১৪ মার্চ ২০১৭, মঙ্গলবার, ১১:২৫

আগের রাতে ট্রেজারি থেকেই প্রশ্ন ফাঁস!

 

পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয় সাধারণত দুই সময়ে। পরীক্ষার আগের রাতে আর পরীক্ষার দিন সকালে। সকালে ফাঁসের সঙ্গে জড়িত শিক্ষক ও কোচিং সেন্টারগুলো। আর পরীক্ষার আগের রাতে কিভাবে প্রশ্ন ফাঁস হয় সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই কারো কাছে। তবে এর জন্য ট্রেজারি ঘিরে সন্দেহ বাড়ছে বলে জানা গেছে।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের সাম্প্রতিক বক্তব্যেও আগের রাতে প্রশ্ন ফাঁসে বিজি প্রেসের পাশাপাশি আরো কারো জড়িত থাকার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। গত শুক্রবার দুদকের মানববন্ধনে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘প্রশ্নপত্র রাখা হয় উপজেলা পর্যায়ে। এর নিচে রাখার সুযোগ নেই। আর সে জন্য পরীক্ষা শুরুর দুই ঘণ্টা আগে প্রশ্নপত্র দিতে আমরা বাধ্য। কারণ এই প্রশ্নপত্র গ্রাম পর্যন্ত নিয়ে যেতে হয়। তাহলে কে প্রশ্ন বের করে দিচ্ছে? আমরা এমন একটি পরিবেশের মধ্যে আছি যে সব কিছু খুলেও বলতে পারি না, আবার সহ্যও করতে পারি না। ’
সদ্য শেষ হওয়া এসএসসি পরীক্ষার প্রায় প্রতিটি বিষয়েই প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ ছিল। গণিত পরীক্ষার আগের রাতে পাওয়া প্রশ্নের সঙ্গে পরীক্ষায় আসা প্রশ্নের হুবহু মিল পাওয়ায় তা বাতিলেরও দাবি উঠেছিল। এভাবে নানা অভিযোগে এসএসসি পরীক্ষা শেষ হলেও প্রশ্ন ফাঁস রোধে নেওয়া হয়নি নতুন কোনো উদ্যোগ। ফলে আগামী ২ এপ্রিল থেকে শুরু হতে যাওয়া এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার্থীরা দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছে।
রাজধানীর সিটি কলেজ থেকে এবার বিজ্ঞান বিভাগে এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে সৈয়দ আরাফাত। সে কালের কণ্ঠকে জানায়, ‘খুবই চিন্তা হচ্ছে। বন্ধুদেরও কেউ কেউ প্রশ্ন খোঁজার চিন্তা করছে। কিন্তু কেউ সারা বছর পড়ালেখা করবে আর কেউ পরীক্ষার আগের রাতে প্রশ্ন পেয়ে সমান নম্বর পাবে—এটা তো মেনে নেওয়া যায় না। তা হলে পড়ালেখার দাম রইল কোথায়? আর আমাদের তো কেউ গ্যারান্টিও দিতে পারছে না যে প্রশ্ন ফাঁস হবে না। তাই খুবই দুশ্চিন্তায় আছি। ’ জানা যায়, ১০টি শিক্ষা বোর্ড থেকে হাতে লেখা একাধিক প্রশ্নের সেট বিজি প্রেসে পাঠানো হয়। বোর্ড কর্তৃপক্ষ জানে না কোন দুই সেট ছাপা হবে। ফলে সেখানেই শিক্ষা বোর্ডের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়। এরপর বিজি প্রেসে নানা ধাপে প্রশ্ন ছাপানো হয়। এর মধ্যে রয়েছে কম্পোজ, প্রুফ দেখা, ছাপানোসহ নানা পর্যায়। সেখান থেকে ফাঁসের ঝুঁকি থাকে। এ ছাড়া সংরক্ষণ ও বিতরণের সময়ও ফাঁসের ঝুঁকি থেকে যায়। বিজি প্রেস থেকে কয়েক দিন আগেই সিলগালা করে ট্রাংকে ভরে এই প্রশ্ন সংশ্লিষ্ট জেলার ট্রেজারি, ব্যাংক ট্রেজারিতে নেওয়া হয়। দুই-তিন দিন আগে উপজেলা পর্যায়ে থানা ট্রেজারি বা আশপাশে থানা না থাকলে পুলিশ ফাঁড়ি ট্রেজারিতে সেগুলো রাখা হয়। পরীক্ষার দিন সকালে ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে কেন্দ্রসচিবের কাছে সিলগালা প্যাকেট বুঝিয়ে দেওয়া হয়।
শিক্ষা বোর্ড সূত্র জানায়, বিজি প্রেস ও ট্রেজারিতে প্রশ্ন ফাঁসের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। বর্তমান পরিস্থিতিতে ট্রেজারি ঘিরেই সন্দেহ বেশি বাড়ছে। কারণ বিজি প্রেসে যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা মুখস্থ করাসহ নানাভাবে প্রশ্ন ফাঁস করতে পারেন। কিন্তু প্রতিটি পরীক্ষার দুই সেট প্রশ্ন থাকায় কোন সেট আসবে তা সবার জানার কথা নয়। আর বিজি প্রেসের প্রতিটি স্থানে সিসি ক্যামেরা থাকায় কারো পক্ষে বাইরে প্রশ্ন নেওয়া সম্ভব নয়। তবে ট্রেজারিতে যাঁরা প্রশ্ন নাড়াচাড়া করেন তাঁরা আগে থেকেই জানতে পারেন কোন সেটে পরীক্ষা হবে। কারণ ‘ক’ সেটের জন্য এক রঙের কাগজে নির্দেশনা থাকে। ‘খ’ সেটের জন্য আলাদা রঙে। ফলে প্রথম পরীক্ষার জন্য যেদিন ট্রাংক খোলা হয় সেদিনই বোঝা যায় আগামী দিন কোন সেটে পরীক্ষা হবে।
জানা যায়, সম্প্রতি শেষ হওয়া এসএসসি পরীক্ষার প্রথম দিনের বাংলা প্রথম পত্রের পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের কোনো অভিযোগ ছিল না। কিন্তু দ্বিতীয় দিন বাংলা দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষা থেকেই ফাঁসের অভিযোগ ওঠে। এর কারণ হিসেবে জানা যায়, প্রথম পরীক্ষার দিন সকাল ৭টায় ট্রাংক খোলা হয়। যেহেতু আগে থেকে ট্রাংক খোলার সুযোগ ছিল না তাই প্রশ্নও ফাঁস হয়নি। কিন্তু যেদিন ট্রাংক খোলা হয়েছে এর পরের দিন থেকেই প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ ওঠে। আর প্রত্যন্ত অঞ্চলের পুলিশ ফাঁড়ির ট্রেজারির নিরাপত্তাব্যবস্থা একেবারের নাজুক।
সংশ্লিষ্টরা জানান, গত ৯ ফেব্রুয়ারি ইংরেজি প্রথম পত্রের পরীক্ষার আগের রাতে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে প্রশ্নপত্রের মেইল যায়। সেখানে দেখা যায়, ইংরেজি প্রথম পত্রের ‘ক’ সেটের সঙ্গে তার হুবহু মিল রয়েছে। ফলে রাত ২টায় ইংরেজি প্রথম পত্রের পরীক্ষা ‘খ’ সেটে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু রাত ৪টার দিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের যেসব সাইটে প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ রয়েছে সেখানে লেখা হয়, সেট বদলে গেছে। ইংরেজি প্রথম পত্রের পরীক্ষা হবে ‘খ’ সেটে। অথচ এই পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সর্বোচ্চ তিন ব্যক্তি। তাঁরা রাতেই মেসেজ দেন ১৮ জেলা প্রশাসককে। তাঁরা আবার ১৮ জন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে (শিক্ষা) এই সেট বদলের কথা জানান। তাঁরা আবার তাঁদের অধীন উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে এ সিদ্ধান্ত জানান। সব মিলিয়ে রাতে এই সেট বদলের কথা জেনেছেন সর্বোচ্চ ১২০ জন। তাঁদের কেউ না কেউ এ তথ্য ফাঁস না করলে অন্য কারোর তা জানার কথা নয়। ফলে আগের রাতে প্রশ্ন ফাঁসে ট্রেজারি ঘিরেই সন্দেহ বাড়ছে।
আন্তশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় সাব কমিটির সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. মাহাবুবুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রশ্ন ফাঁস রোধে বিভিন্ন নতুন উদ্যোগের বিষয়ে আলাপ-আলোচনা হয়েছে। তবে এখনো বলার মতো কিছু নেই। আমরা আগের চেয়ে আরো বেশি সতর্ক ও সচেতন। বোর্ডের পক্ষ থেকে কোনো গাফিলতি নেই। কারণ প্রশ্ন ছাপানো, সংরক্ষণ ও বিতরণের দায়িত্ব বোর্ডের নয়। আসলে প্রশ্ন প্রণয়ন থেকে কেন্দ্রে পৌঁছানো পর্যন্ত পুরোটা একটা সমন্বিত কাজ। বড় একটা টিম ওয়ার্ক। কোথায়ও গ্যাপ হয়ে গেলে সমস্যা বেধে যায়। ’
এ ছাড়া গত এসএসসি পরীক্ষার প্রায় প্রতিদিনই সকাল ৭টা থেকে ৯টার মধ্যে একাধিক স্থানে প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে, আর তা এসেছে মূলত পরীক্ষা কেন্দ্র থেকে। কারণ দুই-তিন ঘণ্টা আগে কেন্দ্রে প্রশ্ন পৌঁছানো হয়। তবে তা আধাঘণ্টা আগে খোলার কথা। অসাধু শিক্ষকরা প্রশ্ন পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খুলে তা মোবাইলের মাধ্যমে বাইরে পাঠিয়ে দেন। যা দ্রুত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
চলতি বছরের এসএসসির প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ২১ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। সর্বশেষ রাজধানীর কমলাপুরের শের-এ-বাংলা স্কুলের ইংরেজির শিক্ষক রফিকুল ইসলামসহ একটি দল পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে। তারা জ্ঞানকোষ নামে একটি কোচিং চালাতেন। পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, পরীক্ষার দিন সকালে কোচিং সেন্টারের সদস্যরাই প্রশ্নপত্র সংগ্রহ, বিতরণ ও অর্থ লেনদেনের কাজগুলো করতেন।
পুলিশ ও আদালত সূত্র জানায়, প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় রিমান্ড শেষে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন জ্ঞানকোষ একাডেমির শিক্ষক জহিরুল ইসলাম এবং কমলাপুর শের-এ-বাংলা রেলওয়ে স্কুল অ্যান্ড কলেজের সহকারী শিক্ষক ও জ্ঞানকোষ একাডেমি কেয়ারের পরিচালক রফিকুল ইসলাম। ওই দুই শিক্ষক জানিয়েছেন, প্রতিষ্ঠানের সুনাম বৃদ্ধির জন্য রাজধানীর চারটি প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ এ কাজে উৎসাহ জুগিয়েছেন। পরে একটি সিন্ডিকেট করে প্রশ্নপত্র ফাঁস করা হতো। প্রথমে তাঁরা ফেসবুকের মাধ্যমে ফাঁসের গুজব ছড়াতেন। তারপর নিজেরাই ফাঁস করতেন।
জবানবন্দিতে তাঁরা আরো জানান, জ্ঞানকোষ একাডেমির শিক্ষক জহিরুল ইসলাম ফেসবুকের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র সংগ্রহ করতেন। জ্ঞানকোষ একাডেমি কেয়ারের পরিচালক রফিকুল ইসলামসহ বিভিন্ন স্কুলের কিছু অসাধু শিক্ষক পরীক্ষা শুরুর আগেই প্রশ্নপত্র জহিরুল ইসলামের কাছে পাঠাতেন। জহিরুল ইসলাম ওই প্রশ্নপত্র ও সমাধানসহ ফেসবুকে পোস্ট করতেন। মামলার এজাহারভুক্ত আরেক আসামি আফজাল মিয়াও জহিরুলকে প্রশ্ন পাঠাতেন। এ ছাড়া তারিকুজ্জামান হিমেল, আরিফুল ইসলাম, রুমন হোসেন ‘অ্যাডমিন প্যানেল বিডি’ নামের একটি চ্যাট গ্রুপের অ্যাডমিন হিসেবে কাজ করতেন। তাঁরা বিভিন্নজনের কাছে ৫০০, ৬০০ ও ৮০০ টাকায় প্রশ্ন বিক্রি এবং বিকাশ ও রকেট অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে তা সংগ্রহ করে নিজেদের মধ্যে বণ্টন করতেন।
পুলিশ সূত্র জানায়, প্রশ্নপত্র ফাঁসের অন্যতম হোতা কমলাপুর শের-এ-বাংলা রেলওয়ে স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ আবদুল আলিমকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। মতিঝিল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মতিঝিল কলোনি উচ্চ বিদ্যালয় ও শাহজাহানপুর রেলওয়ে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও পর্যবেক্ষণে আছেন। পর্যাপ্ত তথ্য-প্রমাণ ও নির্দেশনা পাওয়া মাত্রই তাঁদের গ্রেপ্তার করা হবে।
বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সভাপতি নজরুল ইসলাম রনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যেসব শিক্ষক প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত তাঁরা শিক্ষক নামের কলঙ্ক। তাঁরা অপরাধী। গুটিকয়েক লোকের জন্য পুরো শিক্ষক সমাজের ঘাড়ে দায়ভার চাপছে। আমরা অপরাধী শিক্ষকদের চাকরিচ্যুতিসহ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। কোনোভাবেই যেন আইনের ফাঁক গলে এসব শিক্ষক বের হয়ে না আসতে পারেন সে ব্যাপারটি সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে। ’
http://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2017/03/14/474180