১৫ মার্চ ২০১৭, বুধবার, ১২:০৮

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হল

কক্ষ দখল নিয়ে রাতভর ছাত্রলীগের তাণ্ডব

প্রাধ্যক্ষের কক্ষ ভাংচুর * আবাসিক শিক্ষকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার * নেপথ্যে দু’পদে নিয়োগ ও ক্যান্টিনে চাঁদাবাজি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হলে কক্ষ দখল নিতে গিয়ে রাতভর তাণ্ডব চালিয়েছে ছাত্রলীগ। সংগঠনের নেতাকর্মীরা রাতের অন্ধকারে শতাধিক শয্যা দখল করেন। এ সময় তারা লাঞ্ছিত করেন বেশকিছু আবাসিক শিক্ষার্থীকে। ভাংচুর করেন হল প্রাধ্যক্ষের কক্ষ। আবাসিক শিক্ষকদের সঙ্গেও তারা দুর্ব্যবহার করেন। এ সময় দফায় দফায় ধাওয়ার ঘটনাও ঘটে। চরম আতংকের মধ্যে হলের সাধারণ ছাত্ররা রাত পার করেন। রাতেই সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলে এক সাংবাদিকের ওপর হামলা চালিয়েছেন সংগঠনের নেতাকর্মীরা। সোমবার রাত ১২টা থেকে ভোর ৪টা পর্যন্ত শতাধিক নেতাকর্মী এ তাণ্ডবে অংশ নেন। এ ঘটনায় তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে হল প্রশাসন।
অভিযোগ উঠেছে- হলের কক্ষ দখলকে সামনে রেখে এ তাণ্ডব চালানো হলেও এর নেপথ্যে ছিল সম্প্রতি হলের দুটি পদে নিয়োগ বাণিজ্য এবং হলের ক্যান্টিন ও দোকান থেকে চাঁদা আদায়ের ঘটনা।
এ বিষয়ে হল প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. এজেডএম শফিউল আলম ভূঁইয়া যুগান্তরকে বলেন, ‘এটি অত্যন্ত নিন্দনীয় একটি ঘটনা। হল প্রাধ্যক্ষের কক্ষ ভাংচুর এবং রুমে রুমে বিনা অনুমতিতে ছাত্র পাঠানো কোনোভাবেই মেনে নেয়া হবে না। এ ঘটনায় ড. আসিফ হোসেন খানকে প্রধান করে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে পাঁচ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।’ তিনি বলেন, সাংবাদিক মারধরের ঘটনায় জড়িতদেরও খুঁজে বের করা হবে। প্রত্যেকটি ঘটনায় জড়িতদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ঘটনার সূত্রপাত সোমবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে। পূর্ব পরিকল্পনার অংশ হিসেবে হলের পদ্মা ও যমুনা ব্লকের অন্তত অর্ধশত কক্ষের নিয়ন্ত্রণ নিতে ছাত্রলীগ দলীয় নেতাকর্মীদের পাঠায়। এ সময় তারা শতাধিক নেতাকর্মীকে হলের বিভিন্ন কক্ষে তুলে দেয়। তবে বেশ কয়েকটি কক্ষে তারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদের মুখে পড়ে। ফলে এসব কক্ষে কাউকে ওঠাতে পারেনি। এদিকে গভীর রাতে হলের বিভিন্ন কক্ষের নিয়ন্ত্রণ নিতে গেলে হলে ব্যাপক শোরগোল সৃষ্টি হয়। ফলে ঘুমন্ত সাধারণ শিক্ষার্থীরা হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। ঘটনার রাতে হল প্রাধ্যক্ষ একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের টকশোতে ছিলেন। সে বিষয়টি মাথায় রেখেই ছাত্রলীগ কক্ষ দখলের পরিকল্পনা করে বলে মনে করছে হল প্রশাসন। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে প্রাধ্যক্ষের অনুপস্থিতিতে হলের আবাসিক শিক্ষকরা বিভিন্ন ব্লকে যান। সাধারণ শিক্ষার্থীরা এ সময় তাদের কাছে কক্ষ দখলের অভিযোগ করেন। কর্তব্যরত শিক্ষকরা দখলে বাধা দিতে গেলে শিক্ষকদের সঙ্গেও তারা খারাপ আচরণ করেন। শিক্ষকদের ভয় দেখানোর জন্য তারা দফায় দফায় ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ‘নাটক’ করেন। এ সময় ছাত্রলীগ নেতারা জাহিদুল ইসলাম সানা নামের এক শিক্ষককে ‘শিবির’ আখ্যায়িত করার চেষ্টা চালান। অথচ খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওই শিক্ষক ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন। অবশ্য এর আগে ওই শিক্ষক ছাত্রলীগ নেতাদের ‘শিবির’ বলে অবহিত করেন। ছাত্রলীগ নেতাদের দাবি- তিনি কয়েকজন সাধারণ ছাত্রের জামার কলার ধরে টানতে টানতে নিয়ে যান। ফলে শিক্ষার্থীরা তার ওপর ক্ষুব্ধ হন।
এদিকে রাত সোয়া ১টার দিকে হলে আসেন প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. এজেডএম শফিউল আলম ভূঁইয়া। তিনি নিজ কক্ষে থেকে হলের সিসিটিভির মাধ্যমে পুরো ঘটনা পর্যবেক্ষণ করেন। এ সময় তার সঙ্গে হলের আবাসিক শিক্ষক এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমের কর্মীরাও উপস্থিত ছিলেন। এর কিছুক্ষণ পরেই ছাত্রলীগের কর্মীরা প্রাধ্যক্ষের কক্ষে হামলা চালায়। এ সময় তারা প্রাধ্যক্ষের কক্ষের জানালার কাচ ভাংচুর করেন। এর কিছু সময় পর প্রাধ্যক্ষের কক্ষে আসেন ঢাবি ছাত্রলীগের সভাপতি আবিদ আল হাসান। তিনি ছাত্রলীগের হল সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে প্রাধ্যক্ষের অফিসে ডেকে পাঠান। তারা এসে বলেন, শিক্ষার্থীদের থাকার জায়গা নেই, তাই তারা থাকার ব্যবস্থার দাবিতে এ আন্দোলন করেছেন।’
এদিকে হল প্রশাসন ঢাবি ছাত্রলীগের সভাপতির উপস্থিতিতে দখল নেয়া রুমগুলো ছেড়ে দিতে বলে। রাত সাড়ে ৩টা পর্যন্ত সব কটি কক্ষ দখলমুক্ত হয়েছে এমনটি প্রশাসন ও ছাত্রলীগ কেউ নিশ্চিত করতে পারেনি। তবে দু’পক্ষই জানায়, দখলকৃত কক্ষসমূহ থেকে নেতাকর্মীদের সরানো হচ্ছে।
পরে হল প্রাধ্যক্ষের আনুষ্ঠানিক ব্রিফিং নিয়ে সাংবাদিকরা প্রাধ্যক্ষের কক্ষ ত্যাগ করেন। এর মধ্যে উচ্ছৃংখল ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা দফায় দফায় সাংবাদিকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। সর্বশেষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির নেতারা যখন বিজয় একাত্তর হল প্রাঙ্গণ ত্যাগ করেন, তখন বার্তা সংস্থা ইউএনবির বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক ইমরান হোসাইনের ওপর অতর্কিত হামলা চালান তারা। ১০-১৫ জন এ হামলায় অংশ নেন। যাতে ইমরান হামলাকারীদের চিনতে না পারেন সে জন্য তারা লাইট বন্ধ করে দেন। পরে আহত অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে সেখানে তিনি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন। প্রায় চার ঘণ্টা পর জ্ঞান ফিরলে তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারে ভর্তি করা হয়। এদিকে সিট দখল সামনে রেখে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা হামলায় অংশ নিলেও এ ঘটনার নেপথ্যে হলের দুটি নিয়োগ বাণিজ্য এবং একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোর ও ক্যান্টিন থেকে চাঁদা আদায়ের ঘটনা রয়েছে বলে অভিযোগ করছেন সংশ্লিষ্টরা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হলের এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ‘সম্প্রতি হলের সহকারী লাইব্রেরিয়ান ও সহকারী মুয়াজ্জিন পদে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়। ছাত্রলীগ এ দুটি পদে তাদের নিজস্ব লোক বসাতে চায়। কিন্তু হল প্রশাসন মেধার বাইরে গিয়ে নিয়োগ দিতে অস্বীকৃতি জানায়। ফলে তখন থেকেই হলে ঝামেলা সৃষ্টির পাঁয়তারা করে ছাত্রলীগ। এ ছাড়া হলের ক্যান্টিন ও একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকে এককালীন বড় অংকের চাঁদা এবং মাসিক অর্ধলক্ষ টাকা দাবি করেন তারা।’ বিষয়টি প্রাধ্যক্ষের নজরে এলে তিনি তাতে বাধা দেন। এর জের ধরে ঘটনাটি ঘটানো হতে পারে বলে ধারণা করছেন একাধিক শিক্ষক। তবে হল ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত কেউ এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশ করে বক্তব্য দিতে রাজি হননি। ঘটনার বিষয়ে হল ছাত্রলীগের সভাপতি ফকির রাসেল যুগান্তরকে বলেন, সাধারণ ছাত্ররা থাকার জায়গা না পেয়ে বিক্ষোভ করেছেন। ছাত্রলীগ এর সঙ্গে জড়িত নয়। সাধারণ সম্পাদক নয়ন হাওলাদার বলেন, ‘ঘটনার সময় আমি ও হল সভাপতি হলে ছিলাম না। ছাত্রদের বিক্ষোভের খবর পেয়ে হলে এসে আমরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনি।’ ঢাবি ছাত্রলীগের সভাপতি আবিদ আল হাসান বলেন, এ ঘটনার সঙ্গে ছাত্রলীগের কেউ জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর অধ্যাপক ড. এম আমজাদ আলী বলেন, সাংবাদিক মারধর, প্রাধ্যক্ষ কক্ষ ভাংচুরের ঘটনায় যারাই জড়িত তাদের বিরুদ্ধে একাডেমিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। জড়িতদের কেউ পার পাবে না।

http://www.jugantor.com/first-page/2017/03/15/109102