১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, বুধবার

-বুদ্ধিদীপ্ত এক বিচক্ষণ ব্যক্তি

মরহুম মাওলানা আবুল কালাম মুহাম্মদ ইউসুফ 

 
উপমহাদেশের প্রখ্যাত হাদীস বিশারদ, আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন, অসংখ্য আলেম-ওলামার রুহানী উস্তাদ, সাবেক মন্ত্রী, বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ, বহু গ্রন্ত প্রণেতা মাওলানা আবুল কালাম মুহাম্মদ ইউসুফ (র.)। আল্লাহর দ্বীনের এই একনিষ্ঠ দা’য়ী দেশে-বিদেশে দ্বীনের দাওয়াত প্রচার-প্রসারে ইতিহাসে ভূমিকা পালন করেছেন। প্রতিষ্ঠা করেছেন অসংখ্য মসজিদ, মাদরাসা ও সামাজিক সংগঠন। চাষীদের জন্য কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তাদের তিনি ছিলেন অন্যতম। সামাজিক অনাচার, দূরাচার মুক্ত করতে তিনি আমৃত্যু ভূমিকা পালন করেছেন।  
 
মাওলানা একেএম ইউসুফ বাংলাদেশের সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলেমে দ্বীন ছিলেন। শুধুমাত্র ইসলামী আন্দোলন করার কারণে জালেম সরকারের রোষানলে পড়েছেন তিনি। তথাকথিত মানবতাবিরোধী অপরাধের নামে এই বিশিষ্ট আলেমে দ্বীনের উপর চালানো হয়েছে জুলুম। কারাগারে তিনি মানবেতর জীবন-যাপন করেছেন। তারপরও এই বয়ো:বৃদ্ধ আলেমে দ্বীনকে জামিন দেয়নি ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকার। চিকিৎসা মানুষের মানবিক ও মৌলিক অধিকার হলেও এই সরকারের যাঁতাকলে পিষ্ঠ হয়ে ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ সালে মাওলানা ইউসুফ সুচিকিৎসার অভাবে কারাগারে ইন্তেকাল করেছেন। 
 
মাওলানা আবুল কালাম মুহাম্মদ ইউসুফ দেশে এবং বিদেশে একজন পরিচিত ও প্রখ্যাত দ্বীনি ব্যক্তিত্ব। তিনি একজন সু-রসিক বক্তা, বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, সংগঠক, লেখক। সর্বোপরি তিনি হলেন একজন বলিষ্ঠ দায়ী’ ইলাল্লাহ। ১৯৫২ সাল থেকে তিনি বিরামহীনভাবে এ ভূখন্ডে দায়ী’ ইলাল্লাহর ভূমিকা পালন করে চলেছেন। ’৫০ দশকের শুরুতেই যারা এ ভূখন্ডে ইসলামী আন্দোলনের কাজ শুরু করেছেন তাদের অন্যতম একজন হলেন মাওলানা আবুল কালাম মুহাম্মদ ইউসুফ। 
 
জন্ম ও শিক্ষা:
১৯২৬ সালের ২ ফেব্রুয়ারী খুলনা বিভাগরে বাগেরহাট জিলার শরণখোলা থানায় মাওলানা আবুল কালাম মুহাম্মদ ইউসুফ জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মরহুম মুন্সি আজিমউদ্দিন। মাতার নাম আয়েশা খাতুন। 
তাঁর শিক্ষা জীবন ছিল অতি উজ্জ্বল। নিজ গ্রামে প্রাথমিক শিক্ষা লাভের পর তিনি রায়েন্দা মাইনর স্কুলে এবং পরবর্তীতে আমতলী সিনিয়র মাদরাসায় ভর্তি হন। তিনি পূর্ব পাকিস্তান মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড থেকে আলিম পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন এবং ১৯৫০ সালে ঢাকা আলীয়া মাদরাসা থেকে ফাজিল পরীক্ষায় প্রথম স্থান দখল করেন ও ১৯৫২ সালে কামিল পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। 
 
কর্মজীবন:
ছাত্র জীবন শেষ হওয়ার পর তিনি খুলনা আলীয়া মাদরাসায় শিক্ষকতা পেশায় নিযুক্ত হন। ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত খুলনা আলীয় মাদরাসায় প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসেবে প্রায় ১০ বছর শিক্ষকতা করেন। তিনি ১৯৬২ সালে মাদরাসার চাকুরী ছেড়ে সরাসরি আল্লাহর দ্বীন কায়েমের কাজে আত্ননিয়োগ করেন।  
 
ইসলামী আন্দোলন ও রাজনৈতিক জীবন:
ছাত্র জীবন থেকে তিনি ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে জড়িত হয়ে পড়েন। জমিয়তে তালাবায়ে আরাবিয়ার একজন কেন্দ্রিয় সদস্য ছিলেন। তিনি বৃটিশ বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। পঞ্চাশের দশকে মাওলানা ইউসুফ ইসলামী আন্দোলনের সংস্পর্শে আসেন। ১৯৫২ সালের মাঝামাঝি তিনি জামায়াতে ইসলামীতে একজন মুত্তাফিক হিসেবে যোগদান করেন। একই বছরে ডিসেম্বরে তিনি পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর (রুকন) সদস্যপদ লাভ করেন। ১৯৬৩ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমীর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং পাকিস্তান কেন্দ্রিয় মজলিসে শুরার সদস্য ছিলেন। ১৯৮৩ সাল থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের সেক্রেটারী জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেন এবং ১৯৮৮ সাল থেকে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের নায়েবে আমীর হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। বর্তমানে মাওলানা ইউসুফ বাংলাদেশ চাষী কল্যাণ সমিতি, দারুল আরাবিয়া ও দারুল ইফতা এবং ওলামা মাশায়েখ কমিটিরও সভাপতি। জামায়াতের অভ্যন্তরীণ বহুবিধ কাজে তিনি জড়িত এবং যোগ্যতা ও দক্ষতার সাথে সব আঞ্জাম দিয়ে চলেছেন। 
 
জামায়াতে ইসলামীর মনোনিত প্রার্থী হিসেবে তিনি ১৯৬২ সালে জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। 
তিনি ৬০-এর দশকে সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত পি.ডি.এম. এবং ডাক-এর কেন্দ্রিয় সদস্য ছিলেন। তিনি বেশ কয়েকবার কারাবরণ করেন। তিনি প্রখর বুদ্ধিদীপ্ত একজন বিচক্ষণ ব্যক্তি। পার্লামেন্ট সদস্য হিসেবে তিনি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছেন। 
 
সামাজিক কাজ:
মাওলানা আবুল কালাম মুহাম্মদ ইউসুফ বাংলাদেশ চাষী কল্যাণ সমিতির সভাপতি হিসেবে দারিদ্র্য বিমোচন, কৃষি অগ্রগতির পদ্ধতি, বিশেষ করে দরিদ্র ও ভূমিহীন চাষীদের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছেন। শিক্ষা সম্প্রসারণেও তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য। তিনি বর্তমানে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ইয়াতীমখানার সভাপতি। 
উল্লেখ্য যে, তিনি কুয়েত ভিত্তিক আন্তর্জাতিক ইসলামিক চ্যারিটেবল সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা এবং এশিয়া ইসলামিক পরিষদের কেন্দ্রিয় কমিটির সদস্য। 
 
দেশ ভ্রমণ:
এ পর্যন্ত তিনি প্রায় ৩০টি দেশ ভ্রমণ করেছেন। এগুলো হলো- ভারত, পাকিস্তান, সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, আমীরাত, ওমান, মিসর, সুদান, জর্দান, থাইল্যান্ড, সিংগাপুর, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলংকা, ইংল্যান্ড আমেরিকা এবং কানাডা। এসব দেশ সফরকালে আন্তর্জাতিক ইসলামী ব্যক্তির সাথে সাক্ষাৎ করে মতবিনিময় করেছেন এবং বিভিন্ন সংস্থার সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে বক্তব্য পেশ করেছেন। 
 
সাহিত্য কর্ম:
তিনি অনেক মূল্যবান বই লিখেছেন- যেমন মহাগ্রন্থ আল কুরআন কি ও কেন, হাদীসের আলোকে মানব জীবন, সত্য ধর্ম, বিদেশে আমি কী দেখলাম, আমেরিকা, কানাডা এবং ইংল্যান্ডে আমার ভ্রমণ, আফগানিস্তানে যা দেখেছি, ইত্যাদি। 
 
বৈবাহিক জীবন:
১৯৪৯ সালে তিনি রাবেয়া খাতুনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের ৩ ছেলে ও ৫ মেয়ে।