মৌচাক থেকে মালিবাগ রেলগেটের দিকে হাঁটা শুরু করলেই রাস্তার বাঁ পাশে পড়ে ফরচুন শপিং মল। আধুনিক এ শপিং মলে ৪৫০টি দোকান রয়েছে। ২০১২ সালে উদ্বোধনের পর ব্যবসাও জমজমাট হতে থাকে। তবে সেসব এখন স্মৃতি। পাঁচ বছরের ব্যবধানে পাল্টে গেছে দৃশ্যপট। এখন শপিং মল থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছেন অনেকে।
কারণ হিসেবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, মগবাজার-মৌচাক-মালিবাগ ফ্লাইওভার নির্মাণের কারণে চলার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে এ এলাকার রাস্তাগুলো। ২০১৩ সালে ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজ শুরুর পর থেকেই ভোগান্তি শুরু। কাজের খাতিরে বাধ্য হয়ে দুর্ভোগ সহ্য করে আশপাশের সড়ক দিয়ে যাতায়াত করলেও লোকজন শপিং মল ও দোকানগুলোতে খুব একটা ঢোকে না। এতে এ এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ব্যবসায়ীরাও তাঁদের প্রতিষ্ঠান গুটিয়ে নিচ্ছেন।
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুধু মৌচাক থেকে মালিবাগ রেলগেট পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশে শ দুয়েক দোকান রয়েছে। দীর্ঘদিন লোকসানে থেকে অনেকে দোকান বন্ধ করে দিয়েছেন। যাঁদের একাধিক দোকান ছিল তাঁরা একটি রেখে বাকিগুলো ছেড়ে দিয়েছেন। ফরচুন শপিং মল থেকেই ৭০ জন তাঁদের দোকান গুটিয়ে নিয়েছেন। এখন যেসব দোকান ফাঁকা রয়েছে সেগুলোও ভাড়া হচ্ছে না দীর্ঘদিন।
শফিকুর রহমানের জয়ন্তি, সুমাইয়া এবং বাঁধন-১ ও বাঁধন-২ এন্টারপ্রাইজ নামের চারটি দোকান ছিল রাস্তার দুই পাশে। কম্বল, ফ্যান, সেলাই মেশিন খুচরা ও পাইকারি বিক্রি করেন তিনি। বললেন, ‘ফ্লাইওভারের কাজ শুরু হওয়ার এক বছরের মধ্যেই রাস্তার অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। এখন তো মানুষ ঠিকমতো যাতায়াতই করতে পারে না। লোকসান টানতে না পেরে গত ডিসেম্বরের দিকে দুটি দোকান ছেড়ে দিয়েছি। এখন কোনো রকমে টিকে রয়েছি। আগে দিনে যেখানে ৩০-৫০ হাজার টাকা বিক্রি হতো এখন তা ছয়-সাত হাজারে নেমে এসেছে।
একই অবস্থার কথা জানালেন টিভি-ফ্রিজ বিক্রির দোকান ন্যাশনাল প্লাসের ম্যানেজার আব্দুর রহিম। বললেন, আগে দিনে এ দোকানে বিক্রি ছিল ৫০ হাজার টাকার ওপরে। আর এখন মাসে বিক্রি হচ্ছে দুই-তিন লাখ টাকা মাত্র। ক্রেতা আসার মতো কোনো পরিস্থিতি না থাকায় এ অবস্থার তৈরি হয়েছে। এ রাস্তায় এত ধুলা ওড়ে যে কেউ ১০ মিনিট থাকলে অসুস্থ হয়ে যাবে।
ইমারতের বিভিন্ন উপকরণ বিক্রি করা সোনিয়া এন্টারপ্রাইজের ম্যানেজার শাহাবুদ্দিন বলেন, ‘বিক্রি নেমে এসেছে তিনের এক ভাগে। আমার দুটি দোকান ছিল, যার একটি ছেড়ে দিয়েছি। ’ ওয়ালটনের টিভি-ফ্রিজের একটি শোরুমে খোঁজ নিয়ে জানা গেলে, তারা প্রতি মাসে লাখ টাকার ওপরে লোকসানই গুনছে।
রাস্তার অবস্থা এত খারাপ হওয়ার কারণ সম্পর্কে এ অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেন, ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজের সময় বেশ কয়েকটি শর্ত ছিল। এর মধ্যে পয়োনিষ্কাশন ও সার্ফেস ওয়াটারের দুটি ড্রেন অকেজো হয়ে রয়েছে। যে কারণে বৃষ্টি হলেই এখানে পানি জমে যায়। নির্মাণকাজে ব্যবহৃত সামগ্রী নির্দিষ্ট একটি জায়গায় রাখার কথা থাকলেও সেগুলো রাখা হয়েছে রাস্তার ওপরে। রাস্তার দুই পাশে জায়গা ছেড়ে মাঝখানে একটি নির্দিষ্ট জায়গার মধ্যে শেড দেওয়ার কথা থাকলেও তা দেওয়া হয়নি। প্রতিদিন রাস্তার দুই পাশে পানি দেওয়ার কথা থাকলেও মাসে একবারও তা ঠিকমতো দেওয়া হয় না। তিন মাস পরপর রাস্তা মেরামত করার কথা থাকলেও শুরু থেকে এখন পর্যন্ত রাস্তা মেরামতের কাজ করা হয়নি।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা সিটির দোকান মালিক অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট মো. রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের কাকরাইল, শান্তিনগর, বেইলি রোড, মৌচাক, মগবাজার, বাংলামোটর এলাকায় মোট দোকান রয়েছে সাত হাজার। এর মধ্যে ৯৫ ভাগ দোকানই কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। দুই বছর ধরে এখানে কোনো প্রকার ব্যবসা নেই। একটা সময় ছিল যখন শুধু ফরচুন শপিং মলের নিচে প্রতিদিন দেড় থেকে দুই হাজার গাড়ি আসত। যারা আশপাশের বিভিন্ন দোকানে কেনাকাটা করত। এখন সেখানে ৬০-৭০টা গাড়ি ঢোকে।
রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া আরো বলেন, ‘আমরা সিটি করপোরেশন, ডিসি, এলজিইডি, লোকল প্রশাসনসহ সবাইকে আমাদের সমস্যার কথা জানিয়েছি। মানববন্ধন পর্যন্ত করেছি। কিন্তু কাজ হয়নি। এখন কবে ফ্লাইওভার নির্মাণ শেষ হবে তাও ঠিকঠাক বোঝা যাচ্ছে না। অন্তত চলার রাস্তাটুকু যদি পরিষ্কার করে দেওয়া হতো তাহলেও মানুষ ও আমরা কিছুটা হাঁফ ছেড়ে বাঁচতাম। এভাবে কত দিন লোকসান দিয়ে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব?’
http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2017/03/14/474187