১৫ মার্চ ২০১৭, বুধবার, ১১:৫৯

সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান

গভীর সমুদ্রের ১২ নম্বর ব্লক দরপত্র ছাড়াই ইজারা

দরপত্র ছাড়াই ইজারা দেয়া হলো গভীর সমুদ্রের ১২ নম্বর গ্যাসব্লক। গতকাল এই ব্লকে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য দক্ষিণ কোরিয়াভিত্তিক কোম্পানি দাইয়ুর সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে পেট্রোবাংলা ও জ্বালানি বিভাগ। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি আইন (বিশেষ আইন) ২০১০ অনুযায়ী এ চুক্তি করা হয়েছে বলে জ্বালানি মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। এ চুক্তির ফলে চলতি অর্থবছরের মধ্যে ৩ হাজার ৫৬০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই গ্যাসব্লকের ভূতাত্ত্বিক জরিপ শুরু করা যাবে এবং ২০১৯ সালের প্রথম নাগাদ জরিপের ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে এ ব্লকে তেল, গ্যাসের প্রাপ্যতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে বলে জ্বালানি মন্ত্রণালয় আশাবাদ ব্যক্ত করেছে।
চুক্তিতে গ্যাস বিদেশে রফতানির সুযোগ রাখা হয়েছে। অনুষ্ঠানে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান আবুল মনসুর মো: ফয়জুল্লাহ জানান, এই ব্লকে গ্যাস পাওয়া গেলে দাইয়ু তার অংশের গ্যাস প্রথমে পেট্রোবাংলার কাছে বিক্রির প্রস্তাব দেবে। পেট্রোবাংলা রাজি না হলে তারা দেশের মধ্যে তৃতীয় পক্ষের কাছে বিক্রির চেষ্টা করবে, না পারলে গ্যাস তরল করে এলএনজি আকারে বিদেশে রফতানি করতে পারবে।
জানা গেছে, গভীর সমুদ্রের ১২ নম্বর ব্লকের পাশেই মিয়ানমারের একটি গ্যাসব্লক থেকে গ্যাস উত্তোলন করছে দাইয়ু। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মিয়ানমার ও বাংলাদেশ উভয়ের সমুদ্রতলের ভূতাত্ত্বিক গঠন প্রায় একই রকম। ফলে বাংলাদেশের সমুদ্র ব্লকটিতেও বিশাল গ্যাস-ভাণ্ডার রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আর এটা হলে গভীর সমুদ্রে গ্যাস উত্তোলনে বড় ধরনের সাফল্য আসতে পারে।
জ্বালানি মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ মেটার পর সাগরে জোরালো অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরুর কথা থাকলেও আদতে তা হয়নি। মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ মেটে ২০১২ সালে এবং ভারতের সঙ্গে ২০১৪ সালে। বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে প্রতিবেশী মিয়ানমার ও ভারত অনেক দূর এগিয়েছে। মিয়ানমারের সমুদ্রসীমায় ইতোমধ্যে চারটি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার হয়েছে। বঙ্গোপসাগরের ভারতীয় অংশেও বড় ধরনের গ্যাসের মজুদ রয়েছে বলে জানিয়েছে সেখানে অনুসন্ধানরত বহুজাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানিগুলো। একই ভূ-কাঠামোর অন্তর্গত হলেও বাংলাদেশ তার সমুদ্রসীমায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে এখনো উল্লেখযোগ্য কোনো কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি।
সাগরের ২৬টি ব্লকের মধ্যে শুধু অগভীর সমুদ্রের দুইটি ব্লকে একটি ভারতীয় কোম্পানি তাদের প্রাথমিক কার্যক্রম শুরু করেছে। এ চুক্তির ফলে দীর্ঘ দিন পরে হলেও সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
গতকাল মঙ্গলবার পেট্রো সেন্টারে এই চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জ্বালানি সচিব নাজিম উদ্দিন বলেন, সমুদ্রে তেল-গ্যাসের তথ্য-উপাত্ত জানতে প্রস্তাবিত মাল্টি কায়েন্ট সার্ভে শুরু হতে সময় ক্ষেপণ হয়েছে এটা ঠিক; তবে এখন বিষয়টি চূড়ান্তপর্যায়ে আছে। শিগগিরই একটি বিদেশী কোম্পানিকে এ জন্য নিয়োগ দেয়া হতে পারে। পাশাপাশি বাংলাদেশ নিজেও একটি অনুসন্ধান জাহাজ সংগ্রহের প্রক্রিয়া চালাচ্ছে।
অপর এক প্রশ্নের উত্তরে জ্বালানি উপদেষ্টা বলেন, স্থলভাগে বাংলাদেশ নিজেই তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম চালাবে, সে সক্ষমতা বাপেক্সের আছে। বিদেশী কোম্পানিকে আমন্ত্রণ জানানোর প্রয়োজন নেই।
বঙ্গোপসাগরের গভীর সমুদ্রাঞ্চলে ব্লক-১২, ১৬ ও ২১ থেকে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য গত বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি বিশেষ আইনের আওতায় বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কোম্পানির কাছ থেকে পেট্রোবাংলা আগ্রহপত্র (ইওআই) আহ্বান করে। নরওয়েভিত্তিক বহুজাতিক কোম্পানি স্টেট অয়েল, সিঙ্গাপুরভিত্তিক ক্রিস এনার্জি ও দক্ষিণ কোরিয়াভিত্তিক দাইয়ু এ তিনটি ব্লকে অনুসন্ধান করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। এরপর পেট্রোবাংলা তাদেরকে প্রস্তাব জমা দিতে বলে। প্রথমে স্টেট অয়েল কয়েক দফা যোগাযোগের পর প্রস্তাব জমা দেয়ার জন্য সময় চায়। পরে তারা আগ্রহপত্র জমা দেয়। কিন্তু গ্যাসব্লক থেকে উৎপাদিত গ্যাসের মূল্য নিয়ে বনিবনা না হওয়ায় পিছু হটে স্টেট অয়েল।
এরপর দাইয়ু আগ্রহপত্র জমা দেয়। পেট্রোবাংলা ও দাইয়ু আলোচনায় একমত হওয়ায় গত ৯ অক্টোবর দাইয়ুর সাথে অনুস্বাক্ষর অনুমোদন করে মন্ত্রণালয়। গত ৭ ডিসেম্বর দাইয়ুর সাথে অনুস্বাক্ষর করে পেট্রোবাংলা। গতকাল করা হয় চূড়ান্ত চুক্তি ।
প্রথমে দাইয়ুর সাথে আলোচনা হয়, মডেল পিএসসি অনুযায়ী দাইয়ু প্রথম তিন বছর গ্যাসব্লকের এক হাজার ৮০০ লাইন কিলোমিটার দ্বিমাত্রিক জরিপ এবং পরের দুই বছরে এক হাজার বর্গকিলোমিটার ত্রিমাত্রিক জরিপ করবে। কিন্তু আলোচনায় প্রথম তিন বছরের পরিবর্তে দুই বছরে এক হাজার ৮০০ লাইন কিলোমিটার দ্বিমাত্রিক জরিপ, তৃতীয় বছরে এক হাজার বর্গকিলোমিটার ত্রিমাত্রিক জরিপ এবং চতুর্থ ও পঞ্চম বছরে একটি অনুসন্ধান কূপ খননের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়।
পেট্রোবাংলা আশা করছে, এ চুক্তির ফলে চলতি অর্থবছরের মধ্যে ভূমাত্রিক জরিপ শুরু করা যাবে এবং ২০১৯ সালের প্রথম নাগাদ জরিপের ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে এ ব্লকে তেল, গ্যাসের প্রাপ্যতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে।
চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে দাইয়ুর প্রেসিডেন্ট ও সিইও ইয়ান সান কিম একই ধরনের আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, দাইয়ু মিয়ানমারে কাজের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশেও অনুসন্ধান কার্যক্রম চালাবে। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেন, দাইয়ু যেহেতু পাশের ব্লকেই কাজ করছে, তাই তারা চাইলে ওই অংশের তথ্য-উপাত্ত পেট্রেবাংলার সঙ্গে শেয়ার করতে পারে। এতে অনুসন্ধান কার্যক্রমে সাফল্যের সম্ভাবনা বাড়বে।
অনুষ্ঠানে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, অনেক দিন পর হলেও সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধানের চুক্তি করা সম্ভব হলো। তিনি বলেন, আমাদের পোশাক শিল্প বছরে ৫০ বিলিয়ন ডলার আয় করছে, তাদের গ্যাস লাগবে। ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল হচ্ছে, তাদেরও গ্যাস লাগবে। এ জন্য সমুদ্রে অনুসন্ধানের পাশাপাশি স্থলভাগে আগামী চার বছরে ১০৮টি কূপ খননের পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে। স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এলএনজি আমদানির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন, বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি তাজুল ইসলাম এবং বাংলাদেশে দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত অন সেওং।

www.dailynayadiganta.com/detail/news/203732