১৫ মার্চ ২০১৭, বুধবার, ১২:০৭

অবৈধ ওষুধ-সরঞ্জাম বিক্রি ও বিজ্ঞাপন

হাজার হাজার মানুষ প্রতারণার শিকার

মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে জালিয়াত চক্র * নিরাময়ের পরিবর্তে জটিল রোগে আক্রান্তের আশংকা * নির্বিকার প্রশাসন
আইনত নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও নির্বিঘ্নে চলছে ওষুধ অথবা চিকিৎসা সম্পর্কিত পণ্যের বিজ্ঞাপন। বেশ কয়েকটি দেশী-বিদেশী বেসরকারি টিভি চ্যানেল প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ মিনিট সম্প্রচার করছে অনিবন্ধিত ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জামের বিজ্ঞাপন। শরীরের জটিল ও কঠিন সমস্যা সমাধানে নানা ধরনের চাকচিক্য বিজ্ঞাপনের ফাঁদে পা দিয়ে প্রতারিত হচ্ছেন অসংখ্য নিরীহ মানুষ।

পাশাপাশি ক্যালসিয়াম, আয়রনসহ বিভিন্ন ওষুধের নামে রাজধানীসহ দেশের বাজারে গোপনে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে ওষুধসদৃশ্য পণ্য। কতিপয় চিকিৎসককে ‘ম্যানেজ’ করে চিকিৎসা ব্যবস্থাপত্রেও এসব ভুয়া ওষুধের নাম লিখিয়ে নিচ্ছেন বিপণনকারীরা। শুধু তাই নয়, বহুল ব্যবহৃত বেশ কিছু ওষুধের মোড়ক ও প্যাকেট হুবহু নকল করে বিক্রি হচ্ছে ভেজাল ওষুধ। এমনকি কাগজপত্রে অন্য পণ্যের নাম ঘোষণা দিয়ে আমদানি করা হয় জীবণ রক্ষাকারী ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম। এছাড়া রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায় সময়ই আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী সন্ধান পাচ্ছে নকল ওষুধের কারখানা। এসব কারখানায় তৈরি হয় হৃদরোগ, ক্যান্সার, ডায়বেটিস, উচ্চরক্তচাপ ও যৌন-উত্তেজকসহ বিভিন্ন ধরনের ভেজাল ওষুধ।

আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন ও বিপণনকারীদের ফাঁদে পা দিয়ে তাদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে জালিয়াত চক্র। পাশাপাশি এসব ভেজাল ওষুধ সেবন ও অনিবন্ধিত চিকিৎসা সরঞ্জাম ব্যবহার মানবদেহের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। এমনকি হেপাটাইটিস বি ও সি, এইচআইভির মতো প্রাণঘাতী রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশংকা থাকে বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সম্প্রতি দেশের বেশ কিছু বেসরকারি টিভি চ্যানেলে মেদভুঁড়ি কমিয়ে শরীরকে স্লিম করার বেল্টসহ কিছু ওষুধের বিজ্ঞাপন দেখানো হচ্ছে। সেখানে বলা হচ্ছে, মোটা শরীর চিকন আর চিকন শরীর মোটা হবে, লম্বা শরীর খাটো আর খাটো শরীর লম্বা হবে। শুধু তাই নয়, ডায়াবেটিসের মতো জীবনব্যাপী রোগও এক মাসের ওষুধ সেবনে চিরতরে কমানো যায় বলে এসব বিজ্ঞাপনে প্রচার করা হয়। অন্যদিকে ফুড সাপ্লিমেন্ট, স্কিন সাপ্লিমেন্ট ইত্যাদি নামে ওষুধসদৃশ পণ্য অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ করছে তথাকথিক আরেকটি চক্র। পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতাল এলাকায়, ক্যান্টনমেন্ট কচুক্ষেত মার্কেট, শাহবাগ আজিজ সুপার মার্কেট, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকা ও সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল এলাকায় বিভিন্ন ফার্মেসিতে এসব ভুয়া ওষুধ সরবরাহ করা হচ্ছে।

সুয়েট স্লিম বেল্ট : দেশী-বিদেশী বেশ কয়েকটি চ্যানেলে দীর্ঘদিন ধরে সম্প্রচার হচ্ছে সুয়েট স্লিম বেল্টের বিজ্ঞাপন। এর মূল্য ২৯৯০ টাকা। প্রায় ১৫ মিনিটব্যাপী বিজ্ঞাপনে অনেক মোটা নারী-পুরুষ দেখানো হয়, যারা বেল্ট পরার পর ৫ মিনিটেই একেবারে স্লিম হয়ে গেছেন। বেল্ট পেতে টিভি স্ক্রিনে দেশের সব মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানির একাধিক নম্বর দেখানো হয়। আর বিজ্ঞাপনে দেয়া মোবাইল ফোন নম্বরে তাৎক্ষণিকভাবে যোগাযোগ করলে একটি বেল্টের সঙ্গে আরেকটা ফ্রি দেয়ার অফারও রয়েছে।

সুয়েট স্লিম বেল্ট প্রসঙ্গে জানতে টিভি চ্যানেলে দেয়া মোবাইল ফোন নম্বরে ডায়াল করা হলে প্রিন্স নামের এক ব্যক্তি যুগান্তরকে বলেন, টিভি বিজ্ঞাপনে যা বলা হয়, সে তাই জানে। ওষুধ প্রশাসনের অনুমোদন আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এসব বিষয়ে তার জানা নেই। তবে বিজ্ঞাপনের কারণে বেল্ট ভালো বিক্রি হচ্ছে। কোন কোন চ্যানেলে বিজ্ঞাপন চলছে জানতে চাইলে তিনি জানান, এশিয়ান টিভি, চ্যানেল নাইন, মোহনা টিভিসহ বেশ কয়েকটি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন দেয়া হয়। পর্যায়ক্রমে দেশের সব চ্যানেলেই বিজ্ঞাপন দেয়া হবে বলেও জানান তিনি।

ডা. মধু অমৃত : ডা. মধু অমৃত নামে একটি ওষুধের বিজ্ঞাপন চলছে বাংলাদেশ প্রদর্শিত হিন্দি ও বাংলাসহ কয়েকটি টিভি চ্যানেলে। এর মূল্য ৫ হাজার ২০০ টাকা। ১৫ থেকে ২০ মিনিট দৈর্ঘ্যরে এই বিজ্ঞাপন প্রদর্শনের সময় বাংলাদেশে ওষুধটি পেতে বেশ কয়েকটি মোবাইল ফোন নম্বর টিভি স্ক্রিনে ভেসে ওঠে। বিজ্ঞাপনে বলা হয়, ৩০টি গাছের নির্যাসে তৈরি এই ওষুধ এক মাস খেলে ডায়াবেটিস রোগ সম্পূর্ণ নিরাময় হয়ে যাবে। এর কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই।

এক মাস ওষুধ খেয়ে ডায়াবেটিস নিরাময় সম্ভব কিনা জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শাহজাদা সেলিম যুগান্তরকে বলেন, পৃথিবীতে এখনও এমন কোনো প্রযুক্তি আবিষ্কার হয়নি যে, ওষুধ খেলে ডায়াবেটিস নিরাময় সম্ভব। এসব বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে জনগণকে প্রতারিত করা হচ্ছে। তিনি দেশের মানুষকে এসব বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট না হতে পরামর্শ দেন।

বডি মাস জিনার : শরীর মোটা, লম্বা ও স্বাস্থ্যবান করতে এই ওষুধের বিজ্ঞাপন দেয়া হয়। প্রতিদিন দীর্ঘ সময় ধরে বিভিন্ন ভারতীয় চ্যানেলে চলে এই বিজ্ঞাপন। ওষুধটির দাম ১৭৯০ টাকা। বিজ্ঞাপনে বলা হয়, প্রতিদিন দুধের সঙ্গে মিশিয়ে দু’চামচ বডি মাস জিনার খেলে রোগা মানুষের শরীর মোটা ও স্বাস্থ্যবান হয়ে উঠবে। বিজ্ঞাপনে বলা হয়, এই ওষুধ শরীরে খুদা বাড়ানোর হরমন তৈরি করে। এছাড়া শরীরে রক্ত চলাচল ঠিক করে। কয়েকদিন ব্যবহারে এর ফল পাওয়া যাবে। প্রতিটি ওষুধের বিজ্ঞাপনে একাধিক মডেল থাকেন। যারা এসব ওষুধ সেবনে কি ধরনের জাদুকরী উপকার পেয়েছেন, তাদের বক্তব্য নানাভাবে উপস্থাপন করা হয় বিজ্ঞাপনে।

বডি মাস জিনার প্রসঙ্গে জানতে বিজ্ঞাপনে দেয়া ফোন নম্বরে ডায়াল করলে ওই কোম্পানিতে চাকরি করেন দাবি করে এক ব্যক্তি বলেন, এসব ওষুধের বৈধতা ওষুধ প্রশাসন দেয় না। এসব অবৈধ ওষুধ বিজ্ঞাপন দিয়ে কেন মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করা হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, আমাদের ক্ষমতা আছে তাই করছি, আপনি পারলে ঠেকান।

গ্রোথ অন : অন্য ওষুধগুলোর মতো দেশী ও ভারতীয় বেশ কয়েকটি টিভি চ্যানেলে গ্রোথ অন নামের একটি ওষুধের বিজ্ঞাপন দেখানো হয়। এই ওষুধ সেবনে যে কোনো মানুষ তার কাক্সিক্ষত শারীরিক দৈর্ঘ্য পাবেন। ২৯৯০ টাকা দামের এই ওষুধ রাতে ঘুমানোর সময় এক গ্লাস পানিতে গুলিয়ে খেতে হবে। যে কোনো বয়সের বেঁটে মানুষই এই ওষুধ খেলে লম্বা হয়ে উঠবেন বলে প্রচার করা হচ্ছে।

ডা. মধু অমৃত ও গ্রোথ অন সম্পর্কে জানতে নির্ধারিত ফোন নম্বরে পৃথকভাবে যোগাযোগ করা হলে দুই স্থান থেকেই বল হয়, ওষুধ বিক্রি ছাড়া অন্য প্রসঙ্গে কথা বলতে বাধ্য নয়। এর পরপরই ফোনের সংযোগ কেটে দেয়।

ডিজায়ার ফোর্ট : গভীর রাতে, মধ্যদুপুরে কয়েকটি টিভি চ্যানেলে সম্প্রচার করা হয় ডিজায়ার ফোর্ট নামের যৌন উত্তেজক এই ওষুধের বিজ্ঞাপন। দীর্ঘ সময় নিয়ে বিজ্ঞাপনের নামে সংশ্লিষ্ট চ্যানেলগুলোতে দেখানো হয় এক ধরনের পর্নোদৃশ্য। পাশাপাশি আবহ সঙ্গীতের মতো ভেসে আসে বেডরুমে হিরো বানানোর রগরগে গল্প। এই ওষুধের মূল্য ৩৬০০ টাকা। বিজ্ঞাপনে দেয়া মোবাইল ফোন নম্বরে যোগাযোগ করা হলে বাড়িতে পৌঁছে দেয়া হবে বলে বিজ্ঞাপনে জানানো হয়।

উল্লিখিত ওষুধের কার্যকারিতা সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক যুগান্তরকে বলেন, এগুলো কোনো ওষুধ নয়। সে ফ প্রতারণার মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে ঠকিয়ে একটি গ্রুপ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। তিনি বলেন, বিজ্ঞাপনে যেসব তথ্য দেয়া হয়, তা শুধু অবৈজ্ঞানিকই নয়, উদ্ভটও বটে।

তিনি আরও বলেন, ১৯৮২ সালের ওষুধ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ, ১৯৯৭-এর সংশোধনী এবং ২০১৬-এর ওষুধনীতি অনুযায়ী যারা বিজ্ঞাপন দিচ্ছে এবং যারা দেখাচ্ছে উভয়ের একাধিক কারণে সাজা হতে পারে। কারণ এসব বিজ্ঞাপনে দুটি অপরাধ করা হচ্ছে। প্রথমত, বিজ্ঞাপনে সরকারের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে; দ্বিতীয়ত, এসব ওষুধ অনিবন্ধিত অর্থৎ অবৈধ।

এ ধরনের বেল্টের কার্যকারিতা সম্পর্কে জানতে চাইলে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, শরীরের স্থূলতা কমানোর সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। শীরের স্থূলতা কমাতে হলে আগে পরীক্ষা করে দেখতে হবে স্থূলতার কারণ কী। তারপর সেই অনুযায়ী চিকিৎসা নিতে হবে। ওষুধ খেয়ে লম্বা হওয়া, মোট হওয়া ইত্যাদি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এসব বলে যারা ওষুধ বিক্রি করছে, তাদের কাছে এসবের পক্ষে কোনো বৈজ্ঞানিক তথ্য নেই। এগুলো প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়।

টিভি চ্যানেলের বক্তব্য : আইনি বাধ্যবাধকতার পরেও টিভি চ্যানেলে এসব বিজ্ঞাপন কেন প্রচার করা হচ্ছে জানতে চাইলে এশিয়ান টিভির মার্কেটিং বিভাগের ডিজিএম যুগান্তরকে বলেন, আইনি বাধ্যবাধকতার বিষয়টি তার জানা নেই। তা ছাড়া অন্য অনেক টিভিতে এ ধরনের বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়। একই প্রসঙ্গে চ্যানেল নাইনের প্রশাসন বিভাগের কর্মকর্তা বাসার যুগান্তরকে বলেন, চ্যানেলের নিয়মানুযায়ী বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়। মোহনা টিভি চ্যানেলে মহাব্যবস্থাপক (মার্কেটিং) মো. তসলিম বলেন, তার টিভিতে সোয়েট স্লিম বেল্টের বিজ্ঞাপন সম্প্রচার করা হতো। সম্প্রতি এটি বন্ধ করা হয়েছে।

বিভিন্ন চ্যানেলে বিজ্ঞাপন প্রসঙ্গে তথ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. নাসির উদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, এ ধরনের বিজ্ঞাপন প্রচারে বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ ধরনের বিজ্ঞাপন আমাদের নজরে এলে বা কোনো মাধ্যমে জানতে পারলে মন্ত্রণালয় সেটা বন্ধের ব্যবস্থা করে থাকে। এর আগেও সন্ধিসুধাসহ বিভিন্ন বিজ্ঞাপন বন্ধ করা হয়েছিল।

আমদানির নামে অবৈধ ওষুধ উৎপাদন ও বিপণন : ওষুধ আমদানিকারক ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান অরুআ ফার্মা। শুধু ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের ট্রেড লাইসেন্স দিয়েই চলছে এ প্রতিষ্ঠান। তবে ট্রেড লাইন্সেসে দেয়া (৫৫০, মনিপুর, মিরপুর, ঢাকা-১২১৬) ঠিকানা ও পণ্যের বিক্রয় রসিদে দেয়া (৫৮, কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, ঢাকা-১২১৫) ঠিকানা অনুসারে সরেজমিন গিয়ে এ প্রতিষ্ঠানের কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। অরুআ ফার্মার আমদানি করা পণ্যের মধ্যে রয়েছে- ট্যাবলেট ম্যাসোন-সিপি, ক্যাপসুল লিক্যাল-সি, কনসোল শ্যাম্পু, নিয়ার সান লোশন ও নি-অল লোশন। প্রতিষ্ঠানটির সরবরাহ করা ফুড সাপলিমেন্ট কোনো পণ্যের গায়েই নেই ডিএআর (ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন রেজিস্ট্রেশন) নম্বর। এ ছাড়া স্কিন সাপলিমেন্টের (ত্বকের যত্নের ওষুধ) কোনো পণ্যেরই নেই বিএসটিআইয়ের অনুমোদন।

এ সব বিষয়ে জানতে চাইলে অরুআ ফার্মার কর্ণধার মো. ইলিয়াচুর রহমান গত ১১ জানুয়ারি যুগান্তরকে বলেন, তিনি গ্রামের বাড়ি আছেন, পরে কথা বলবেন। এরপর ১৩ জানুয়ারি এ প্রতিবেদককে দেখা করার অনুরোধ জানান তিনি। তার দেয়া নির্ধারিত স্থানে এই প্রতিবেদক উপস্থিত হলেও তিনি সেখানে আসেননি। ১৫ জানুয়ারি বারবার তাকে ফোন করলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। এরপর ফোনে ১৭ জানুয়ারি এসব বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি আপনার সঙ্গে দেখা করব না, আপনার কোনো প্রশ্নের উত্তরও দেব না। আপনি যদি পারেন তাহলে আমাকে খুঁজে বের করুন।’

এ ছাড়া ভারতের চেন্নাই কুভাদাবার ইলিগেন্ট ইন্টারন্যাশনাল কোম্পানি থেকে ওষুধ আমদানি করে দেশে বাজারজাত করছে ক্রিসেন্ট ফার্মা ঢাকা বাংলাদেশ। এই প্রতিষ্ঠানের আমদানি করা ফুড সাপলিমেন্ট পণ্যের মধ্যে রয়েছে ক্যাপসুল রিবন প্লাস, পল-ভিস, এনপিএইচ, ক্যাপসুল অ্যাপ্রোডেক্স (সেক্স স্টিমুলেন্ট ক্যাপসুল), ট্যাবলেট কন্ডোফ্লেক্স, ক্যাপসুল প্রলিন, ক্যাপসুল জিবি-প্লাস, ক্যাপসুল টিপি-কোর, ক্যাপসুল কন্ডো-এম, ক্যাপসুল ভিসকোর ও ক্যাপসুল এইচএনএস কেয়ার। আর স্কিন সাপলিমেন্ট পণ্যের মধ্যে রয়েছে- সোপ একনিগার্ড, শ্যাম্পু সেবুদান, ক্রিম কিটোসাইট ও ক্রিম রেটিসনেট-এইচএম। এ প্রতিষ্ঠানেরও সরবরাহ করা ফুড সাপলিমেন্ট পণ্যের গায়ে নেই ডিএআর নম্বর। এ ছাড়া স্কিন সাপলিমেন্ট পণ্যের নেই বিএসটিআইয়ের অনুমোদন।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ১১ জানুয়ারি ক্রিসেন্ট ফার্মার স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ মাহমুদুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, এক বড় ভাইয়ের মাধ্যমে ওষুধ আমদানি করা হয়। কে এই বড় ভাই, তিনি প্রতিষ্ঠানের কোন দায়িত্ব পালন করেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, বড় ভাই এ প্রতিষ্ঠানের (ক্রিসেন্ট ফার্মা) কোনো পদে নেই। তবে ওই বড় ভাইয়ের কোনো পরিচয় তিনি প্রকাশ করেননি। এই বড় ভাই বিভিন্ন কোম্পানির ওষুধ আমদানি করে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে সরবরাহ করে থাকেন বলেও জানান তিনি।

পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক এই ব্যবসা সংশ্লিষ্ট একজন যুগান্তরকে বলেন, ভিটামিন ও যৌন উত্তেজক জাতীয় ওষুধগুলো বড় ভাইদের কাছ থেকে এসব কোম্পানির মালিকরা ৫০ থেকে ৬০ টাকায় কিনে থাকেন। আর বিক্রি করা হয় ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায়। দেশের প্রতিষ্ঠিত কয়েকটি ওষুধ কোম্পানির রিপ্রেজেন্টেটিভরা জানান, এ ধরনের ওষুধ যারা বিক্রি করেন তারা ‘ডিব্বা কোম্পানি’ নামে পরিচিত। এদের একটি ওষুধ কোনো ডাক্তার ব্যবস্থাপত্রে লিখলে বা দোকানি বিক্রি করলে মোটা অংকের কমিশন দেয়া হয়। তাই অনেকে এসব ওষুধ ব্যবস্থাপত্রে লিখতে পছন্দ করেন।

ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, বিজ্ঞাপন দেয়া গ্রোথ অন, বডি মাস জিনার, ডা. মধু অমৃত, সুয়েট স্লিম বেল্ট- এগুলোর কোনোটিই নিবন্ধিত নয়। এ ছাড়া শুধু অরুআ ফার্মা কিংবা ক্রিসেন্ট ফার্মাই নয়, স্ট্যান্ডার্ট হেলথ কেয়ার বাংলাদেশ, নিওভেনটিস লিমিটেডের মতো আরও বহু কোম্পানি একইভাবে প্রতারণার মাধ্যমে ব্যবসা করছে। ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের ইমপোর্টেট কোম্পানির তালিকায় নাম নেই এসব দেশীয় কোম্পানির। এমনকি তারা বিদেশী যেসব কোম্পানি থেকে ওষুধ আমদানি করছে বলে প্রচার করছেন- সেসব বিদেশী কোম্পানিরও নাম নেই ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের অনুমোদিত ইমপোর্টেট ম্যানুফেকচারার কোম্পানির তালিকায়। এ ছাড়া নিবন্ধনের জন্য বা এসবের বিজ্ঞাপনের জন্য এখনও পর্যন্ত কোনো আবেদন করা হয়নি।

ওষুধের নামে এসব পণ্য শরীরে কী ধরনের ক্ষতি করতে পারে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. লুৎফুল কবীর যুগান্তরকে বলেন, ওষুধের উপাদানের মিশ্রণে যদি কম-বেশি হয়ে থাকে তাহলে তা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। এতে রোগ কমার পরিবর্তে আরও বেড়ে যেতে পারে। অন্য দিকে ওষুধের মূল উপাদানের পরিবর্তে যদি আটা-ময়দা-সুজি ব্যবহার করা হয় তাহলে সে ওষুধ রোগীর কোনো কাজেই আসবে না। এ ধরনের ওষুধ সেবনে রোগীর শরীরে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা না গেলেও রোগ নিরাময় হবে না। বরং তা দীর্ঘমেয়াদি রূপ ধারণ করবে।

জানতে চাইলে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের তত্ত্বাবধায়ক সৈকত কুমার কর যুগান্তরকে বলেন, ড্রাগ অ্যাক্ট বা ওষুধ নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৮২ সুস্পষ্টভাবে ওষুধের বিজ্ঞাপন প্রচারের বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এ ছাড়া ওষুধনীতি ২০১৬ অনুযায়ী এসব বিজ্ঞাপন প্রচারের সুযোগ নেই। তিনি বলেন, যেহেতু এসব ওষুধের নিবন্ধন নিতে বা বিজ্ঞাপন প্রচারের জন্য কেউ অনুমতি নিতে আসেনি, তাই এসব বিজ্ঞাপনের বিষয়ে আমাদের জানা নেই। তিনি বলেন, টিভি চ্যানেলে প্রদর্শিত বিজ্ঞাপন বন্ধে আমাদের কিছুই করণীয় নেই। এ ধরনের বিজ্ঞাপন বন্ধে তথ্য মন্ত্রণালয়কে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। অপর দিকে অনিবন্ধিত ওষুধ বিপণন সম্পর্কে তিনি বলেন, এসব ওষুধ বিপণনকারীদের ধরতে নিয়মিত অভিযান পরিচালিত হয়।

http://www.jugantor.com/first-page/2017/03/15/109098