১৪ মার্চ ২০১৭, মঙ্গলবার, ১১:২৪

মহানগরী জুড়ে খোঁড়াখুঁড়ি দুর্ভোগ চরমে: চট্টগ্রামে বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়হীনতা

 

চট্টগ্রাম মহানগরীতে বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়হীনতা ও প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতির কারণে জনদুর্ভোগ বেড়েই চলছে। তা ছাড়া সারাবছর খোঁড়াখুঁড়ি এবং ওই সকল সংস্কারে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ না নেওয়ায় সড়কের ভালো অংশেও খানা-খন্দকের সৃষ্টি হচ্ছে। চট্টগ্রাম মহানগরীর উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে দুটি প্রধান সংস্থা সরাসরি জড়িত। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব সড়কের কাজ ও সংস্কার এবং পরিচ্ছন্ন ও আলোকিত নগর গড়ে তোলা মূল দায়িত্ব। অপরদিকে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) কাজ পরিকল্পিত নগর নির্মাণে বিল্ডিংসহ অবকাঠামো উন্নয়নে নিয়ন্ত্রকের দায়িত্ব পালন এবং নতুন সড়ক নির্মাণ করে সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা।

সিটি করপোরেশনের মেয়র জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করে থাকেন। বর্তমান মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন ইতোমধ্যে নগরীর বিভিন্ন সংস্থার প্রধান ও প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে বেশ কয়েকটি বৈঠক করেছেন। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে এ নগরবাসীর স্বাভাবিক চলাচলে যে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে তা উত্তরণে তেমন উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না।

চট্টগ্রাম মহানগরবাসীর বর্তমান সবচেয়ে বড় সমস্যা যানজট। যানজটের জন্য যেমন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন অনেকাংশে দায়ী, একইসঙ্গে সিডিএ কর্তৃক সৃষ্ট দুর্ভোগ দীর্ঘমেয়াদি হয়ে পড়ছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত রবিবার তার বক্তব্যে শুধু নেভাল মোড় থেকে পতেঙ্গা এয়ারপোর্ট পর্যন্ত সড়কের কয়েকটি অংশের বড় বড় গর্ত ও কালভার্ট সংস্কারের ধীর গতিতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু নগরীর আরো বহু এলাকায় এবং মূল সড়কে ছোট-বড় খানা-খন্দকের অসংখ্য নজির রয়েছে। প্রতিবছরের ন্যায় এ বছরের শুরুতেই চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন বিভিন্ন খাল ও নালা নর্দমা খনন ও সংস্কার এবং ময়লা আবর্জনা পরিষ্কারের ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। একইসঙ্গে সড়ক সংস্কারের কাজও চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এরপরও দেখা যায়- কয়েক ঘণ্টার বৃষ্টিতে নগরীর নালা-নর্দমার উপচে পড়া পানিতে সড়ক ছেয়ে যায়।

নগরীর এয়ারপোর্ট থেকে কালুরঘাট পর্যন্ত একটি মাত্র মূল সড়ক। কিন্তু সড়কের অসংখ্য স্থানে ছোট-বড় আছে অসংখ্য গর্ত। একইসঙ্গে বিভিন্ন স্থানে খোঁড়াখুঁড়িতো রয়েছেই।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে যেমন অনেক গাফিলতি ও অনিয়ম রয়েছে একইসঙ্গে তার লোকবল, সক্ষমতা এবং আর্থিক সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। সরকারের বরাদ্দকৃত অর্থ যথাসময়ে ছাড় না করা এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতা প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রধান সমস্যা বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন সাম্প্রতিক সময়ে হোল্ডিং ট্যাক্স পুনঃমূল্যায়ন করলেও নগরবাসী থেকে সেক্ষেত্রে তেমন একটা সহযোগিতা পায়নি। কারণ সিটি করপোরেশন প্রতিটি বাড়ির ভাড়ার ওপর ভিত্তি করে যে ট্যাক্স আরোপ করেছে তা জনগণ স্বাভাবিকভাবে নেয়নি। ফলে ট্যাক্সের যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তা আদায়ে ধীরগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আবার সিটি করপোরেশন তার প্রাপ্ত ট্যাক্সের মাধ্যমে কর্মকর্তা কর্মচারির বেতন-ভাতার টাকা দিতে পারলেও উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তা ছাড়া স্কুল, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন খাতে বিশাল অঙ্কের ভর্তুকি দিতে হয়। যার জন্য সরকারি অনুদান কিংবা বিশেষ সহায়তা ছাড়া অনেক ক্ষেত্রে স্বাভাবিক কার্যক্রম চলা অসম্ভব। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গৃহীত প্রকল্পসমূহ বিগত মেয়ররা করে গেলেও শুধু আর্থিক সংকটের কারণে এখনো বাস্তবায়ন হয়নি।

বর্তমানে চট্টগ্রাম ওয়াসা কর্তৃক সবচেয়ে বেশি পাইপ বসানোর কাজ চলছে। ওয়াসা নগরীর মূল সড়কসহ গলিপথে অসংখ্য স্থান দিয়ে পাইপ লাইন স্থাপনের কাজ করে যাচ্ছে। ওয়াসা সাথে সাথে মাটি চাপা ও ইট বসিয়ে সাময়িক সংস্কার করলেও কয়েকদিনের মধ্যে তা বড় বড় গর্তের সৃষ্টি করে ফেলছে। ফলে পুরো সড়কই ধীরে ধীরে ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। অথচ সাথে সাথে স্থায়ী সংস্কার করা হলে দুর্ভোগে পড়তে হতো না নাগরিকদের। সিটি করপোরেশনকে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দিয়ে তার রোড কাটিং অনুমতি নিয়েছে ওয়াসা। অথচ সিটি করপোরেশন ওই সকল কাটা রাস্তা সংস্কার করার কাজ স্লথ গতিতে এগুচ্ছে। আবার ওয়াসা তার নতুন প্রকল্প থেকে নগরীতে পানি সরবরাহ করলেও পুরাতন লাইন হওয়ায় বিভিন্ন স্থান দিয়ে ফুটো হয়ে পানি বেরিয়ে আসছে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মতে, প্রকল্প শুরু করার পূর্বেই পুরাতন লাইন অতিরিক্ত পানির চাপ গ্রহণ করতে পারবে কিনা তা যাচাই করে দেখা উচিত ছিলো। অতিরিক্ত চাপে বেরিয়ে আসা পানির কারণে বিভিন্ন সড়কে গর্তের সৃষ্টি হচ্ছে।

এদিকে আগামী মাস থেকে বর্ষা শুরু হলে নগরীর জলাবদ্ধতা কী পর্যায়ে পৌঁছায় তা নিয়ে অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। কারণ কয়েকদিনের বৃষ্টিতে নগরীর বিভিন্ন অংশে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা সকলকে ভাবিয়ে তুলছে।

সেই এয়ারপোর্ট সড়ক থেকে শুরু করে নগরীর প্রধান সড়কসহ অলিগলিতে ওয়াসা প্রায় ১২০ কিলোমিটার সড়কে পাইপ লাইন বসানোর কাজ করেছে। জানা যায়, প্রধানমন্ত্রী গত রবিবার নগরীর সড়ক বেহাল দেখে ক্ষোভ প্রকাশ করায় সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে চট্টগ্রাম ওয়াসাকে সোমবার তাদের কাজের ওয়ার্ক প্ল্যান জমা দিতে বলেছে।

শুধু ওয়াসা নয় কর্ণফুলী গ্যাস ও পিডিবিও নগরীর বিভিন্ন অংশে খোঁড়াখুঁড়ি করে চলছে। ফলে পুরো নগরীতে বিভিন্ন সংস্থার সেবা কার্যক্রম সম্প্রসারণের নামে খোঁড়াখুঁড়ি অব্যাহত রয়েছে। এতে করে নগরীতে এক বেহাল অবস্থা বিরাজ করছে। আর সবগুলো কাজই নগরীর প্রধান সড়কসহ ওলিগলি পর্যন্ত চলছে।

এদিকে প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক পতেঙ্গায় বিমানবন্দর সড়কে তিনটি ব্রিজ নির্মাণে দীর্ঘসূত্রতায় ক্ষোভ প্রকাশ করায় গত রবিবার সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে ব্রিজ নির্মাণকারী ঠিকাদারদের ডাকা হয়। জানা যায়, ওই তিনটি ব্রিজের নকশার পরিবর্তনের কারণেই মূলত দীর্ঘসূত্রতায় পড়ে ওই ব্রিজ নির্মাণকাজ। জাইকার নকশা ও পুরো পরিকল্পনার আলোকেই ব্রিজগুলো নির্মাণ হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের কিছু করার থাকে না।

অন্যদিকে গত ২০১৫ সালের মার্চ মাস থেকে শুরু হওয়া লালখানবাজার-মুরাদপুর ফ্লাইওভারের কারণে কালুরঘাট থেকে শুরু করে ওয়াসা মোড় পর্যন্ত অন্তত ৫টি পয়েন্টে যানজট প্রতিনিয়ত লেগে আছে। বিশেষ করে বহদ্দারহাট, মুরাদপুর, ষোলশহর ২নং গেট, জিইসি মোড় এলাকায় যানজট নিত্যদিনের ঘটনা। আবার ২নং গেট থেকে বায়োজিদ সড়কে সাম্প্রতিক সময়ে যানজট তীব্র আকার ধারণ করেছে। একইভাবে মুরাদপুর থেকে অক্সিজেনমুখী সড়কেও একই অবস্থা। তবে ২নং গেট থেকে বায়োজিদ সড়কে ফ্লাইওভারের র্যাম ও লুপ নামার কাজের জন্য সড়কের অধিকাংশ অংশ টিন দিয়ে ঢেকে দেয়ায় যানজট অবর্ণনীয় রূপ ধারণ করেছে। তাছাড়া কাজের গতিও স্লথ।

লালখানবাজার থেকে মুরাদপুর পর্যন্ত ফ্লাইওভারটির কাজ এ বছরের জুন মাসে সম্পূর্ণ শেষ হওয়ার সময় নির্ধারণ থাকলেও আগামী বছরের জুন পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে।

এক্ষেত্রে প্রকল্প ব্যয় ৪৬২ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ৬৯৮ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। ফ্লাইওভারের প্রকল্প পরিচালক সিডিএ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান জানান, জিইসি মোড়ে ৪টি র্যাম এবং ২নং গেট এলাকায় ১টি র্যাম ও ১টি লুপ বাড়ানোর ফলে ডিজাইন পরিবর্তন করতে হয়েছে। এতে করে প্রকল্প ব্যয় ও সময় বেড়ে গেছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, সিডিএ কর্তৃক ৩ দশমিক ৭ কিলোমিটার ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজ চলায় দু’পাশের নালা-নর্দমা অল্প বৃষ্টিতে ভরে যায়। সংশ্লিষ্টদের মতে, ফ্লাইওভারের কাজের কারণে পার্শ্ববর্তী নালা-নর্দমা অল্প বৃষ্টিতে ভরাট হয়ে গেছে।

সিডিএ থেকে বলা হচ্ছে, ফ্লাইওভারের ৮০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। তারা আগামী মাসে দুটি পয়েন্টের র্যাম ও লুপ ছাড়াই চালু করে দেবে। অন্যদিকে সিডিএ বিন্নি এলাকায় আরো কয়েকটি ফ্লাইওভার ও ওভারপাস নির্মাণ করলেও যান চলাচল এবং অর্থ ব্যয়ের সাথে এগুলো সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এসকল ফ্লাইওভার ও ওভারপাস নির্মাণের পূর্ব থেকেই বিভিন্ন সময় এর প্রয়োজনীয়তার বিরোধিতা করা হচ্ছিলো। অবশ্য সিডিএ এর পক্ষ থেকে সবসময় বলে আসা হচ্ছে, গৃহিত ফ্লাইওভার ও প্রকল্পগুলো ভবিষ্যতে জনগণের কাজে আসবে।

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন ইত্তেফাককে জানান, ২০১৫ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পর বিশাল অঙ্কের দেনা এবং প্রকৌশল বিভাগের দক্ষ জনবল সংকট নিয়ে কাজ চালাতে হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে নগরীর সকল সড়কসহ অবকাঠামোর উন্নয়ন কাজ করছি।

তিনি বলেন, জনগণের সাথে আর্থিক বিষয়গুলো এবং বিভিন্ন সংস্থা বিশেষ করে সিডিএ, ওয়াসা, পিডিবি, গ্যাসসহ বিভিন্ন সংস্থার সড়ক কেটে পাইপ লাইন বসানোর কারণে অনেক ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। তিনি বলেন, একদিকে কর্পোরেশন সড়ক নির্মাণ করছে, অন্যদিকে সড়ক কাটা হচ্ছে। তিনি বলেন, এগুলো নিয়ে ইতিমধ্যে সকল সংস্থার মধ্যে সমন্বয় আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, এয়ারপোর্ট রোড এলাকার তিনটি ব্রিজ আগামী জুন মাসের মধ্যে সম্পন্ন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে সিটি কর্পোরেশন সার্বক্ষণিক তদারকি করবে।
http://www.ittefaq.com.bd/print-edition/first-page/2017/03/14/182190.html