১ আগস্ট ২০১১, সোমবার

যাকাতের তাৎপর্য শীর্ষক আলোচনা সভায় মকবুল আহমাদ

দেশকে দারিদ্র্যমুক্ত করতে হলে ইসলামী সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে যাকাতভিত্তিক সমাজ গঠন করতে হবে

জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমীর মকবুল আহমদ বলেছেন, ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছাড়া সকল ক্ষেত্রে ইসলামের প্রতিটি নির্দেশনা সঠিকভাবে পালন করা সম্ভব হয় না। তিনি বলেন, যাকাত ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশকে দারিদ্র্যমূক্ত করে একটি কল্যাণ রাষ্টের ভিত্তি রচনা করতে হলে দেশে একটি ইসলামী সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা এর পূর্বশর্ত। তাই ইসলাম নির্দেশিত সঠিক পন্থায় ধনীদের কাছ থেকে যাকাত আদায় করে নির্ধারিত খাতে যাকাতের অর্থ ব্যয় করতে হলে দেশে ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে সবাইকে কাজ করারও আহবান জানান তিনি।
গতকাল রোববার বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাবে ঢাকা মহানগর জামায়াতের উদ্যোগে যাকাতের তাৎপর্য শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি একথা বলেন। মহানগর জামায়াতের আমীর মাওলানা রফিকুল ইসলাম খানের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন দলের ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম আজহারুল ইসলাম ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য মাওলানা এ টি এম মা'ছুম। বক্তব্য রাখেন কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী সেক্রেটারি এ এইচ এম হামিদুর রহমান আযাদ এমপি, সহকারী সেক্রেটারি নূরুল ইসলাম বুলবুল ও মাওলানা আবদুল হালিম, মহানগরী কর্মপরিষদ সদস্য এডভোকেট মশিউল আলম ও মাওলানা আবদুল মান্নান। উপস্থিত ছিলেন মহানগরী কর্মপরিষদ সদস্য মোহাম্মদ শাহজালাল, মোহাম্মদ ফরিদ হোসাইন, ইঞ্জিনিয়ার গোলাম মোস্তফা ও এ কে এম রফিকুন্নবী প্রমুখ।
মকবুল আহমদ বলেন, সরকার ধর্মনিরপেক্ষতার নামে দেশ থেকে ইসলামকেই নির্মূল করার ষড়যন্ত্র করছে। তিনি অভিযোগ করে বলেন ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বললেও সরকার এখন প্রকাশ্যেই ইসলামের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। অন্য সকল ধর্মের কাজে কোন বাধা না দিলেও সরকার ইসলামের কাজেই বাধা ও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। সমাজ থেকে ইসলামকে দূরে সরিয়ে রাখতেই নানা অপতৎপরতা চালাচ্ছে সরকার।
ভারপ্রাপ্ত আমীরে জামায়াত বলেন সরকার দারিদ্র্য বিমোচনের নামে হাজার কোটি টাকা ব্যয় করলেও যারা গরীব তাদের কপাল কোন সময়েই ফেরে না। যাকাতভিত্তিক অর্থব্যবস্থার পরিবর্তে বর্তমানে সমাজে এখন সুদভিত্তিক অর্থনীতি চালু থাকার কারণেই ধনীরা আরো ধনী হচ্ছে আর গরিবরা হচ্ছে আরো নিষিত নির্যাতিত। এই অবস্থার পবিবর্তন করতে হলে যাকাতভিত্তিক অর্থব্যবস্থা চালুর কোন বিকল্প নেই বলেও তিনি উল্লেখ করেন। প্রধান অতিথি বলেন, ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে যাকাত অন্যতম। কুরআনে নামাজ ও যাকাতের কথা যুগপৎভাবে বলা হয়েছে। নামাজ আদায় করা যেমন ফরজ, ঠিক তেমনিভাবে যাকাত আদায় করাও ফরজ। তাই নামাজের মত যাকাতও গুরুত্বপূর্ণ। আর যাকাতভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধম্যেই সমাজে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। তিনি ইসলামের ভিত্তিতে যাকাতভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সকলকে শরীক হওয়ার আহবান জানান।
মকবুল আহমদ আরো বলেন, আমরা ইসলামের কথা বলি বলেই আমাদেরকে মৌলবাদী বলে গালি দেয়া হয়। তারা নিজেদেরকে ধর্মনিরপেক্ষ বলে প্রচার করে। মূলত মানুষকে ইসলাম থেকে দূরে রাখার জন্য এসব কথা বলা হয়। তারা কুরআন-হাদিসকে জিহাদী ও মৌলবাদী গ্রন্থ হিসেবে অপপ্রচার করে। আসলে কুরআন-হাদিস জামায়াতের নিজস্ব সম্পদ নয়। এ সম্পদ সবার। তাই দুনিয়ায় শান্তি ও আখেরাতে মুক্তি লাভ করতে হলে সকলকে ইসলামী জীবনাদর্শের দিকেই ফিরে আসতে হবে। তিনি বলেন,যাকাত কোন অনুগ্রহ বা দান খয়রাত নয়। বিত্তবান মানুষের উদ্বৃত্ত সম্পদের উপর অভাবী মানুষের হক রয়েছে। ট্যাক্স আর যাকাত এক জিনিস নয়। অনেকে এমন আছে যে,তারা নামাজ পড়তে রাজী কিন্তু যাকাত দিতে রাজী নয়। কিন্তু হযরত আবু বকর সিদ্দিক যাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে প্রমাণ করেছেন যাকাত অন্যান্য ফরজ ইবাদতের মতই। তাই যাকাত অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। তিনি আরও বলেন, ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা ছাড়া সমাজ পরিবর্তন সম্ভব নয়। আমরা ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে সমাজ পরিবর্তন করার চেষ্টা করি বলে আমাদেরকে মৌলবাদী বলে গালি দেয়া হয়। আবার কখনো বলা হয় সাম্প্রদায়িক। কিন্তু আল্লাহর আকাশ-বাতাসতো সাম্প্রদায়িক নয়। তাই আল্লাহর বিধান কখনো সাম্প্রদায়িক হতে পারে না। যেহেতু আমরা সমাজে আল্ল-াহর বিধান প্রতিষ্ঠিত করতে চাই তাই আমরাও সাম্প্রদায়িক নই। তিনি ইসলামের বিরুদ্ধে যেকোন ধরনের অপপ্রচার থেকে সকলকে সতর্ক থাকার আহবান জানান।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে এ টি এম আজহার বলেন, ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে যাকাত অন্যতম। দেশে যাকাত আদায় করলে বছরে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা আদায় করা সম্ভব। কিন্তু আমরা তা যথাযথভাবে আদায় করছি না। ফলে দরিদ্র মানুষের দুর্দশা ক্রমেই বাড়ছে। আমরা ক্ষুদ্র্ ঋণের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনের চেষ্টা করছি। কিন্তু এই ক্ষুদ্রঋণ আমাদের দেশকে দ্রারিদ্র্যমুক্ত করতে পারেনি। মূলত আমাদের দেশের অর্থ ব্যবস্থা হচ্ছে সুদভিত্তিক। আর সুদ হচ্ছে শোষণের হাতিয়ার। যতদিন দেশে সুদভিত্তিক পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থা চালু থাকবে ততদিন দেশকে দারিদ্র্যমুক্ত করা সম্ভব হবে না। দেশে যাকাতভিত্তিক অর্থব্যবস্থা চালু হলে ৩ থেকে ৫ বছরের মধ্যে দারিদ্র্যমুক্ত করা সম্ভব।
তিনি বলেন, যাকাতভিত্তিক সমাজ মানুষের মধ্যে সৌহার্দ্য সৃষ্টি করে। যাকাতকে দরিদ্র মানুষের জন্য দয়া বা অনুগহ মনে করার কোন সুযোগ নেই। মূলত যাকাত দরিদ্র মানুষের হক। কিন্তু আমাদের দেশে যাকাত ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত না থাকার কারণে আমরা এর কল্যাণ থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত। মূলত ইসলামী সরকার প্রতিষ্ঠিত করতে পারলেই সমাজে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। জামায়াতে ইসলামী সেই শান্তির সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। তাই সরকার রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্যই আমীরে জামায়াত মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীসহ শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে কথিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের নামে নিজেরাই মানবতাবিরোধী অপরাধ ও সংবিধান লংঘন করছে। সরকার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়ে চরম দলন-পীড়নের পথ বেছে নিয়েছে। সরকার জুলুম-নির্যাতনের মাধ্যমে দেশ থেকে ইসলাম ও ইসলামী মূল্যবোধ ধ্বংস করার গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। তিনি ষড়যন্ত্র বন্ধ করে আমীরে জাময়াত মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীসহ শীর্ষনেতৃবৃন্দের নিঃশর্ত মুক্তি দাবী করেন। অন্যথায় রমযানের পর দুর্বার গণআন্দেলনের মাধ্যমে নেতৃবৃন্দকে মুক্ত করা হবে।
মাওলানা এ টি এম মা'ছুম বলেন, যাকাত মূলত ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় অন্যতম স্তম্ভ। আল্লাহ রাববুল আলামীন ইসলামের যে ৫টি রুকন দিয়েছেন তার মধ্যে যাকাত অন্যতম। যাকাতকে আল্লাহ বিত্তবানদের উপর ফরজ করে দিয়েছেন। যা অভাবগ্রস্ত ও দুস্থদের মধ্যে বিতরণ করা হবে। যাকাত প্রদানের মাধ্যমে মালের পরিশুদ্ধি ও শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। মূলত সম্পদ যাতে বিশেষ শ্রেণীর হাতে পুঞ্জীভূত ও কুক্ষিগত না হয় সেজন্যই আল্লাহ রাববুল আলামীন বিত্তবানদের যাকাত ফরজ করে দিয়েছেন। যাকাত আদায়ের দায়িত্ব রাষ্ট্রের এবং তা হকদারদের মধ্যে পৌঁছানোর দায়িত্বও হলো রাষ্ট্রের। কিন্তু আমাদের দেশের সরকার সে দায়িত্ব পালন করে না। আসলে যাকাতভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠিত না থাকার কারণেই অর্থনৈতিক বৈষম্য বিদ্যমান। তাই এ বৈষম্য দূর করতে হলে ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে যাকাতভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তিনি আর্তমানবতার কল্যাণে যাকাতভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সকলকে শরীক হওয়ার আহবান জানান।
এ এইচ এম হামিদুর রহমান আযাদ এমপি বলেন, ইসলামের ৫ টি স্তম্ভের মধ্যে যাকাত অন্যতম। যাকাত সাহেবে নেসাবদের উপর ফরজ করা হয়েছে। দেশকে সুখী, সমৃদ্ধ করে গড়ে তুলতে হলে যাকাতভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার কোন বিকল্প নেই। যাকাত অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করে সমাজে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে। যাকাতকে দান-খয়রাত মনে করার সুযোগ নেই। কাউকে যাকাত দেয়াকে অনুগ্রহও মনে করা যাবে না। মূলত যাকাত দরিদ্র মানুষের হক। বিত্তবানদের এ হক আদায় করতে হবে। সমাজে সার্বিক শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে যাকাতভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার কোন বিকল্প নেই। তিনি দেশকে ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্রে পরিণত করার আন্দোলনে সকলকে শরীক হওয়ার আহবান জানান।
নূরুল ইসলাম বুলবুল বলেন, যাকাত আমাদের উপর ফরজ করা হযেছে। যাকাত শব্দের অর্থ পবিত্র, পরিশুদ্ধকরণ ও বৃদ্ধিকরণ। যাকাত প্রদান করলে সম্পদ কমে না বরং উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়। মূলত যাকাত ৮টি খাতে ব্যবহার করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। আল্লাহর নির্ধারিত পন্থায় যাকাত আদায় করে সুনির্দিষ্ট খাতে যাকাতের অর্থ ব্যয় করতে পারলেই একটি সুখী, সমৃদ্ধ সমাজ প্রতিষ্ঠা সম্ভব। তিনি যাকাতভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সকলকে শরীক হওয়ার আহবান জানান।
মাওলানা আব্দুল হালিম বলেন, ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। মানুষের ইহলৌকিক কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তির গ্যারান্টি রয়েছে ইসলামী জীবনব্যবস্থার মধ্যে। আর যাকাতভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই বিশ্বমানবতার অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন সম্ভব।
এডভোকেট মশিউল আলম বলেন, যাকাতভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশে শোষণমুক্ত ও ভ্রাতৃত্বের সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। তিনি বলেন ঈমানের পরীক্ষায় পরীক্ষা দিয়ে আমাদের উত্তীর্ণ হয়ে প্রমাণ দিতে হবে আমরা যথার্থই ঈমানদার।
মাওলানা আব্দুল মান্নান বলেন, নামাজের মতো যাকাতও আমাদের উপর ফরয করা হয়েছে। কাজেই নামাজ রোজাকে যেভাবে আমরা গুরুত্ব দেই ঠিক সেভাবেই যাকাতের গুরুত্ব উপলব্দি করে ইসলাম নির্ধারিত পদ্ধতিতে আমাদেরকে যাকাত আদায় করতে হবে।
সভাপতির বক্তব্যে মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান বলেন, যাকাত কোন অনুগ্রহ নয়। রাসুল (সা.) যাকাতের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, তা ধনী ব্যক্তিদের কাছ থেকে আদায় করে অভাবগ্রস্তদের মাঝে বিতরণ করতে হবে। ধনীদের সম্পদের উপর আল্লাহ বিত্তহীনদের অধিকার দিয়েছেন। আর বিত্তবানদের সে হকই আদায় করতে হবে। মূলত যাকাতভিত্তিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মধ্যেই আর্তমানবতার অর্থনৈতিক মুক্তি রয়েছে। আর ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই যাকাতভিত্তিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। তিনি ইসলামী সমাজ বিনির্মাণে সকলকে আপোষহীনভাবে কাজ করার আহবান জানান।

দৈনিক সংগ্রাম