১৫ মার্চ ২০১৭, বুধবার, ১২:১৮

এখনও প্রস্তুত নয় চামড়াশিল্প নগরী

হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি সাভারে স্থানান্তর করার জন্য মালিকদের প্রতি সরকার বহুবার তাগিদ দিয়েছে। কিন্তু কোনোভাবেই মালিকরা সাড়া দেননি। অবশেষে চামড়া শিল্পের মালিকরা সত্যিই বিপদে পড়েছেন। হাজারীবাগে চামড়া কারখানা বন্ধের নির্দেশ বহাল রেখেছেন সর্বোচ্চ আদালত। একই সঙ্গে সেখানে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানিসহ সার্বিক সুবিধা বন্ধ করে দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ট্যানারি মালিকরা অনেক দেরিতে হলেও সাভারের চামড়াশিল্প নগরীতে কারখানা চালুর তোড়জোড় শুরু করেছেন। অনেকে নির্মাণাধীন ভবনেই মেশিনপত্র বসাচ্ছেন। রফতানি আদেশ ধরে রাখতে কেউ কেউ সেখানে কাজ শুরু করেছেন। ৬ মার্চ হাইকোর্ট থেকে হাজারীবাগে থাকা ট্যানারি কারখানা বন্ধ করার নির্দেশনা আসার পর সাভারের হেমায়েতপুরের চামড়াশিল্প নগরী সরেজমিন ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।

হাজারীবাগে কারখানা রয়েছে এমন ১৫৪টি ট্যানারি সাভার চামড়াশিল্প নগরীতে প্লট বরাদ্দ পেয়েছে। ২০১৩ সালে সরকার এই শিল্পনগরীর নকশা অনুমোদন করে কারখানা স্থাপনের জন্য মালিকদের প্লট বুঝিয়ে দেয়। গত ৭ মার্চ সেখানে গিয়ে দেখা গেছে, বেশিরভাগ কারখানারই অবকাঠামো নির্মাণ কাজ শেষ হয়নি। কোনো কোনো প্লট এখনও ফাঁকা পড়ে রয়েছে। কিছু প্লটে নির্মাণকাজ শুরুর পর বন্ধ রয়েছে। যেসব প্রতিষ্ঠান ভবন নির্মাণ শুরু করেছে, সেগুলোর মধ্যে ৩০টির মতো ট্যানারি একতলা ভবনও তৈরি করতে পারেনি। কিছু প্লটে পাইলিংয়ের কাজ চলছে। কেউ কেউ একতলা ছাদ ঢালাইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে। আবার কারও কারও ছয়তলা ভবন প্রস্তুত হয়েছে। নির্মাণাধীন ভবনে ৪৪টি কারখানা কাঁচা চামড়া

প্রক্রিয়াজাতকরণের (ওয়েট বল্গু) কাজ শুরু করেছে। তবে কোনো কারখানাই রফতানিযোগ্য চামড়া ক্রাস্ট ও ফিনিশড লেদার উৎপাদন শুরু করতে পারেনি।

ট্যানারি মালিকরা দাবি করেন, অর্থ সংকটের কারণে কারখানা নির্মাণকাজ পিছিয়ে আছে। ট্যানারিগুলো শিল্পনগরীর জমি নিজেদের নামে নিবন্ধন না পাওয়ায় ব্যাংক ঋণ পাচ্ছে না। এদিকে কারখানা স্থাপন করতে না পারলেও ক্রাস্ট ও ফিনিশড চামড়া উৎপাদনে দ্রুত গ্যাস সংযোগ চান মালিকরা। ইতিমধ্যে বেশিরভাগ ট্যানারি গ্যাস পেতে তিতাসের কাছে আবেদন করেছে বলে জানিয়েছেন তারা। তিতাসও গ্যাস সংযোগ দেওয়ার জন্য সার্বিক প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে।

বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদারগুডস ফুটওয়্যার অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ মাহিন সমকালকে বলেন, সর্বোচ্চ আদালতের রায় মেনে সবাই সাভার যাওয়ার চেষ্টা করছেন। তিনি দ্রুত ট্যানারি স্থানান্তর করে উৎপাদনে যেতে মালিকদের প্লটের জমির নিবন্ধন ও সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করার দাবি জানান। পাশাপাশি বিদ্যমান ঋণের সুদ মওকুফ করে কিস্তিতে পরিশোধের সুযোগও চান।

বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহিন আহমেদ বলেন, আরও তিন থেকে চার মাস সময় লাগবে পুরোপুরি ট্যানারি স্থানান্তরে। তিনি বলেন, এখন দ্রুত সাভারে যেতে সব ট্যানারিতে গ্যাস সংযোগ দেওয়া প্রয়োজন। যাতে ট্যানারি মালিকরা দ্রুত উৎপাদনে যেতে পারেন। সাভারের ১২০টি ট্যানারি গ্যাস সংযোগ পেতে আবেদন করেছে। কিন্তু হাজারীবাগের ৫১ ট্যানারিতে গ্যাস সংযোগ ছিল। কেবল তাদের গ্যাস দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। এতে অন্য ট্যানারিগুলো বিপাকে পড়বে বলে তিনি জানালেন।

জানতে চাইলে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোশাররফ হোসেন ভূইয়া সমকালকে বলেন, উচ্চ আদালতের রায় অনুযায়ী এখন সবাইকে ট্যানারি স্থানান্তর করতে হবে। আর কোনো বিকল্প নেই। তিনি বলেন, ট্যানারি মালিকরা জমির টাকা সব পরিশোধ করলে এখনই নিবন্ধন দেওয়া হবে। তবে তাদের দাবি অনুযায়ী কিছু টাকা মওকুফ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এ জন্য কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে। এ বিষয়ে শিগগিরই সিদ্ধান্ত হবে। আর গ্যাসের সংযোগও দ্রুত দেওয়া হবে। সচিব বলেন, এখন কিছু ব্যবসায়ী বলছেন তারা প্লট পাননি। কিন্তু প্লট বরাদ্দ দেওয়ার পরে এতদিনে কেউ এমন দাবি করেননি। ট্যানারি স্থানান্তরের জন্য মালিকদের বার বার নোটিশ দেওয়া হয়েছে। কেউ প্লট না পাওয়ার বিষয়টি জানাননি। তিনি বলেন, ট্যানারি শ্রমিকদের আবাসন, হাসপাতালসহ বিভিন্ন সুবিধা দিতে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি যারা প্লট পাননি, তাদের প্লট পরে দেওয়া হবে। এ জন্য আরও ২০০ একর জমি অধিগ্রহণ করার জন্য প্রক্রিয়া চলছে বলে তিনি জানালেন।

সাভার চামড়াশিল্প নগরী ঘুরে দেখা যায়, নবারুণ ট্যানারির তিনতলা পর্যন্ত শুধু ছাদ নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু ট্যানারির প্রত্যেক তলার নির্মাণ কাজ এখনও শেষ হয়নি। এ অবস্থায় নিচতলায় চলছে ওয়েট ব্লু'র কাজ। দ্বিতীয় তলার এক পাশে যন্ত্রপাতি ছাড়াই হাতে চলছে চামড়া রঙ করার কাজ। অন্য পাশে কয়েকটি যন্ত্রে চলছে জুতা তৈরির কাজ। তার পাশে রয়েছে স্তূপ করা জুতা। তৃতীয় তলায় পড়ে আছে নির্মাণসামগ্রী। ক্রেতাদের অর্ডার থাকায় দ্রুত সরবরাহ করতে এভাবে কাজ করা হচ্ছে বলে জানান শ্রমিকরা। তারা বলেন, শিগগিরই হাজারীবাগ থেকে সব যন্ত্রপাতি খুলে নিয়ে আসা হবে। এখানেই ক্রাস্ট ও ফিনিশড চামড়া তৈরির যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হবে।

খানিকটা দূরে ভেলেক্স, কিট ও সুপিরিয়র লেদারের তিন কারখানায় একসঙ্গে চলছে যন্ত্রপাতি স্থাপন। গত শনিবার হাজারীবাগের ট্যানারি বন্ধ করে সব যন্ত্রপাতি স্থানান্তর করা হয় সাভারে। ট্যানারির তত্ত্বাবধায়ক মো. মাইনুদ্দিন বলেন, হাজারীবাগে কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এখন এই কারখানার ওয়েট ব্লু'র ড্রাম স্থাপন প্রায় শেষ পর্যায়ে। পাশাপাশি ক্রাস্ট ও ফিনিশড লেদারের যন্ত্রপাতি আনা হয়েছে। এসব যন্ত্রপাতি দ্রুত স্থাপন করে উৎপাদন শুরু হবে।

গত রোববার ক্রেনের সাহায্যে চতুর্থ তলায় যন্ত্রপাতি তুলতে দেখা যায় মারসন্স ট্যানারিতে। এ ট্যানারির পরিচালক মাকসুদুর রহমান বলেন, গত ১৯ জুলাই থেকে ওয়েট ব্লু'র কাজ শুরু হয়েছে। এখন ক্রাস্ট ও ফিনিশড চামড়া উৎপাদন করা হবে। এ জন্য ইতালি থেকে স্প্রে ও হাইড্রলিক প্রেসসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি আমদানি করা হয়েছে। ইতালি থেকে প্রকৌশলী এলে এক মাসের মধ্যে সব যন্ত্রপাতি স্থাপন শেষ হবে। মাকসুদুর রহমান বলেন, ২০১৪ সালে গ্যাসের জন্য আবেদন করে এখনও গ্যাস সংযোগ মেলেনি। গ্যাস না পাওয়া পর্যন্ত ক্রাস্ট ও ফিনিশড লেদার উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে না। তিনি বলেন, হাজারীবাগে শুধু ওয়েট ব্লু কারখানা ছিল। সাভারে সব ধরনের চামড়া উৎপাদনের যন্ত্রপাতি স্থাপন করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে গ্যাস সংযোগ না পেয়ে বিনিয়োগ করেও দীর্ঘ সময় অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে।

এসব ট্যানারি ছাড়াও রিলায়েন্স, আজমীর, এপেক্স, বে, মইন, মদিনা, সামিনাসহ বিভিন্ন ট্যানারিতে ওয়েট ব্লু'র পাশাপাশি ক্রাস্ট ও ফিনিশড চামড়া উৎপাদনের জন্য যন্ত্রপাতি স্থাপনের প্রক্রিয়া চলছে। সামিনা ট্যানারির তত্ত্বাবধায়ক শরিফুল ইসলাম বলেন, গত চার মাস ধরে ওয়েট ব্লু'র কাজ চলছে। এখন ড্রাই ড্রাম স্থাপন করা হচ্ছে। আগামী তিন মাসের মধ্যে সব কাজ শেষ হবে।

এদিকে জিন্দা লেদার নামে একটি কারখানা ভবনের পাইলিংয়ের কাজ সবে শেষ হয়েছে। বর্তমানে কারখানাটির নির্মাণকাজ বন্ধ রয়েছে। এ রকম শিল্পনগরীতে শাহজালাল ও মাইজদী ট্যানারির মতো অনেক কারখানার ভবন নির্মাণকাজ এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে। এসব ট্যানারির নির্মাণকাজ বন্ধ অবস্থায় রয়েছে।

চামড়াশিল্প নগরীতে ট্যানারি চালুর শুরুতে বর্জ্যে নদীদূষণ হলেও এখন তা প্রায় বন্ধ। কর্মরত শ্রমিকরা জানান, কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারের (সিইটিপি) অর্ধেক অংশ চালু হয়েছে। বাকি অর্ধেক এক মাসের মধ্যে চালু হবে। সিইটিপিতে গত ৪৫ দিন ধরে ব্যাকটেরিয়া উৎপাদন করে পানি পরিশোধন করা হচ্ছে। এ কারণে পানিতে কিছুটা দুর্গন্ধ হচ্ছে। তবে তা পরিশোধন করেই নদীতে ফেলা হচ্ছে। সিইটিপির সম্পূর্ণ কাজ শেষ করতে আরও এক মাস সময় লাগবে। ৯০ দিনের মধ্যে পুরোপুরি প্রক্রিয়া পরিশোধন করা সম্ভব হবে।

সিইটিপির পাশেই সলিড ওয়েস্টের ডাম্পিং স্টেশন। সেখানে খোলা স্থানে কঠিন বর্জ্য স্তূপ করে রাখা হচ্ছে। চারদিকে বেশ দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। স্থানীয় নির্মাণ শ্রমিকরা জানান, স্তূপ করা এই বর্জ্য ট্রাকে করে গোপনে অনেকে নিয়ে যাচ্ছে। এ থেকে হাঁস-মুরগি, মাছের খাদ্য বানানো হচ্ছে। বেশিরভাগ বর্জ্যই এখান থেকে ট্রাকে করে রায়েরবাজার বেড়িবাঁধে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তবে এ বর্জ্য সরিয়ে নেওয়ার কথা অস্বীকার করেছেন ট্যানারি মালিকরা।

চামড়াশিল্প নগরী প্রকল্পের প্রকৌশলী মোস্তফা মজুমদার সমকালকে বলেন, বর্জ্য পরিশোধন ব্যবস্থা এখন সন্তোষজনক অবস্থায় এসেছে। আগামী ৪৫ দিন ব্যাকটেরিয়া উৎপাদন হলে আরও ভালোভাবে পরিশোধন হবে। এ ছাড়া কঠিন বর্জ্যের স্থায়ী সমাধানের জন্য কাজ চলছে। এ বর্জ্য সার কিংবা বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার হতে পারে। এ জন্য একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। চালু সব ট্যানারিতে পানি ও বিদ্যুতের সংযোগ দেওয়া হয়েছে। গ্যাস সংযোগ পেতে যারা ডিমান্ড নোটের টাকা জমা দিয়েছেন, তারা দ্রুত গ্যাস পাবেন। তা ছাড়া হাজারীবাগে যাদের সংযোগ ছিল, তাদের আগে দেওয়া হবে। পর্যায়ক্রমে সবাইকে দেওয়ার চেষ্টা চলছে।

http://bangla.samakal.net/2017/03/15/277480