছিল স্কটিশ ভোটাররা। তবে বিপক্ষে শতকরা ৫৫ ভাগ ও পক্ষে ৪৫ ভাগ ভোট পাওয়ায় সেবার তারা পরাজিত হয়। তবে ব্রেক্সিটের কারণে দেশটির রাজনীতি এখন কিছুটা উত্তাল। এ সুযোগে আরেকটি গণভোট চান স্কটিশরা। ব্রেক্সিটের কারণে উত্তর আয়ারল্যান্ডের শান্তি চুক্তির ক্ষেত্রেও বড় ধরনের অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। ব্রেক্সিট সম্পন্ন হলে আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে ব্রিটেনের শান্তি চুক্তি নাও থাকতে পারে। আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতাকামী নেতা সিন ফিনের এখনও সংখ্যাগরিষ্ঠতার অভাব রয়েছে। তবে ইইউ থেকে ব্রিটেনের বের হওয়ার পর স্বাধীনতার পক্ষে সমর্থন জোরালো হবে বলে মনে করা হচ্ছে। এখন পরিস্থিতি এমন যে, শেষ পর্যন্ত যুক্তরাজ্য ভেঙে পড়তে পারে।

নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন, ভাষান্তর জামির হোসেন।




http://www.jugantor.com/ten-horizon/2017/03/15/109167